মোরগ রাজাঃ পঞ্চম কিস্তী

এদিকে রাজা পাখতুন দ্বিগুন উৎসাহে যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। সমস্ত নাগরিকদের কে অংশ গ্রহনের আহবান জানালেন। রিফুজি ক্যাম্পে গিরিরাজ্যের পলাতক নাগরিকদের কে মোরগ রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিতে বলা হল। রিফুজি নাগরিকদের নিয়ে ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে রাজ্যময় ছড়িয়ে পড়ল। তারা দেশে দেশে ঘুরে ঘুরে মোরগ রাজের অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করতে লাগল। মোরগ রাজ যদি বিরিপুর আক্রমনে আসে তাহলে বিরিপুরেরর সোনার রাজ্য শ্মশান হয়ে যাবে। রাজ্যের কবিয়াল ও গায়কগণ গান গেয়ে বেড়াল। স্বদেশ প্রেমের বাণীতে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে পড়ল। গানে, বর্ণনায় মোরগরাজার হিংস্রতা ও নৃশুংসতা ফুটে উঠল। রাজ্যময় শুধু মোরগ রাজা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ, যুদ্ধ শব্দগুলির ধ্বনি প্রতিধ্বনি। প্রত্যেক গ্রামে প্রামে ট্রেনিং ক্যাম্প খোলা হল। রাজ্যজুড়ে শুধু লেফট-রাইট, লেফট; লেফট-রাইট, লেফট। এমনকি শিশুরাও ট্রেনিং ক্যাম্প এ হাজিরা দিচ্ছে নিয়মিত। শেষে রাজাকে বাধ্য হয়ে ফরমান জারি করতে হল তের বছরের কম বয়সীরা ট্রেনিং নিতে পারবে না, তাদের জন্য যুদ্ধ নয়।
এই পুরো যুদ্ধ কো-অর্ডিনেশনের দায়িত্ব রাজা আহলুন কে দিলেন। আহলুন সারা রাজ্য ঘুরে ঘুরে যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখতে লাগলেন। যুদ্ধের ব্যয় নির্বাহে বিপুল অর্থের প্রয়োজন। আহলুন নাগরিকদেরকে যুদ্ধ তহবিলে অংশ গ্রহন করতে বললেন। বিত্তবান গোষ্ঠি হতে হাতী, ঘোড়ার মজুদ বাড়তে চলল।
আহলুন চৌকষ যুবকদের নিয়ে একটা গোয়েন্দাবাহিনী গঠন করলেন। তারা গিরি রাজ্যে প্রবেশ করে মোরগ রাজার প্রস্তুতি সম্পর্কে খবর নিবে। আর তা পায়রায় সাহায্যে বিরিপুর পৌঁছে দিবে। প্রয়োজনে তারা মোরগ রাজার সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিবে। কাজটা খুবই কঠিন। আর ঝুঁকিপূর্ণ। সুতরাং বেছে বেছে সব সাহসী, বুদ্ধিমান, দক্ষ, অস্ত্র চালনায় পারদর্শী যুবাদের নিয়েই এই বাহিনী গঠিত হল। তার মধ্যে গিরিরাজ্য পলাতক অনেকেও ছিল। মৌরসী নামের এক অভিজ্ঞ উচ্চপদস্থ সেনা অধ্যক্ষকে গোয়েন্দাদের প্রধান নিযুক্ত করা হল। রাজ্যের সব ধর্মগুরু ও সাধকদের রাজপ্রসাদে ডকে পাঠানো হল। ধর্মগুরুরা আসলেও সাধকদের অনেকে আসেন নি। তাঁরা সাধারনত রাজপ্রাসাদ চাকচিক্য এসব হতে দূরে থাকতেই পছন্দ করেন। রাজা সারাদেশে সব নাগরিকদের নিয়ে যুদ্ধজয়ের জন্য বিশেষ প্রার্থনার অনুরোধ করলেন। এদিকে মৌরসি সর্বশেষ খবর পাঠালেন আগামী মাসে যেদিন সন্ধির দিন ঠিক করা আছে ঐ দিনই মোরগ রাজা অক্রমন করবে। কিন্তু সন্ধি করার জন্য লোকজন ঠিকই পাঠাবে। আহলুন নিশ্চন্ত বোধ করল। কারণ সব রকমের প্রস্তুতি সম্পন্ন। তারা বরং পালটা আক্রমন প্রত্যাশা না করেই আসবে। আর আমরাও সন্ধি নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাব।
