তিনটি কঙকাল ও আমরা (যুদ্ধ বিষয়ক গল্প)

সোনার জমিনে সোনাঝরা ধান, হাওয়া ঘাতে দুলে-ওঠা প্রাণ, সাত-পুরুষের রক্ত-রক্ত খেলা, বিলের জলে জলপরীদের জলগাহন বা শুক্লা যামিনীর ধবল ছায়ায় অপশরীদের নৃত্যকলা বিষয়ক আরো-আরো পৌরাণিক উপাখ্যান আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকলেও এবারের অনুষঙ্গ খানিকটা অন্যরকম- অন্তত আশরাফের কাছে তো বটেই! তাই আর অপেক্ষা করেনা; নৈঃশব্দের বুকে পদাঘাত করে ধপাধপ পা চালায়; বুনোফুলের ঘ্রাণ মেখে নির্জনতার আরো গভীরে হারায়। থেমে নেই ঝিঁঝিঁ পোকারাও- তাদের নিরবিচ্ছিন্ন চিৎকারে সৃষ্ট সুরের ইন্দ্রজাল অনেক দুর পর্যন্ত তরঙ্গায়িত হয়; একটু-একটু করে অসাড় হতে শুরু করে ইন্দ্রীয়সমূহ; থেমে যেতে চায় জীবনের সব কোলাহল।

বাঁশবাগানের পথ মাড়াতেই নিজেকে ভরহীন মনে হয়; মনে হয় অসীম শূন্যতায় পৃথিবী বুঝি পেন্ডুলামের মতো দোল খাচ্ছে! মনে হয় মেঘের ওপারে ফুটে-থাকা নক্ষত্রগুলো শিশিরপায়ে টুপটাপ নেমে আসবে! এক-একবার চলার গতি থামিয়ে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আশরাফ সামনে-পিছনে তাকায়; শরীরের মধ্যে শীতল রক্তের প্রস্রবন বয়ে যায়; শ্বাস-প্রশ্বাসের গতিবেগ দ্রুত ওঠানামা করে তখন। অথচ এখন পর্যন্ত মন্ডল নির্ভীক; সময়ের সাথে পাল্ল¬া দিয়ে তার মন্ডলীপনা ক্রম উর্ধ্বমুখী।

খুবই বদঅভ্যাস; কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ব্যাটা বোধহয় জানেনা। উপান্তর না দেখে আশরাফ নিজেই তাকে ধমক দেয়, চুপ শালা; তোক না বুললাম আজুড়ি বকপি নি।
লজ্জিত হওয়ার ভঙ্গিতে মুখ নিচু করে মণ্ডল হাত কচলায়। কিন্তু বিপ্লবীদের একজন আশরাফের বিরুদ্ধে মন্ডলের হয়ে ওকালতি করে, আশরাফ, মন্ডলকে বকছো কেন, ওকেও বরং ধন্যবাদ দাও। সে যদি ইঁদুরের গর্তে ধানের খোজে না আসতো; যদি কোদাল দিয়ে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি না করতো, তবে আরো কিছুকাল আমরা হয়তো অনাবিস্কৃত থেকে যেতাম।

কথাটা অবশ্য মিথ্যে নয়; ধান কুড়াতে গিয়ে মন্ডলই প্রথম মানুষের কঙ্কাল তিনটি আবিস্কার করে- তিন মুক্তিযোদ্ধার কঙ্কাল। আশরাফের মুখে তবুও বিষণ্নতার ছাপ; বেফাঁস কিছু উগরে গেলেই বিপদ; তাছাড়া অদৃশ্য ইঙ্গিতে ঘাড় মটকে যাওয়ার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিতে পারেনা। অন্য একজন বিপ্ল¬বী তাকে আস্বস্থ করে, ভয় নেই আশরাফ, তুমি নিজেও খুব সাহসী; ছিঁচকে চোর-ডাকাতের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আমাদের দেখতে আসার জন্য, সুখ-দুঃখের কথা শোনার জন্য তোমাকেও ধন্যবাদ।

