হুজুর একটি চেয়ারে বসে আছেন । ফালানি ছটফট করছে । এখন ছাড়া পেতে চাইছে সে । চারপাশে বৃত্তাকারে মানুষের সারি । রাতুল দাদার হাতে তেল দিয়ে কোনরকমে বলল, এই নিন দাদা । অনেক কষ্ট করে আনলাম । দাদু ঘরে নেই । পুকুর ঘাটে । খুঁজতে খুঁজতে আমার অনেকক্ষণ চলে গেল । এইটুকু বলেই সে হাফাতে লাগলো ।
মনির উদ্দিন সাহেব ওর কথা শুনল কী শুনল না – কিছুই বুঝা গেল না । তিনি তেল হাতে নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন । সবাই উদ্বিগ্ন । যে কোন মুহূর্তে জিন ধরা পড়বে । মনির উদ্দিন সাহেব ভিড় ভিড় করে কী যেন জপলেন । তারপর সরিষার তেলে দিলেন এক ফুঁ । সরিষার তেলের কোন পরিবর্তন হল না । যেমন ছিল তেমনই রইল । অনেকের ধারনা
ছিল যাদুকরী কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে । তবে তেমন কিছুই ঘটল না । এতে অনেকেই কিছুটা হতাশ হল । আবার হুজুর সম্পর্কে যাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল, তারা বলতে লাগল, আরে দেখ দেখ এখনই জিন ধরা পড়ল বলে ! এই ধরনের ঘটনা রাতুল আর অহনা জীবনে আর কোনদিন দেখেনি । দাদার প্রতি রাতুলের অগাধ আস্থা । তাই সে দাদুর পিছু পিছু সব কিছু দেখে যাচ্ছে । ভিতরে ভিতরে তার আরও একটি উদ্দেশ্য আছে; যা আর কেউই জানে না । সেটি হল দাদার নিকট থেকে কিভাবে জিন ধরা শেখা যায় ।
মনির উদ্দিন সাহেব পড়া তেল ফালানির দুচোখের ভিতরে ঢেলে দিলেন । আর একটি শক্ত রশি দিয়ে তার হাত পা বেঁধে দিলেন । সে সমানে চেঁচাচ্ছে। লাফাচ্ছে । ছুটে যেতে চাইছে । কিন্তু ছুটতে পারছে না । তারপর তিনি ফালানির একটি আঙুলে শক্ত করে ধরলেন । এবার জিন কথা বলে উঠল ।
হুজুর আমারে ছাইড়া দেন । আমি আর কোনদিন মানুষেরে ধরুম না ।
তরে আর ছারতাম না । বোতলের মধ্যে বন্দি কইরা রাইখা দিবাম ।
হুজুর আপনার পায়ে পড়ি । মাফ চাই । আমারে ছাইড়া দেন । আমি আর এ এলাকায় আসুম না ।
আগে বল তোর নাম কী ?
আমার নাম ইয়ামলিকা ।
এই নাম শুনে একজন মন্তব্য করল, এই দেখ হুজুর তো আগেই এই নামটা বলেছিল । তাই না ? কয়েকজন সাথে জবাব দিল, হ হ । এই হইল হুজুরের কেরামতি ! এদিকে হুজুর প্রশ্ন করেই চলেছে — ।
তোর বাড়ি কোথায় ?
পরীস্থান ।
তুই জিন না পরী ?
আমি পরী ।
তোর বয়স কত ?
পাঁচশ বছর ।
তুই কি একাই এসেছিস ?
না ।
সাথে আর কে কে আছে ?
পরী রাজকন্যা বানেছা আর তার সখিরা । আমিও রাজকন্যার সখি ।
এখানে তোরা কোথায় থাকিস ?
উজাড় বাড়িতে ।
তোরা এখানে এসেছিস কেন ?
রাজকন্যা জামশেদ নামের এক বাঁশিওয়ালার প্রেমে পড়েছে । তার বাঁশি না শুনে রাজকন্যা থাকতে পারে না ।
এই কথা শোনে সকলেই চমকে উঠল । শুধু চমকে উঠল না তিনজন । রাতুল, অহনা আর জামশেদ নিজে । সে মাথা নিচু করে রেখেছে । সবাই তাকে এমন ভাবে দেখছে যেন ভুত !
