লাল কাপ আর তার বন্ধুরা রাতে ঘুমাচ্ছে। এমন সময় হঠাৎ ওদের আলমারিতে একটা বিকট আওয়াজ হল।
ঘুর ঘুর ঘচাৎ।
আরে এটা আবার কি রকম আওয়াজ? দেখি তো কোথা থেকে আসছে! – বলল লাল কাপ।
ওর সামনে কে যেন একটা নড়ে চড়ে উঠল। কে ওটা? কাছে যেতেই বুঝল – এটা তো কেটলি-দাদা।
তবে কি কেটলি-দাদার ঘুম ভাঙল?
হঁ্যা তাই তো। কেটলি-দাদা হাত পা ছুড়ে আড়মোড়া ভাঙছে।
কেটলি-দাদা, যাক বাবা, এতদিনে তোমার ঘুম ভাঙল! – বলল লাল কাপ।
গুড মর্নিং লাল কাপ – বলল কেটলি দাদা।
সেই শুনে লাল কাপের তো মুখে আর হাসি ধরে না। ছুটে গিয়ে সব্বাইকে বলল – এই জানিস, কেটলি-দাদা উঠে গেছে।
কয়েকটা কাপ লাফিয়ে উঠে পড়ল। বলল -তাই নাকি রে, চল তো দেখে আসি।
কেউ কেউ বলল – উফ্ ঘুমোতে দে তো!
বাকিরা নড়াচড়াই করল না।
যাই হোক, সকালবেলায় সব কাপেরা ঘুম থেকে উঠে দেখল যে কেটলি-দাদা হাসি হাসি মুখে বসে আছে।
কয়েকজন কাপ তো সকাল সকালই কাজ করতে বেরিয়ে গেল। বাড়ির সব চেয়ে ছোট মানুষটার আবার লাল কাপকে খুব পছন্দ। সে লাল কাপেই দুধ খায়। লাল কাপও কিছুক্ষণ কাজ করে ফিরে এলো।
এসে দেখে যে কেটলি-দাদা সব কাপেদের গল্প বলছে।
লাল কাপকে দেখে কেটলি-দাদা বলল – আয় লাল কাপ, বোস। তোকেও বলি কাপ-বাবার সাথে প্লেট-ড্র্যাগনের ভয়ঙ্কর যুদ্ধের গল্প।
তা সারা দুপুর কেটলি দাদা গল্প বলল। লাল কাপের বেশ ভালো লাগল।
রাতে যখন সবাই শুতে গেল, তখনও কেটলি-দাদা জেগেছিল। লাল কাপ বলল – আচ্ছা কেটলি-দাদা, তুমি এত ঘুমাও কেন বল তো?
আর কি বলব ভাই, সে এক লম্বা গল্প।
আহা বলোই না।
শুনবি? বেশ, শোন তাহলে।
অনেক অনেক দিন আগের কথা। তখন আমি এই বাড়িতে আসিনি। তখন আমি এক জাদুকরের বাড়িতে থাকতাম। জাদুকর রোজ এক কেটলি ভর্তি চা বানাতো। আর তারপর সেই চা েঢলে ঢেলে সারা সকাল ধরে খেত।
জাদুকর খুব ভালো লোক ছিল। তা একদিন একটা লোক জাদুকরের সাথে দেখা করতে এলো। জাদুকর এক কেটলি চা বানালো। তারপর কি যেন একটা আনতে ভিতরের ঘরে গেল।
সেই ফাঁকে দেখি অন্য লোকটা আমার ঢাকনা খুলল। তারপর কি যেন একটা ঢালল। একটা অন্য রকম গন্ধে আমার ভিতরটা ভরে গেল।
তার পরে পরেই জাদুকর এসে কাপে চা ঢালল। খেলোও বোধহয়। অন্য লোকটা কিন্তু খেলো না। কি একটা অজুহাত দিয়ে বেড়িয়ে গেল।
তারপরই জাদুকর ঘুমে ঢলে পড়ল। আমি তো অবাক! জাদুকর তো এই রকম অসময়ে ঘুমায় না। তবে কি হল ওর?