ফাঁকা জনশূন্য মাঠ; দৃষ্টির সীমানাজুড়ে কেবল ঝাপসা অন্ধকার। এর মাঝেও ঝোপের আড়ালে জ্বোনাকীরা আলোর পশরা সাজিয়ে বসেছে। বালিয়াড়ির বুক থেকে ভেসে আসে অভক্ত শিয়ালের আর্তনাদ।
আশরাফ ও মন্ডল পাশাপাশি অবস্থান নেয়। চোখে-মুখে রাজ্যের কৌতূহল; সম্মুখেই পড়ে আছে সদ্য উদ্ধারকৃত তিন বিপ্লবীর ধুলিধূসর কঙকাল। তীব্র শীতের মাঝেও শরীর দিয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করে। আশরাফের অন্তর বাহিরে তোলপাড় শুরু হয়। কঙকালত্রয়ীর হারানো আতœা যেন শূন্য খাচায় ফিরে এসেছে! ৭১;র পূর্বের মতোই স্বাভাবিক আলাপচারিতায় মুখর হয়ে ওঠে।

ভিটকুমুরীর ভিটি হয়ে চণ্ডিদের পূজোমণ্ডপ, পালবাড়ির জলসাঘরে নূপুর-পায়ে নন্দিনীর নাচ, স্রোতের উজানে ঝাঁকবেঁধে ছুটেচলা পুঁটিমাছ, ভাটির টানে বেয়ে চলা কলার ভেলা, তালপুকুরের অথৈই জলে ডুবসাঁতার, পোড়ামাটির গন্ধ মেখে হাহাকার- সব, সব ছবি জীবন্ত হয়ে ওঠে!
বিপ্ল¬¬বীদের ছাপিয়ে আশরাফের গোপন ইঙ্গিত; মন্ডলকে চুপ থাকার নির্দেশ দেয়। মন্ডল নিজেও তার ভুল বুঝতে পেরে আরেক দফা লজ্জিত হয়। কান ধরে বার কয়েক উঠবস করে। একগাল হেসে আশরাফকে বলে, ঠিক আচে ভাইজান, ইবার তালি উণাগের সাতে কতা বোলেন।
আশরাফ খানিকটা নড়েচড়ে বসে; বস্তুত হারানো আত্ববিশ্বাস ফিরিয়ে এনে নিজেকে ধাতস্ত করার কশরত। বার কয়েক ঢোক গিলে বিপ্লবীদের কাছে জানতে চায়, হ, ইবার তালি আপনাগের সম্পক্কে কিচু বোলেন।
বিপ্লবীদের মধ্যেও দ্বিধা। আশরাফের বক্তব্য অস্পষ্ট; পৌষের হিমছড়ানো সন্ধ্যার মতো ধুয়াশা। বিষয় নিশ্চিত হতে তাই জিজ্ঞেস করে, কি জানতে চাও আশরাফ?
– পেত্তমে আপনাগের নাম-ঠিকানা, বাড়ি-ঘর।