কিন্তু আহলুন নিশ্চিন্ত হতে গিয়েও পারল না। এ মাত্র খবর এল মোরগ রাজার বিধ্বংসী মোরগের কথা। যারা সৈন্যদের চক্ষু উপড়িয়ে ফেলে। এ অদৃশ্য শত্রুর সাথে কিভাবে লড়বেন। আর মোরগ বাহিনীর কথা যা শোনা যাচ্ছে তাতে বিরিরাজের কোন খবরই গোপন থাকার কথা না। সুতরাং তাদের সাথে লুকোচুরি করে কোন লাভ নাই। ব্রং এ মোরগদের নিয়ে কি করা যায় তা ভেবেই পেলেন না। রাজা পাখতুনের সাথে আলাপ করে ও বিশেষ কোন কিছু বের করা গেল না। পাখতুন শেষে দরবার ডাকলেন। রাজসভার সব সভ্য সাথে পুরনো অভিজ্ঞ সেনা অধ্যক্ষদের ডাকা হল যারা এক আগে দেশের হয়ে যুদ্ধ করেছিল। সভায় তেমন কিছুই বের হল না। এধরনের অশরীর সাথে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা কারো নাই। একমাত্র অলৌকিক কোন সহায়তা ছাড়া কোন কিছুই এ থেকে পরিত্রাণ নেই। আর মোরগ রাজের কি পরিমান এ ধরনের মোরগ আছে তাও জানা নেই। কেউ অবশ্য লৌহ বর্মের কথা বললেন। কিন্তু সেনা বাহিনির হাতে যে পরিমান লৌহবর্ম আছে তা খুবই সামান্য। আর এ অল্প সময়ের মধ্যে এত গুলো বর্ম তৈরি করা সম্ভব না। তাছাড়া সৈন্য ছাড়া সারাদেশের মানুষই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব। তাদের বাঁচাবে কি দিয়ে? আপাতত রাজ্যের সব কামারদের বর্ম বানাতে নিয়োগ করা দরকার। সেখানেও সমস্যা আছে। যুদ্ধে ত শুধু বর্ম লাগে না। ঢাল, তলোয়ার, তীর-ধনুক, বর্শা এসবও লাগে। কামার সবাই সে কাজেই ব্যস্ত। বর্ম বানাতে গেলে অস্ত্র যোগানো, অস্ত্র তাজা করা এগুলোতে ভাটা পড়ে। এখন কি করে রাজা পাখতুন আর ভাবী রাজা আহলুন!
স্বস্তি মিলে না আহলুনের। অস্ত্রের লড়াই অস্ত্র দিয়ে, বুদ্ধির লড়াই বুদ্ধি দিয়ে। কিন্তু কালো শক্তিকে প্রতিহত করে কি দিয়ে? দুই দিন ভেবে ভেবে কোন উপায় করতে পারেনা আহলুন। বিক্ষিপ্ত মনে সেদিন বিকেলে রাজকুমারি শিরির সাথে দেখা করতে যায়। রাজকুমারিকে নিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়ে ছুটে যায় নদী কিনারে। আরবী ঘোড়ার খুরে ধূলো উড়ে যায়। গোধূলি বেলার উড়ন্ত ধুলির সাথে রাজকুমারির মনও উড়ে উড়ে যায়। মৃদু মন্দ বাতাস, নদীর শরীরে শেষ বিকেলের আলো আর কূলকূল ধ্বনি। এক অপার্থিব পরিবেশ। ছোট বড় নৌকা পাল তুলে দিয়েছে গন্তব্যে, কোন কোন নৌকায় কালছে নীল ধোঁয়া উড়ে গিয়ে মিশে যাচ্ছে যেন মেঘের সাথে। মাঝিরা রাতের খাবার তৈরিতে চুলা বসিয়েছে তারই জানান দিচ্ছে তারা। ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে এসবে তারা দুজন। এই দৃশ্য এই শান্তি এই সুখ কি হারিয়ে যাবে বিরিরাজ্য হতে। গলায় বিঁধে থাকা মাছের কাঁটার মত বারবার খোঁচা দিতে থাকে এই জিজ্ঞাসা। শিরি বুঝতে পারে।
– দেখো, আমার বাবা মহারাজ পাখতুন জেনেশুনে কোন অন্যায় করেন নি।কোন অন্যায়কে কখনো প্রশ্র্য় দেননি। প্রজাদের তিনি নিজের সন্তানের মত ভালবেসেছেন। আর বিরিরাজ্যের জনতা বিরিপুরকে মায়ের মতই ভালবাসে। এর আগে যতবার এই দেশ আক্রান্ত হয়েছে তা প্রমান হয়ে গিয়েছে। সে মোরগ রাজা হোক আর যেই এই বিপুল জনতার ভালবাসার কাছে তারা পরাজিত হবেই। সুতরাং অত ভেব না। আর এই যে দিন রাত এত সাধু সন্তরা এই জাতির কল্যাণে, বিপদ ভঞ্জনে প্রার্থনা করছে তাকে কি তুমি একেবারে নিস্ফল মনে করো?
