মোরগ রাজের চরিত্র সম্পর্কে আমাদের যাদের কিঞ্চিত ধারনা হয়েছে তারা বুঝতে পেরেছি বিরিরাজ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে কি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন। প্রত্যাখ্যান সকলেরই ইগো তে আঘাত হানে। আর মোরগ রাজা যিনি মনে করেন যুদ্ধ বিগ্রহ, ক্ষমতা, শৌর্য বীর্য, হত্যা , দলন নিপিড়নই হল রাজপুরুষের ধর্ম তাঁর প্রতিক্রিয়া তো সকলের চেয়ে আলাদা হবে। তখনই তিনি বিরিপুরের রাজাকে উচিত শিক্ষা দিতে অভিযান শুরু করতে পারেন। কিন্তু মোরগ রাজা ঠান্ডা মাথার মানুষ। তিনি মেজাজ গরম করে কিছু করেন না। ঠান্ডা মাথায় বুঝে শুনে জয় নিশ্চিত করেই তিনি যুদ্ধে নামেন। বিরিরাজের মত কান্ডজ্ঞানহীন কাপুরুষকে গিরিরাজের পরিনতিই ভোগ করতে হবে। কিন্তু বিরিরাজ্য নিয়ে এপর্যন্ত যে খবর পাওয়া গেছে তাতে বিরিরাজ্য জয় অত সহজ নয়। বাস্তবিক অর্থে মোরগরাজ বিরিরাজ কে মনে মনে ভয় করতেন। তাই তিনি বিরিরাজ্য আক্রমনের চিন্তা আগে করেন নি। নিজে যথেষ্ট শক্তি সঞ্চয় ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করে তবেই হয়ত বিরিরাজ্যের কথা চিন্তা করতেন। আর বিরিরাজ্যের জগত বিখ্যাত রাজকন্যা হাতে পেলেতো বিরিরাজ্য এমনি হাতে আসছে। কিন্তু কান্ডজ্ঞানহীন বিরিরাজা মোরগ রাজার শৌর্যবীর্যের মূল্যালয় না করে অপমানিত করেছেন। আর কোথাকার নাম পরিচয়হীন কোন আহলুনকে ধরে এনেছেন রাজকুমারির জন্য। এই সব মেরুদন্ডহীন পুরুষ কিভাবে দিনের পর দিন রাজ্য চালায় তা বুঝে পান না তিনি। যে রাজপুরুষ রাজপুরুষের মর্যাদা বুঝে না তাদের হাতে রাজত্ব আসে প্রকৃতির কোন অবাক খেয়ালে কে জানে। প্রকৃতি খেয়ালি হতে পারে তবে মোরগ রাজা খেয়ালি নন। প্রকৃতির খেয়াল চূর্ণ করে বিরিরাজ কে উপযুক্ত শিক্ষা দিতেই হবে। বৃদ্ধ পাখতুনকে যেদিন তাঁর সামনে এনে কালো জাদুর ছোঁয়ায় তুর্কি নাচন নাচাবেন সেদিনই হবে তারঁ পৌরুষদীপ্ত প্রতিশোধের দিন। তাঁর বন্দীশালায় আরও এক রাজপুরুষের আগমন কল্পনা করে মনে মনে পুলক অনুভব করেন তিনি। মোরগ রাজা এ পর্যন্ত তাঁর হাতে বন্দী রাজাদের হত্যা করেন নি। গিরিপুরের রাজা এখনো বন্দী। রুন্ডির রাজা অবশ্য যুদ্ধেই মারা গেছে। রাজাদের বন্দী করে রাখাও তাঁর এক ধরনের খেলা। বিড়াল যেমন ইঁদুর ধরার পর কিছুক্ষণ খেলিয়ে বেড়ায়। রাজপুরুষ হত্যার চেয়ে বন্দীশালায় আর দশজন সাধারণ কয়েদীর সাথে রেখে নির্যাতন আর মাঝে মাঝে গিয়ে কান মলে দেয়ার মধ্যে আমোদ আছে। সে আমোদ রাশিয়ার লালপানি ভদকার মাঝেও নাই।
কিন্তু বিরিপুরের ব্যাপারটা রুন্ডি আর গিরিপুরের মত নয়। বিরিপুরের আছে সবচেয়ে সুশিক্ষিত আর চৌকষ সেনাবাহিনী। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করে তারা। এ পর্যন্ত যতবার বিরিপুর আক্রমন হয়েছে একবারও বিজয়ী হয়ে ফিরতে পারেনি কেউ। তার উপর আছে বিরিপুরের উদ্ভট জনগণ। বিদেশী আক্রমন হলেই তারা সৈন্যবাহিনির সাথে লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। বেকুবের মত জীবন দেয়। রাজায় রাজায় যুদ্ধ তোদের মত পোকা মাকডের দরকার কি এতে এসে পতঙ্গের মত জান দেয়ার। এদের কে নিজের আয়ত্তে আনতে পারলে উপযুক্ত শিক্ষা দিতে হবে। তার উপর আবার সীমান্তে পাহাড় ঘেরা। হয় পাহাড় ডিঙিয়ে যেতে হবে না হয় নৌপথে।