বিপ্লবীত্রয় একে অন্যের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে; অত:পর থেমে থেমে নিজ-নিজ পরিচয় দেয়, আমি রাম, খাঁটি ব্রাহ্মণপূত; কুষ্টিয়া জেলার এক অখ্যাত পল্ল¬ীতে জন্ম। যুদ্ধের সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু ২৫ মার্চের পর থেকে আর সবার মতো আমার জীবনের গতিপথও সম্পূর্ণরুপে বদলে যায়। একদিকে শিকল পরানোর পায়তাঁরা, অন্যদিকে শিকল ভাঙার গান। লাল রক্তে বিবর্ণ হয় স্বপ্নের চিলেকোঠা। গণহত্যার ঐ দৃশ্য আজো ভুলতে পারিনা, পলে-পলে দগ্ধ হই; ভয়ে শরীরের লোমগুলো কুঁকড়ে ওঠে।
মণ্ডলের কণ্ঠে আক্ষেপের ব্যঞ্জনা, উরি আল্লা, আপনি তো তালি বিরাট বড় ডাক্তার হোতেন; কাড়ি-কাড়ি ট্যাকা কামাতেন!
মণ্ডলের কথা রাম কানে তোলেনা; কিংবা তার কর্ণকুহরে পৌছায়ই না। কথার মাঝপথে বেচারা আনমনা হয়ে ওঠে। স্মৃতির ডানায় ভর করে ঐসব দিনগুলোতে ফিরে যায়, ফিরে আসে। যুদ্ধের বিভিষীকা যেন স্পষ্টই তার চোখে খেলা করে, সে এক বিভিষীকাময় রাত; চারদিকে গগণবিদারী আর্তনাদ। লক্ষভেদী বুলেটগুলো শকুনের মতো ঝাঁকবেঁধে ছুটতে লাগলো। রাজপথের কালো পিচে রক্ত আর রক্ত; যেন উষ্ণ রক্তের প্রস্রবন। রাতের আচলে আমি গা ঢাকা দিলাম। দিন কয়েক ঢাকা শহরের অলি-গলি চষে বেড়ালাম। শহরময় শুধু লাশের স্তুপ। ঐ এক রাত্রেই ঢাকা শহরে খুন হয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার নিরস্ত্র বাঙালী।
সুরেলা কণ্ঠে অন্য আরেকজন মুখ খোলে, আমি রহিম; খন্দকার আব্দুর রহিম। চুয়াডাঙ্গার এক অভিজাত বংশে জন্ম। আমি নাকি মধুর স্বরে কোরআন তেলওয়াত করতে পারদর্শী ছিলাম। আপনপর ছিল না; মানুষের বিপদে-আপদে বুক আগলে দাঁড়াতাম, নানামুখী সহযোগিতা করতাম। আর এ কারনেই লোকজন আমাকে বাহবা দিত, দাওয়াত করে খাওয়াতো। কেউ-কেউ আবার টুপি, জায়নামাজও উপহার দিত। আজো মনে পড়ে, কত মানুষের জানাযায় ইমামতি করেছি; অথচ আমার মরনে জানাযা হয়নি!

এবার তৃতীয়জনের পালা; তবে তার কণ্ঠে কোনো আড়ষ্টতা নেই, আমি জন; মুজিবনগরের খৃষ্টানপল্ল-ীতে জন্ম। ধর্মের শিকল আমায় আটকাতে পারেনি; তাই মানব সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলাম। কিন্তু বেশিদূর এগুতে পারিনি।
জনের চোখেমুখে খুশির উচ্ছ্বাস; কণ্ঠে পরিতৃপ্তির ঢেঁকুর, আমি বড় ভাগ্যবান আশরাফ; প্রবাসী সরকারের শফত অনুষ্ঠানের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম। তুমিই বলো, এমন ভাগ্য ক’জনের হয়!
বস্তুত: যুদ্ধের দিনগুলোতে ঐ সুখটুকুন তার জীবনে ভিন্নমাত্রার প্রণোদনা যুগিয়েছিল। পরিচয় দিতে গিয়ে আত্মবিশ্বাসে বুকটা আরো বেশি প্রশস্ত হয়ে যেত, এক-একসময় মনে হতো যুদ্ধটা তার নিজের।
নিজের পরিচয় দিতে এবার আশরাফ উঠে দাঁড়ায় কিন্তু চোখের ইশারায় রাম তাকে বাধা দেয়, তোমাকে আমরা চিনি আশরাফ- সাংবাদিকতায় মাত্রই হাতেখড়ি; তবে অনুরোধ করছি, হলুদ সাংবাদিকতা নয়; মুক্তিযোদ্ধা রাজাকারের মত সাংবাদিক সমাজও আজ দলে-দলে বিভক্ত, হীন স্বার্থের জন্য একে-অন্যের সাথে কাঁদা ছোঁড়া ছুঁড়ি করে। জাতীর জন্য এটা খুবই লজ্জাজনক, কলঙ্ক।
মাথা চুলকাতে-চুলকাতে এবার মণ্ডল উঠে দাঁড়ায়; স্বপ্রণোদিত হয়ে নিজের পরিচয় দেয়, ছ্যার, আমি মন্ডল; খালি নামডাই মণ্ডল, সুংসার-টুংসার, বৌ- ছেলিমেয়ি কিচ্চু নি, ভইরদিন টো-টো করি ঘুরি বেড়াই।
একটা বিষয় আশরাফ লক্ষ্য করে, মণ্ডলের কাথাবার্তায় আজ ভিন্নমাত্রা যোগ হয়েছে। বিপ্লবীদের সংস্পর্শে যেন নতুন কোন মানুষ সে!
– ভাইজান, চা’র অডার দেবো নাকি? আইচ্চা তুমিই বোলো,চা না হলি মজমা জমে, নাকি কতায় রসকস বসে!
বিপ্ল¬¬বীত্রয় সমস্বরে হাসাহাসি করে। মন্ডলের ব্যাপারে আশরাফকে পরামর্শ দেয়, আশরাফ, মন্ডলের বিয়ের ব্যবস্থা করো। নারী ছাড়া বয়স্ক পুরুষ খুবই অসহায়। তাছাড়া তোমারও বয়স হয়েছে; সময়কালে বিয়ে না করলে অনেক ঝামেলা, অল্পবয়সী মেয়েরা পদে-পদে লাঞ্চিত করে, চুলের দৈন্যদশা তাদের হাসির খোরাক যোগায়।