কেউ কেউ আবার বাহাবা দিচ্ছে । ধন্য ধন্য করছে । অহনা জিজ্ঞেস করল, দাদা ভাই, জিন আর পরী কি একই জাতের ?
মনির উদ্দিন সাহেব বললেন, একই জাতের দাদু ভাই । আমরা মানুষেরা যেমন নারী-পুরুষ । ওরাও তেমনি । পরী হল নারী জিন । জিন জাতি মানুষের পূর্বে পৃথিবীতে এসেছে । তারা আগুনের তৈরি ।আমরা তাদের দেখি না। কিন্তু তারা আমাদের দেখে ।আমরা অন্য কোন প্রাণীর রুপ ধরতে পারি না । কিন্তু তারা পারে । অভিশপ্ত শয়তানও একজন জিন । তার পিতার নাম খবীস আর মাতার নাম নীলবিস । মানুষের যেমন হাশরের মাঠে বিচার-আচার হবে; তেমনি জিনদেরও হবে ।
আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআন শরীফে বলেছেন, আমি মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি কেবল আমার ইবাদতের জন্য ।
সবাই মুগ্ধ হয়ে হুজুরের কথা শুনছে । শুনসান নীরবতা ।দাদার জ্ঞানের পরিসর দেখে রাতুল মনে মনে নিজেকে ধন্য ভাবছে । অহনা সব কিছু যুক্তি ও বিজ্ঞানের আলোকে চিন্তা করছে ।কোনটা সঠিক আবার কোনটা বেঠিক পরিমাপ করতে পারছে না ।
মনির উদ্দিন সাহেব পরীকে আবার জিজ্ঞেস করলেন,
আচ্ছা, তুই ফালানিরে ধরছস কেন ?
আমি রইদে চুল শুকাইতেছিলাম । হে আমার চুলে পাড়াইছে ।
হে কি তোর চুল দেইখ্যা পাড়াইছে ?
না ।
তাহলে ধরলি কেন ?
আর ধরুম না হুজুর । আমারে মাফ কইরা দেন ।
মাফ করতে পারি এক শর্তে ?
কী ?
তুই আর জীবনে মানব সমাজে আসবি না ।
ঠিক আছে ; আসব না ।
আর একটি শর্ত আছে ?
কী ?
তুই বল, আমি মানুষের হাগু খাই, পেচ্ছাব খাই ।
পরী কিছু বলল না; সে চুপ করে থাকল ।হয়ত তার আত্ম সম্মানে লেগেছে । কিন্তু হুজুর ছাড়বার পাত্র নন । তিনি আঙুলে আরও জোরে চাপ দিয়ে বললেন,
চুপ করে আছিস কেন? দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা । এই বলে দুচোখে আরেকবার তেল ছিটিয়ে দিলেন ।
পরী বাবাগো, মাগো বলে কান্নাকাটি করতে লাগলো ।
হুজুর আবার ধমক দিলেন, কী বলবি না ?
এইবার পরী স্বীকার গেল । ঠিক আছে আমি মানুষের হাগু খাই, পেচ্ছাব খাই ।
এই কথা শুনে উপস্থিত সকলেই হাসতে লাগলো । কেউ কেউ বলল, ঠিক আছে হুজুর । ওরে
সত্যি সত্যি হাগু- মুতু খাওয়ান দরকার । রাতুল বলল, দাদু, একটু নিয়ে আসব নাকি ?
হুজুর বললেন, না । তারপর পরীর দিকে তাকিয়ে বললেন, মনে থাকবে ?
থাকবে হুজুর ।
তাহলে যা । আমি তোরে ছাইড়া দিলাম । সঙ্গে সঙ্গে আঙুল ছেড়ে দিলেন । হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিলেন । সা সা করে আওয়াজ হল । পরীর চলে যাওয়ার শব্দ সকলেই নিজ কানে শুনতে পেলেন । এক শ্বাসরুদ্ধকর সময়ের অবসান হল । সকলেই একসঙ্গে হাততালি দিল । এদিকে পরী চলে যাওয়ার সাথে সাথে ফালানি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল । হুজুর ফালানির চোখে মুখে জলের ছিটা দিলেন । ফালানির জ্ঞান ফিরে আসল । যে যার মত কেটে পড়ল ।
শুধু রাতুল দাদুর পেছনে পেছনে ঘুরতে লাগলো । আর মনে মনে ভাবতে লাগলো, কিভাবে
দাদুকে আসল কথাটা বলা যায় !