মোরগ রাজাঃ তৃতীয় কিস্তী

বিরিপুর ছবির মত রাজ্য। একদিকে পাহাড় আর দিকে সমুদ্র। রাজ্যের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে আছে রাজপ্রাসাদ, রাজদরবার। কেন্দ্র থেকে চারদিকে চলে গেছে চারটি রাস্তা। রাস্তার দুপাশে বৃক্ষের সারে। মাঝে মুসাফিরখানা, পানির কূপ। এই মহাসড়কগুলো থেকে ভেতরেরদিকে রাজ্যের জনবসতি। উর্বশী শস্যক্ষেত। এরাজ্যে সোনার খনি নেই, কিন্তু এর শস্যক্ষেত গুলো যেন সোনার ভান্ডার। বিরিরাজ পাখতুন বয়োবৃদ্ধ, জ্ঞানী, ধার্মিক। বিরিরাজের শাসন প্রণালী আর দশটা রাজ্যের চেয়ে আলাদা। রাজ্যের প্রিতিটি জনবসতিতে রয়েছে একটি করে পাঠশালা আর একটি দাওয়াখানা। বারো বছর পর্যন্ত সবার এই পাঠশালায় আসা বাধ্যতামূলক। পাঠশালার পন্ডিতরা সরকারি খরচে লালিত। দাওয়াখানায় সরকারি খরচে আছে হেকিম কবিরাজ। দিন রাত সেখানে চিকিৎসা সেবা আর খুটুর খুটুর গুটুর গুটুর করে দুনিয়ার লতাপাতার শ্রাদ্ধ। রাজা মাঝে মাঝে নিজে এসে পাঠশালা দেখে যান। শিশুদের সাথে সময় কাটান। তাদের সাথে হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেন। যদিও রাজার এক সুবিশাল সৈন্যবাহিনী আছে তবুও ষোল থেকে পঁচিশ বছর বয়সী সবার জন্য সামরিক ট্রেনিং নেয়া বাধ্যতামূলক। এখানে ফসলী জমির ব্যবস্থাও চমৎকার। প্রত্যেক গ্রামে একদিকে বসতি আর দিকে ফসলি ক্ষেত। সবাই একসাথে চাষকরে। কার কি দায়িত্ব ভাগ করে দেয়া আছে। ফসল কাটার সময় রাজকোষের জন্য এক হিস্যা রেখে বাকিটা সমান ভাগে ভাগ হয়। এই সব কিছুই তদারকি করার জন্য প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে সরকারি লোক আছে। যে সমস্যায় যেকোন লোক সরাসরি রাজদরবারে চলে যেতে পারে। রাজদরবারে আছে রাজার উপদেষ্টা বাহিনী – পন্ডিত, বৈজ্ঞানিক, চিকিৎসক, ধর্মশাস্ত্রবিদ, কৃষক, সাধু সব পেশার মানুষ। রাজকণ্যা শিরি। রাজকণ্যা বলতে আমরা যা বুঝি রূপলাবণ্য, সৌন্দর্য সবই আছে তাঁর। আর যা বেশি আছে তা হল রাজার মত উদারতা আর ধর্মবোধ। সামনে বছর রাজকণ্যার বিয়ে হবে আহলুন এর সাথে। আহলুন চৌকষ আর জ্ঞানী। অনেক পরীক্ষা নীরিক্ষা র পর রাজা স্থির করেছে আহলুনই রাজকণ্যার সর্বাধিক হকদার।
আমাদের এ আলোচনা থেকে আমরা বুঝতে পারি বিরিপুর রাজ্য একটি সুখি পরিবারে মত এবং বহুবছর ধরে তাদের জীবন সুখেই যাচ্ছিল। পাহাড়ে ঘেরা হওয়ায় বড় রকমের বহিঃ আক্রমনের শিকার তারা হয়নি। টুকটাক যারা নজর দিয়েছিল তাদের ভালই শিক্ষা দেয়া হয়েছিল। সব সুখী পরিবারে যেমন নিরবিচ্ছিন্ন সুখ থাকে না মাঝে মঝে কালো মেঘ দেখা দেয় তেমনি বিরিরাজের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ল। পাশে গিরিরাজ দখন করেছে কুখ্যাত মোরগ রাজা। দলে দলে লোক সেখান থেকে আশ্রয় নিচ্ছি রিরিপুরে। এখানে আশ্রয় শিবির খোলা হয়েছে, তাদের কে রাজকোষ হতে খাদ্য পানি চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে। এখন গিরিরাজ্য দখলের পর এখন শয়তান মোরগ রাজা যদি এদিকে হানা দেয়? রাজা তাঁর উপদেষ্টাদের নিয়ে বৈঠক করলেন। সকলে স্বীকার করলেন মোরগ রাজার এদিকে নজর দেয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সুতরাং আমাদের আগাম প্রস্তুতি নিয়ে