বাতাসের ডানাছুয়ে নাসিকায় হাস্নাহেনা, চন্দ্রমল্লিকার সুগন্ধ লুটোপুটি খায়। একযোগে ঝিঁঝি পোকার নিস্তব্ধতায় বাতাসের বুকে মিহিসুরের হাহাকার। বটের পাতা ছুয়ে নেমে আসা ফোঁটা-ফোঁটা শিশির কণাসমূহ যেন কাচা রক্তের ঝর্ণা!
বিপ্ল¬বীদের সংখ্যাতাত্ত্বিক জটিলতায় আশরাফের মনের মধ্যে উচাটন। তিনজন কেন; নাকি আশেপাশে আরো কেউ ঘুমিয়ে আছে!
সংশয় দুর করতে আশরাফ জিজ্ঞেস করে, আইচ্চা, আপনারা খালি তিনজন ক্যানে; সাতে আর কেউ কি ছিলু না?
বিপপ্লবীদের মুখ থেকে টুক করে দীর্ঘশ্বাস ঝরে পড়ে, সে আরেক করুণ ইতিহাস। মূলত ১৪ জনের প্রশিক্ষিত একটি দল ছিল আমাদের। খেয়ে না খেয়ে, বৃষ্টিতে ভিজে দেশের জন্য লড়াই করতাম। কিন্তু অসর্তক মূহুর্তে একদিন রাজাকার সমৃদ্ধ পাকবাহিনী অতর্কিতে আমাদের হামলা চালায়; যতক্ষণ গোলাবারুদ ছিল বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিলাম, তারপর গ্রেফতার হই। ওরা আমাদের গুলি করে হত্যা করে, তারপর বেয়নট দিয়ে নির্মমভাবে খোঁচায়। শরীরের অঙ্গগুলো টুকরো-টুকরো করে কাটে। সোনাকান্দরের এই বিলের মাঝে আমাদের কে পুঁতেছিল জান ?
উদ্বিগ্ন মুখে মন্ডল জিজ্ঞেস করে, কিডা?
– তোমাদের গ্রামের মাতবর ফজল উদ্দিন ভরসা।
মাতবরের নাম শুনে মণ্ডলের মুখে ছিছি রব ওঠে, হাদেদা, এসব কি বুলচেন! শালার দিলি কি রহম নি, নাকি শালার কুনু মা-বুন নি!
মন্ডলের মতো আশরাফও হতবাক; এই সত্যিটা মেনে নিতে তার কষ্ট হয়, কিন্তু সে তো একজন মুক্তিযুদ্ধা, দ্যাশের জন্যি নাকি যুদ্দুও করিচে! তাছাড়া, বিপদে-আপদে আমরা তাক ভরসা করি।
রহিম কাধ ঝাকিয়ে বলে, হ্যাঁ ভাই, আমরাও ভরসা করেছিলাম, কিন্তু জীবন দিয়ে বুঝতে পারলাম ব্যাটা ছিল গুপ্তচর, পাকবাহিনীর দালাল।
ঘৃণায় আশরাফের মনটা রিঁ-রিঁ করে। দেশে এই ফজল উদ্দিনদের সংখ্যা কত, তাদের বিচার কবে হবে, মেঘের পর্দা সরে কবে উন্মোচিত হবে তাদের মুখোস!