– আমি তা মনে করি না শিরি। কিন্তু মোরগ রাজা ধূর্ত। নাম তার মোরগ রাজা হলেও সে শেয়ালের মতই ধূর্ত। তার সব কিছু মোকাবেলা করা গেলেও তার কালোজাদুর বিষদন্ত অদৃশ্য মোরগগুলোর মোকাবেলা কিভাবে করব ভেবে পাইনে। আমাদের গোয়েন্দা প্রধান মৌরসী খবর পাঠিয়েছে মোরগ গুলো নাকি মানুষের চোখ উপড়ে ফেলে। আর শত শত মোরগ যদি আমাদের রাজ্যে ছেড়ে দেয়া হয় আমাদের সৈন্যবাহিনি সাধারন জনতা এদেরকে রক্ষা করব কি দিয়ে।
– কি ভয়ানক কথা।
– হ্যা খুবই ভয়ানক কথা। মোরগ রাজা নিজের সৈন্যদের উপর এ পরীক্ষা চালিয়েছে। তার সামনে ফটাফটা চোখ উপড়ে ফেলেছে সৈন্যেদের। বেচারারা টেরও পায়নি। আমাদের উপর সে এই শক্তি যে কি নিষ্ঠুর ভাবে প্রয়োগ করবে বলায় বাহুল্য।
– আমার মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। শোন মোরগ রাজার শক্তি কালো। সে অন্ধকার ভালবাসে। অন্ধকার শক্তিই তার আরাধ্য। আমরা আলোর পথের যাত্রি। অন্ধকার মোকাবেলা করব আলো দিয়ে। সেই আলো টা কি। সেই আলো হচ্ছে আমদের জনগণ। দেশের প্রতি তাদের ভালবাসা। জনতার জন্য রাজার দরদ। তবে তোমাকে যা বলতে চাই তা হল আমাদের দেশে অনেক সিদ্ধপুরুষ আছেন। সে ত তুমি জানোই। তবে তাঁরা সাধারনত রাজদরবার, চাকচিক্য, লৌকিকতা হতে দূরে থাকতেই ভালবাসেন। আমাদের শেষ সীমায় সাধক পুরুষ মিম্রিনের দরবার আছে। তুমি তাঁর কাছে যাও।
হ্যাঁ অন্ধকার শক্তি প্রতিহত হবে তো আলোর সম্মুখে। আহলুন শক্তি খুঁজে পায় যেন। সেদিন রাজা অন্য সবার সাথে সাধুদের ডাকলেও মিমরিন আসেন নি। আহলুন গিয়ে হাজির হয় মিম্রিনের দরবারে। সাধুর দরবারে মিনতি করে দেশের নিরপরাধ সৈন্য ও নাগরিকদের জান মালের হেফাজতের কোন উপায় বের করতে। মিম্রিন বলেন তিনি অতি ক্ষুদ্র ব্যক্তি। তাঁর পক্ষে সম্ভব না কালো জাদুর প্রভাব কাটানো। তবে একটা উপায় আছে সে হল ইল্ল্যিন। এসময়ের সাধু সম্রাট ইল্ল্যিন। গভীর জঙ্গলে তাঁর আস্তানা। দিন রাত প্রার্থনা করেন। বনের পশুরাও তাঁর অনুগত। তিনি যখন ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করেন বনের পশুরাও বিমোহিত হয়ে শোনে! তাঁর কাছে যেতে হবে আহলুন কে। মিম্রিন পথ বাতলে দেন কিভাবে যেতে হবে। আর পথে হিংস্র জানোয়ারের কবলে পড়েন তাহলে শুধু বলতে হবে আমি প্রভু ইল্ল্যিনের কাছে এসেছি। নত মস্তকে পথ ছেড়ে দেবে জানোয়ার।
ইল্ল্যিনের আস্তানায় গিয়ে দোজানু হয়ে হাত জোড় করে মিনতি জানায় আহলুন। ইল্ল্যিন ভাবনায় পড়ে যান। আহলুনকে একরাত্রি অবস্থানের অনুরোধ জানান। রাত্রিবেলা ধ্যানে বসবেন ইল্ল্যিন।
পরদিন সকাল বেলা ইল্ল্যিন হাসি মুখে জানান চিন্তা। কালো রাজার কালো জাদু পরাজিত হবে। বনের সব শিয়াল গিয়ে ধরে খাবে মোরগদের। মোরগরা বিরিপুরে ঢোকার পর শিয়ালের কবলে পড়বে। শেয়ালরা আস্তে আস্তে লোকালয়ের দিকে যাওয়া শুরু করবে। আহলুন ফিরে এলেন নিশ্চিন্তে। রাজা নতুন ফরমান দিলেন এখন থেকে যুদ্ধ চলা কালিন সময় পর্যন্ত কেউ শেয়াল নিধন করতে পারবে না। শেয়াল কারো ক্ষতি করলে, মোরগ চুরি করলে সরকার তার দ্বিগুন ক্ষতিপূরণ দিবে। শেয়াল নিধন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ হল।

গল্পের ষষ্ঠ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!