রাজা সেনাপ্রধান আর কালোজাদুর সর্দার কে নিয়ে মিটিঙে বসেন। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। সৈন্য সংখ্যায় বিরিপুর কে ছাড়িয়ে যেতে হবে তাঁকে। হস্থী বাহিনী আর অশ্বারোহি বাড়াতে হবে। এমন এক বাহিনী নিয়ে আক্রমন করবেন যে বিরিপুরের যেন আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায়। এমনিতেই সৈন্য সামন্ত, ঢাল-তলোয়ার, অস্ত্র-শস্ত্র, হাতী, ঘোড়ায় তিনি বিরিপুরের চেয়ে অনেক অগ্রগামী। এখন তো রুন্ডী আর গিরিপুরের বিশাল অস্ত্রভান্ডার, হাতীশালা, ঘোড়াশালা তাঁর হস্তগত হয়েছে। প্রয়োজনে রাজ্যের সব হাতী ঘোড়া বাজেয়াপ্ত করে যুদ্ধে নিয়োজিত করতে আদেশ দেন রাজা। আর রুন্ডি এবং গিরিরাজ্যের সব যুবাপুরুষদের দিয়ে সৈনাবাহিনীর কলেবর বাড়াতে বলেন রাজা। মোরগ রাজের সেনাবাহিনীতে সুযোগসুবিধা সবসময়েই ভাল। রাজা জানেন যে গরু দুধ দেয় তাকে তাজা ঘাস খেতে দিতে হয়।
কিন্তু সবার উপরে রাজার বিশেষ সুবিধা হল তাঁর মোরগ বাহিনী। বিরিরাজা সব মোকাবেলা করতে পারলেও তাঁর মোরগ বাহিনী আর তাদের কালো জাদু মোকাবেলা করবে কি উপায়ে? অন্যরাজ্যের যত গোপন খবর, বিপক্ষ শিবিরে কি হচ্ছে সব গোপন খবর মোরগরাই দ্রুত নিয়ে আসে। যুদ্ধক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা বেশি বই কম নয়। তবে মোরগ বাহিনী নিয়ে রাজা কিঞ্চিত চিন্তিত। গিরিরাজ্য দখলে প্রায় অর্ধেক মোরগ শেয়ালের পেটে গেছে। পাহাড়ি বনাঞ্চল ঘেরা রাজ্যে এত শেয়ালের উৎপাত হবে আগে বুঝতে পারেন নি রাজা। তাহলে হয়ত সাবধান হওয়া যেত। এদিকে মোরগ সর্দার জানাল নতুন করে জাদু নেয়ার উপযুক্ত মোরগ নাই। কিন্তু রাজা বললেন এখন সংকট মুহূর্ত। নতুন মোরগে জাদু লাগাও। এত নিয়ম কানুন মানা যাবে না। নতুন মোরগে জাদু লাগালে দেখা গেল আরেক বিপত্তি। জাদু প্রাপ্তির সাথে সাথে বিকট শব্দ করে পেট ফেটে মারা যাচ্ছে সব। রাজার মেজাজ বিগড়ে গেল। কালো জাদুর সর্দারকে বললেন নতুন উপায় বের কর। নাহলে নিস্তার নাই।
নতুন উপায় বের হল। দিন রাত পরীক্ষা নিরীক্ষা করে জাদুকর রা এক অভিনব জাদু উদ্ভাবন করলেন। জাদু দেয়া মোরগ সাধারন মানুষ দেখতে পায় না সে তো আমরা জানি। এই সুযোগে মোরগরা যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে সৈন্যদের কে নানা ভাবে ঠোকরিয়ে আঁচড়িয়ে বিভ্রান্ত করতে চেষ্টা করত। আর বিপক্ষে আক্রমনের শিকার হত সৈন্যরা। এখন মোরগরাই করবে যুদ্ধ। এই নতুন জাদু করার পর মোরগরা সৈন্যদের মাথার উপর দাঁড়ীয়ে তাদের চোখ উপড়ে ফেলতে পারবে। অথচ সৈন্যটি আগে টেরও পাবে না। এই মাত্র মোরগ রাজার সৈন্য বাহিনীর মহড়া ক্ষেত্রে জাদুর তীব্রতা পরীক্ষা করা হল। দশটা মোরগ ছেড়ে দেয়া হল। আর মহড়ারত দশজন সৈন্য টেরও পেল না কিভাবে তাদের চোখ দুটির কি হল। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে চোখ দিয়ে। রাজা নিজে প্রত্যক্ষ করলেন বিষয় টা। তিনি নিশ্চিন্ত। বিরিপুরে কোন সাধ্যই নেই তাঁর সামনে দাঁড়ায়। মোরগদের নিরাপত্তা বিধানে রাজা শেয়াল নিধন কর্মসূচী শুরু করলেন। শেয়াল মারতে গিয়ে সৈন্যদের কেউ কেউ বাঘের পেটে গেল। আর শেয়ালরাও দলে দলে বিরিরাজ্যে ছুটল।
কিন্তু রাজা নিশ্চিন্ত হতে চাইলেও মশা মাছি নিশ্চিন্ত হতে দেয় না। গিরিপুরে যুবাদের একশ্রেণী যুদ্ধে যেতে অস্বীকার করছে। যারা তাদের রাজ্য দখল করেছে তাদের সর্বস্ব লুট করেছে তাদের পক্ষে নয় বিপক্ষেই অস্ত্র ধরতে চায় তারা। রাতের আঁধারে দলে দলে এই অপদার্থের দল বিরি রাজ্যে চলল। সীমান্তে চৌকি বসানো হল। গিরিপুর হতে বিরিপুরে যাতায়াত সর্বধরনের যোগাযোগ নিষিদ্ধ হল। যারা পালিয়েছে তাদের পিতামাতা, আত্মীয় স্বজনকে সৈন্যরা ধরে নিয়ে গেল। বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেয়া হল। কোন ধরনের অবিমৃশ্যকারিতা মোরগরাজের পছন্দ নয়।
গল্পের পঞ্চম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।