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক খন্ড-খন্ড চিত্র তার মনের পর্দায় উঁকিঝুঁকি মারে। রাজনৈতিক মঞ্চের বড়-বড় বুলি আর দেশপ্রেম নিয়ে সংশয় জাগে। জনগনকে দেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্র“তি কেবলই কথার কথা; শুভঙ্করের ফাঁকি। কারো মধ্যে ন্যূন্যতম শিষ্টাচার নেই। একদলের পূজি ধর্মনীতি অন্যদলের মুক্তিযুদ্ধ। সমাজতান্ত্রিক দলগুলোও বড়-বড় বুলি ছাড়া আর সবকিছু বিসর্জন দিয়ে ফেলেছে। আশরাফ এবার প্রসঙ্গ বদলায়, আইচ্চা, আপনাগের বাকি ১১ জন সম্পক্কে কিচু কবেন; তারা একুন কনে?
বিপ্ল¬বীরা ক্রুদ্ধ মেজাজে বিদ্রুপ করে, এই মিয়া, তুমি কি মূর্খ; দেশের কোন খবর রাখো না!
ঘটনার আকস্মিকতায় আশরাফ ঘাবড়ে যায়। থরথরিয়ে পা কাপে। গলা দিয়ে ঠিকমতো কথা সরে না। তবু কাপা-কাপা গলায় জিজ্ঞেস করে, ক্যা-ক্যানো!
বিপ্ল¬বীরা প্রত্যয়ী কণ্ঠে বলে, কেন আবার, ঐ ১১ জন তো এখন মুক্তিযুদ্ধের জীবন্ত ইতিহাস; ওদের নিয়েই যত গল্প, কবিতা, সিনেমা; বিশেষ-বিশেষ দিনে “ওরা এগারোজন” সিনেমাটি প্রদর্শন করলেই আমাদের প্রতি তোমাদের সব দায়িত্ব শেষ!
কিছুক্ষণ থেমে পুনরায় জন বলে, কি আশরাফ, ভুল বললাম নাকি?
মন্ডলের মাথায় নতুন পরিকল্পনা খেলা করে; কঙকালগুলোর জন্য মায়া অনুভূত হয়, ভাইজান, উঁনাগের লাগি কিচু একখান কল্লি হয় না?
আশরাফ নিজেও কথাটা বিবেচনা করে, হ, আপনাগের লাগি আমরা এমন কি কত্তি পারি?
– কি করতে চাও আশরাফ?
– ভাবচি, মুক্তিযুদ্ধু যাদুঘরে নি’যাবো চিরকাল থাকার ব্যবুস্থা কোরবু।
বিপ্লবীত্রয় রাজী হয়না, ক্ষমা কর ভাই; যাদুঘরের বাতাসে এখনো বারুদের গন্ধ; রাজাকারের দৈরাত্ব। সেখানে যারা অবস্থান করছে সবাই রাজবন্দী। তাদের কঙ্কালসার দেহ দেখিয়ে তোমরা শত্র“দের করুণা প্রার্থনা করো, ভিক্ষা করো; শালা ভিক্ষুকের দল, এই জন্যই কি দেশ স্বাধীন করা, লক্ষ-লক্ষ প্রাণ বিসর্জন দেওয়া!
বিপ্ল¬¬বীদের কথাগুলো হয়তো মিথ্যে নয়; মুক্তিযোদ্ধাদের নগ্ন করতে আমাদের বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয় না। আফসোসের সুরে একজন মিনতি করে, একটা অনুরোধ রাখবে আশরাফ ?
– বোলেন দেকি, রাকার চিষ্টা কোরবু।
খানিকটা সময় নিয়ে উত্তর দেয়, অনেকদিন তো বিলের মাঝে কাটালাম; এবার না হয় লোকালয়ে নিয়ে চল। আমরা মানুষের মাঝে থাকতে চাই।
এবার আশরাফ তার অক্ষমতা প্রকাশ করে, মাপ চাই, মাপ করেন ভাই; জয়িল করি মল্লিউ তুমাগের একেনে জাগা হবে নানে।