জাদুকর সারা দিন সারা রাত চেয়ারে বসেই ঘুমালো। আমাকে ধুলোও না।
যাই হোক, রাত্রিবেলা দেখলাম সদর দরজাটা হঠাৎ খুলে যাচ্ছে। সকালের লোকটা চুপিচুপি ঘরে ঢুকল। তারপর জাদুকরের ঘর থেকে কি সব নিয়ে বেড়িয়ে গেল। আমি কত নড়াচড়া করার চেষ্টা করলাম জাদুকরকে ওঠানোর জন্য। কিন্তু জাদুকর উঠল না।
আমাকে দেখে লোকটার কি মনে হল কে জানে? ও আমাকে তুলে নিল। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। আর তারপর আমাকে নিজের সঙ্গে নিয়ে নিল। আমার তো একটুও যাওয়ার ইচ্ছা নেই ওর সাথে। কিন্তু কি করি? আমি তো একটা কেটলি। মানুষ যেখানে নিয়ে যাবে, সেখানেই যেতে হবে।
তা ওই লোকটা আমাকে একটা দোকানে বেচে দিল। সেখান থেকেই এবাড়ির লোকেরা আমায় কিনে আনল।
ওই লোকটা চায়ে যে জিনিসটা মিশিয়ে ছিল, সেটার জন্যই বোধহয় আমার দিন দিন ঘুম বেড়ে যাচ্ছে। কি যে করি? আজ ঘুমোলে কবে যে জাগব, সেটাও জানি না।
এই বলে কেটলি-দাদা চুপ করল।
পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠেই লাল কাপ বন্ধুদের পুরো গল্পটা বলল। কি করে যে কেটলি-দাদার ঘুমটা স্বাভাবিক করা যায়, এই নিয়ে তারা খুব চিন্তাভাবনা করতে লাগল। এদিকে এতদিন টানা ঘুমানোর পর, কেটলি-দাদার তো এখন চোখে ঘুমই নেই। কাউকে না কাউকে ধরে সারা দিন, সারা রাত গল্প করে যায়। এর ফলে কাপেদের, বিশেষ করে লাল কাপের ঘুম হয় না ঠিক করে।
আর তারপর একদিন……..
ওদের বাড়িতে বেশ বড় করে পুজো হল। অনেক লোক এলো। সব কাপেরা বারবার কাজে বেড়োতে লাগল।
কাপের আলমারিতে বসে কেটলি-দাদা একবার বলল – বাঃ কি দারুণ গন্ধ। আহা, মনে হচ্ছে যেন আমি একটু একটু ঠিক হয়ে যাচ্ছি।
যখন কেটলি-দাদা এই কথাগুলো বলল, তখন লাল কাপ আর ওর বন্ধু কালো কাপ কাছাকাছিই ছিল। কিন্তু তখন তো ওদের মধ্যে ভর্তি চা। কি করে কথা বলে? পরে সিঙ্কে বসে ওরা দুজনে আলোচনা করতে বসল। দুজনেরই মনে হল যে যখন কেটলি-দাদা ওই কথাটা বলেছিল তখন বাড়ির একজন মানুষ কর্পূর-দানিতে জ্বলন্ত কর্পূর নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল।
আলমারিতে ফিরে ওরা দেখল যে কেটলি-দাদা ঘুমিয়ে কাদা। লাল কাপ তো খুব খুশি। তবে বুঝি কেটলি-দাদার ঘুমের সমস্যা ঠিকই হয়ে গেল।
সকালবেলাও কেটলি-দাদা ঠিক সময়ে উঠে পড়ল।
ওটা কি গন্ধ ছিল রে, লাল কাপ? যেই শুঁকলাম, রাতে ঠিক সময়ে ঘুমোলাম আর সকালেও ঠিক সময়ে উঠলাম।
মনে হয় কর্পূর। – বলল লাল কাপ।
সেদিন রাতে কিন্তু কেটলি-দাদার চোখে ঘুম এলো না। বারবার নড়াচড়া করে। এই কথা বলে, সেই কথা বলে। ফলে লাল কাপের ঘুমের বারোটা বেজে গেল।
নাঃ। কেটলি-দাদাকে ঠিক করতেই হবে। না হলে আমি বেঠিক হয়ে যাব। – ভাবল লাল কাপ।
কাপেরা সিঙ্কে বসে, ট্রেতে বসে, আলমারিতে বসে এই নিয়ে আলোচনা করল।
সব চেয়ে বুদ্ধিমান কাপ (সাদা-সোনালি কাপ) বলল – এ বাড়ির ঠাম্মা ঠাকুরঘরে রোজ সন্ধেবেলা কর্পূর জ্বালায়। তারপর দরজা বন্ধ করে দেয়। তারপর সারা রাত ওই ঘরে কেউ যায় না। ঠাম্মা রোজ সন্ধে দিয়ে আমাতেই চা খায় তো। তাই আমি জানি।
তা কেটলিকে যদি রাতের সময়টুকু ওই ঘরে রেখে দেওয়া হয়, তাহলে ও বেশ খানিকক্ষণ কর্পূরের গন্ধ পাবে।
কথাটা সবার মনে ধরল।
কেটলি-দাদা তো এক পায়ে খাঁড়া। বলে হ্যাঁ, আমি এখনই ওই ঠাকুরঘরে যাব।
কিন্তু যাবেটা কি করে? আলমারিটা যে রান্নাঘরের স্ল্যাবের থেকে অনেকটা উপরে। একা একা নামবে কি করে? আর তারপর স্ল্যাব থেকে ঠাকুরঘরেই বা যাবে কি করে?
