হযরত ইব্রাহীম আদহাম (রঃ) – পর্ব ১১
হযরত ইব্রাহীম আদহাম (রঃ) – পর্ব ১০ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এত বড় সাধক হওয়া সত্বেও তিনি কিন্তু একটি ঘটনার বেশ লজ্জা পান। এক ক্ষৌরকার তাঁর ক্ষৌরকর্ম করছিল। তাঁর এক শিষ্য বললেন, আপনার কাছে কিছু থাকলে একে মজুরি বাবদ দিয়ে দেবেন। হযরত আদহাম ইব্রাহীম (রঃ)-এর কাছে ছিল মুদ্রা-ভর্তি একটা থলে। তিনি সেটা দান করলেন। আর ব্যস্ত হয়ে উঠলেন হযরত আদহাম ইব্রাহীম (রঃ)। আরে, কর কী? ওতে যে সব সোনার মোহর রয়েছে। ক্ষৌরকার এতটুকু বিচলিত না হয়ে বলল, তাতে কি? ওতে যে সোনার মোহর রয়েছে তা আমি জানি। আর যাকে দান করলাম, সেও জানে। আপনার মনশ্চক্ষু এখনও উন্মীলিত হয়নি দেখা যাচ্ছে। যে লোক শুধু ধন-সম্পদ ধনী, সে প্রকৃত ধনী নয়। অন্তরের ধনে যে ধনবান, প্রকৃত ধনী তাকেই বলে।
বলাবাহুল্য, ক্ষৌরকারের কথায় বড় লজ্জিত হলেন। ধিক্কার দিলেন নিজের অন্তর ও প্রবৃত্তিকে। আসলে ক্ষৌরকার ও ভিক্ষুক যে তাঁকে শিক্ষা দিতে এসেছিল, তা বুঝতে তাঁর দেরী হল না।
রাজসিংহাসন ত্যাগ করে সাধনার পথে এসে তিনি কি কোন ব্যাপারে আনন্দ লাভ করেছেন? তাঁকে প্রশ্ন করা হয়। তিনি বলেন, বহু ব্যাপারে তিনি আনন্দিত হয়েছেন। একবার তিনি নৌকাযোগে কোথাও যাচ্ছিলেন। তাঁর ছেঁড়া ময়লা পোশাক আর রুক্ষ চুল দেখে নৌকার অন্যান্য যাত্রীরা তাঁকে পাগল বলে মনে করে। একজন কৌতুকপ্রিয় রসিক ব্যক্তি তাঁর মাথার চুল ধরে টেনে বেশ মজা পাচ্ছিল। বারবার গলা ধাক্কাও দিচ্ছিল সে সবাই বেশ মজা উপভোগ করছিল। তিনিও প্রবৃত্তির অপমানজনিত কারণে আত্মহারা হয়েছিলেন।
হঠাৎ নদীতে উঠল প্রবল ঢেউ। নৌকাটা আর সামলানো যাচ্ছিল না। মাঝি বলল, নৌকার ভার কিছুটা কমাতে পারলে হয়তো রক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
না হলে যা অবস্থা তাতে কী হবে বলা মুশকিল। মাঝির কথা শুনে একটা লোক তাঁর কান ধরে বলল, যা ব্যাটা, নদীতে ঝাঁপ দে, নইলে ঠেলে ফেলে দেব। সে এত জোরে কান ধরে টানছিল যে, মনে হচ্ছিল কানটা বুঝি উপড়ে যাবে। এই সময় প্রবৃত্তির অপমান ও দীনতা দেখে তিনি প্রচুর আনন্দ পান আর তখন আচমকা ঝড় থেমে যায়। নদী শান্ত হয়। তাঁকে ঝাঁপ দিয়ে নৌকার বোঝা কমাতে হল না।
আর একদিন তিনি বিশ্রাম নিতে এক মসজিদে ঢুকলেন। কিন্তু ওখানে যারা ছিল, তারা জংলী মনে করে তাঁকে মসজিদ থেকে বেরিয়ে যেতে বলল, তিনি শুধু রাতটুকু আশ্রয় দেবার জন্য খুব কাকুতি-মিনতি করলেন। কিন্তু শোনে কার কথা। তারা তাঁকে দরজার কাছে টেনে এনে এমন জোরে ধাক্কা দিল যে, তিনি টাল সামলাতে না পেরে সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে লাগলেন। মাথায় দারুণ চোট লাগল। কিন্তু গড়াতে গড়তে তাঁর মনে হল, প্রতিটি ধাপে মারেফাতের জটিল তত্ত্বের এক
একটি স্তর তিনি যেন আয়াত্ত করে ফেললেন। এই দুর্দশায় সময় এক রসিক পুরুষ তাঁর মাথায় প্রসাব ঢেলে দিল। এই সময় প্রবৃত্তি বেশ জব্দ হওয়ায় তিনি খুবই আনন্দ পান।
আর একবার পরনে তাঁর চামড়ার জোব্বা। দারুণ ময়লা। উকুন থিক থিক করছে। সেগুলি এমনভাবে কামড়াতে শুরু করল যে, দু’হাত দিয়ে তিনি গা চুলকাতে লাগলেন। চুলকাতে চুলকাতে অস্থির। তখন তাঁর মনে হল, অতীতের বাদশাহী জীবনের জরির কাজ করা রেশমি পোশাকের কথা। আর তখন প্রবৃত্তির বেশ কিছু শিক্ষা হয়েছে ভেবে তিনি প্রভূত আনন্দ লাভ করেন।
কিন্তু প্রবৃত্তির মৃত্যু নেই। হঠাৎ সে জেগে ওঠে। একবার আল্লাহর ধ্যানমগ্ন হওয়ার জন্য তিনি গেলেন এক নির্জন প্রান্তরে। বেশ কিছুদিন কেটে গেল সেখানে। কিন্তু খাওয়া জুটল না। ওখান থেকে দূরে তাঁর এক হিতৈষী বন্ধু ছিল। একবার ভাবলেন, তাঁর কাছেই যাওয়া যাক। কিন্তু পরে মনে হল না, তাহলে তার সাধনা নষ্ট হবে। কাজেই তিনি গেলেন এক মসজিদে। আর মনে মনে বলতে লাগলেন, আমিই তাঁরই ওপর নির্ভর করলাম, যিনি চিরঞ্জজীব, অমর। হঠাৎ গায়েবী আওয়াজ হল, পৃথিবী থেকে প্রকৃত নির্ভরকারী বিলীন হয়ে গেছে। তুমিও কৃত্রিম। প্রকৃত বন্ধুর কাছে কী খাওয়ার ইচ্ছা জানাতে হয়।
সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া