আশরাফের কথায় বিপ্লবীরা বিষ্মিত হয়, কিন্তু কেন আশরাফ; আমাদের স্বাধীন করা দেশে আমাদেরই ঠাই হবে না কেন!
উত্তর দিতে গিয়ে আশরাফের মাথাটা নিচু হয়ে আসে, আসলে ফজল উদ্দিনরা আগের চাইতু আরু বেশী শক্তিশালী; ধূত্ত। তুমাগের তারা মানুষ রাকপেনানে,জন্তু-জানোব বুলি উড়–তাড়া করবেনে। শুদু তাই না, জাত-পাইত নিয়িউ নানান কুত্তুছিনালি করবেনে। তারচায়ু এই ভালো, কিয়ামত পর্যন্ত বিলির মদ্দ্যি ঘুমি থাকো। তাছাড়া আমি নিজিউ একেনে গোপনে আসিছি।
– কেন,গোপনে কেন!
– ক্যানে আবার, শালাগের তো চেনেন না; জানতি পাল্লি মাতার খুলি নি’য়ি ফুটবল খেলবেনে, পাড়ায়-পাড়ায় দেকি নি’য়ি বেড়াবেনে।
বিপ্লবীত্রয় এবার কটাক্ষের হুল ফোঁটায়, ও তোমরা বুঝি ভাল ফুটবল খেল; তাহলে দাওনা ভাই এই দেশটাকে একটা বিশ্বকাপ এনে!
আশরাফ আমতা-আমতা করে উত্তর দেয়, আনিছি ভাই আনিছি, বিশ্বকাপউ আনিছি; তবে ফুটবলে না দূন্নীতিতে।
সুযোগ বুঝে মণ্ডলও ফোড়ন কাটে, হ ছ্যার, আমরা জব্বর দুর্নীতিবাজ; যা পাই তাই খায়,কুনুকিচু বাচ-বিচার নি। সুযুক পালি আকড়ো রেলগাড়িউ গিলি খাই।
প্রকৃতিতে আলো আধারীর বিভাজন; পূবের আকাশ ক্রমশ: ফর্সা হয়ে আসে। কিছুক্ষণ বাদেই হয়তো ফজরের আযান ধ্বনীত হবে। আশরাফ শেষবারের মত বিপ¬বীদের মুখোমুখী দাঁড়ায়, আইচ্চা, আপনারা কি এখুনু খুয়াক দেকেন?
প্রায় সমস্বরে উত্তর দেয়, হ্যা, এখনো আমরা খোয়াব দেখি, আরেকটা যুদ্ধের কথা ভাবি; ঐ যুদ্ধ হবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে, দারিদ্রের বিরুদ্ধে, কতিপয় অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে। সেই যুদ্ধে প্রকৃত রাজাকারদের ক্ষমা করলেও ছদ্মবেশী রাজাকারের ক্ষমা নেই, কিছুতেই না; এ আমাদের প্রতিজ্ঞা।

কার্তিকের প্রায় শেষ-শেষ। বিলের জল চারদিক থেকে গুটিয়ে প্রায় তলানীতে ঠেকেছে। তার উপর শাঁওলার গাঢ় আস্তরণ। ঘন কুয়াশায় দৃষ্টির সীমারেখা বার-বার বিঘিœত হয়। আশরাফের পথচলা তবু রুদ্ধ হয়না; আধারের বুকে ছপাছপ শব্দ তুলে সম্মুখে এগিয়ে চলে। এক-একবার থমকে দাঁড়িয়ে বাতাসের বুকে কান পাতলে মনে হয়, তার চারপাশে অসংখ্য পায়ের আওয়াজ।

 

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!