শেষে সবচেয়ে সাহসী কাপ (লাল-সোনালি-রূপালি কাপ) বলল – আলমারির দরজাটা তো খুিল। তারপর দেখি কি করা যায়।
তাই হল। রাতে মানুষরা ঘুমিয়ে পড়ার পরে লাল-সোনালি-রূপালি কাপ আলমারির দরজাটা খুলে ফেলল। যেই না খোলা, বাড়ির পোষা সাদা বেড়ালটা অমনি ছুটে এসেছে।
তা বেড়ালের সাথে কাপদের বেশ বন্ধুত্ব। বেড়ালকে সব কথা বলল কাপেরা। তখন বেড়াল বলল – আমি কেটলি-দাদাকে ঠাকুরঘরে নিয়ে যেতে পারি।
তারপর যে কি মজা হল, কি বলব তোমাদের।
রোজ রাতে, মানুষরা ঘুমিয়ে পড়ার পর বেড়াল কেটলি-দাদাকে ঠাকুরঘরে রেখে আসত। আর রোজ সকালে মানুষরা ওঠার আগে, বেড়াল আবার কেটলি-দাদাকে আলমারিতে দিয়ে যেত।
এই রকম পর পর পঁাচ দিন হওয়ার পর, কেটলি-দাদা সব্বাইকে বলল – আমি পুরোপুরি ঠিক হয়ে গেছি। তোমাদের সবাইকে মেনি থ্যাঙ্ক্স।
সেই শুনে কাপেদের কি হাসি। সেই রাতে বেড়ালকেও কেটলি-দাদা একই কথা বলল। বেড়ালেরও মুখ ভর্তি হাসি। বলল – এনি টাইম, কেটলি-দাদা। এনি টাইম।
যাই হোক, সেদিন রাতে কাপেরা আর কেটলি-দাদা আরাম করে ঘুমালো। আবার ঠিক সময়ে উঠেও পড়ল।
এর ঠিক পরেই বাড়ির এক মানুষের কেটলি-দাদার দিকে নজর পড়ল। বলল – দেখো বৌদি। এই কেটলিটা থেকে আগে কি বাজে গন্ধ বেরোতো না? এখন দেখো, কোনো গন্ধ নেই!
তাই তো – অন্যজন বলল।
এখন কিন্তু কেটলি-দাদা আলমারির সবচেয়ে ব্যস্ত লোক। সকাল থেকে সন্ধে পর্যন্ত সবাই কেটলি-দাদাতেই চা করে।
ভাবছ যে কেটলি-দাদা এতে খুশি নয়? আরে না না। কেটলি-দাদা কাজ করতে পেরে বেজায় খুশি। সে এখন রোজ সন্ধেবেলা ফিরে কাপেদের নতুন নতুন গল্প বলে। মাঝেমাঝে রাতে এসে বেড়ালও গল্প শুনে যায়।
এখন কাপেরাও খুশি। কেটলি-দাদাও খুশি। আর বেড়ালও খুশি।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।