রাখাই ভাল। শুরু হল যুদ্ধের প্রস্তুতি পর্ব। প্রস্তুতির প্রারম্ভে গিরিরাজ্যের বিজিত পলাতক নাগরিকদের কাছ থেকে রাজা তাদের দুঃখের কাহিনী শুনলেন। শুনলেন যুদ্ধের কাহিনী। কিন্তু কোনভাবেই বুঝতে পারলেন না অদৃশ্য মোরগ আক্রমন ঠেকাবেন কি করে। সেনাপতি বললেন শেয়ালই হতে পারে এর একমাত্র ওষুধ। তা ঠিক কিন্তু শিয়াল তো আর শিকারি কুকুর না যে আমাদের ইচ্ছেমত ব্যবহার করা যাবে। তবে এখন থেকে সব রাজপরামর্শ সভা রুদ্ধদ্বার হবে। মাঝে গিরিরাজ্যের পলাতক পন্ডিতদেরও রাজ সভায় ডাক পড়ল।
এর মাঝে ঘটল এক অভাবনীয় ঘটনা। মোরগ রাজার দূত নানা রকমের উপঢৌকন সমৃদ্ধ হয়ে বিরিরাজের সাক্ষাৎ প্রার্থী। রাজদূতের সাথে সৌজন্য সদাচারণ রাজকূটনীতির অংশ। সুতরাং রাজসভায় দূতের ডাক পড়ল। দূত তার আপন রাজের নানা গুণকীর্তন করে বলল গিরি রাজ্যের অত্যাচারী শাসকের বিদায় হয়েছে। গিরিরাজের জনগন মহাসৌভাগ্যবান যে তারা মহান মোরগরাজের সুদৃষ্টিতে পড়েছে। এখন মোরগরাজ আর গিরিরাজ প্রতিবেশি। গিরিরাজের মত প্রতিবেশিকে মোরগ রাজ শ্রদ্ধা ও ভাতৃত্যের দৃষ্টিতে দেখেন। মোরগ রাজা তাই বিরিরাজের সৌহার্দ্য সন্ধির প্রস্তাব নিয়ে পাঠিয়েছেন। এতে দুই প্রতিবেশি শান্তিতে রাজকার্য পরিচালনা করবেন। পারষ্পরিক সহযোগিতার হাত বাড়াবেন। নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ বিগ্রহে জড়াবেন না। আর মোরগ রাজের দ্বিতীয় প্রস্তাব হল তিনি বিরিরাজ ও রাজকণ্যা শিরির গুণগ্রাহী। তাই তিনি রাজকণ্যা শিরির পাণিপ্রার্থী। রাজা বললেন তোমার প্রথম প্রস্তাব নিয়ে আমরা আমাদের সভাসদদের নিয়ে আলোচনা করব। তার পর এ নিয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। তোমার দ্বিতীয় প্রস্তাব সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য হচ্ছে আমাদের রাজকণ্যা শিরি ইতোমধ্যে একজনের বাকদত্তা। সুতরাং এ প্রস্তাব এখন অর্থহীন। অবশ্য মোরগ রাজার মত নিকৃষ্ট জীবকে তাঁর কণ্যার পাশে দেখতে তিনি যে কি পরিমান ঘৃণা করেন সেটা আর বললেন না। সন্ধির ইস্যুতে পরদিন সিদ্ধান্ত জানানো হবে ।
রাজ সভায় সকলেই মনে করলেন এটা মোরগ রাজার এক ধরনের ফাঁকিবাজি। তার মত ধূর্ত দুশ্চরিত্রকে বিশ্বাস করার কোন কারণই কেউ খুঁজে পেলেন না। রাজা বললেন আমারও তাই ধারনা। তার সাথে আমরা যদি সন্ধি করি অথবা না করি দুই ই সমান। তবে আমরা এখনো যুদ্ধের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত না। এ ক্ষেত্রে আমরা তার সাথে সন্ধি নিয়ে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে পারি। একই সাথে আমরা যুদ্ধের প্রস্তুতিও সম্পন্ন করি। সে যদি সন্ধি ভঙ্গ করে তাহলে আমরা অপ্রস্তুত হব না। সে সম্ভবত সন্ধির আড়ালে আমাদের অপ্রস্তুত রেখে আক্রমন করতে চায়। আমরা তার সাথে সন্ধি নিয়ে আগালে সে হয়ত ধরে নেবে আমরা যুদ্ধের কথা ভাবছি না। সে আক্রমন করলে কোন প্রতি আক্রমন সে প্রত্যাশা করবে না। আদিক থেকে আমরা তাকে অপ্রস্তুত করে দিতে পারি। দূত কে জানানো হল আমরা সন্ধি করতে প্রস্তুত। সন্ধির দিন তারিখ বিষয়বস্তু ঠিক ঠাক করার জন্য পরবর্তি এক তারিখ ঠিক করে দূত চলে গেল।

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!