হযরত ইব্রাহীম আদহাম (রঃ) – পর্ব ১০
হযরত ইব্রাহীম আদহাম (রঃ) – পর্ব ৯ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হযরত ইব্রাহীম আদহাম (রঃ)-এর হালাল খাদ্যাভাসের কথা আগেই বলা হয়েছে। এ ব্যাপারে তিনি কত সচেতন ছিলেন, তা জানা যায় যখন তিনি বলেন যে, চল্লিশ বছর ধরে তিনি মক্কার কোন ফল মুখে দেননি। কারণ, ফলের বাগানগুলি তখন সেনা বিভাগের লোকেরা কিনে নিয়েছিল অবৈধ উপার্জনের টাকায়। জীবনে তিনি বহু বার হজ্জে গেছেন। পায়ে হেঁটে প্রত্যেকবার। মক্কায় দীর্ঘ অবস্থানকালে তিনি জমজম কূপের পানি পান করেননি। কেননা, কূপ থেকে তোলার বালতিটা সরকারী।
আগেই বলা হয়েছে, হালাল রুজি-রোজগারের জন্য তিনি দিনের বেলায় ঘাস বা কাঠ কাটতেন। আর সেগুলির বিক্রয়-লব্ধ অর্থ দ্বারা রুটি কিনে দরবেশের খাওয়াতেন, নিজেও খেতেন। কখনও কখনও দিন-মুজুরের কাজও করতেন।
একবার সন্ধ্যা উতরে গেল। তিনি ফিরলেন না। তাঁর শিষ্যরা অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন। তারপর যার যা ছিল তাই দিয়ে খাবার কিনে ঘুমিয়ে গেলেন। অনেক রাতে হজরত আদহাম ইব্রাহীম (রঃ) বাসায় ফিরলেন। দেখলেন, সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। সঙ্গে আটা কিনে এনেছিলেন। কাউকে না জাগিয়ে নিজেই রুটি বানাতে গেলেন। কিন্তু মুশকিল হল উনুন নিয়ে। কিছুতেই আগুন জ্বলছে না। কত ফুঁ দিলেন। তাও না। এমন সময় একজনের ঘুম ভাঙল। তিনি আবার অন্যদের জাগিয়ে দিলেন। মুর্শিদের কাণ্ড দেখে মুরিদরা বললেন, এত রাতে এ আপনি কি করছেন? তিনি যেন অপ্রস্তুত হয়ে বললেন, আমার আজ খুব দেরি হয়ে গেল। দেখি তোমরা সব ঘুমে অচেতন। ক্ষুধায় কত কষ্ট হয়েছে তোমাদের। তাই নিজেই রুটি তৈরি করতে লাগলাম। ভেবেছিলাম, রুটি হলেই তোমাদের জাগাব। তার আগেই তোমরা…।
শিষ্যরা পরস্পর বলাবলি করতে লাগলেন। মুর্শিদ না মুরিদ-কে কার খেদমত করবেন? চিরকালের জন্য এ প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেছেন হযরত ইব্রাহীম আদহাম (রঃ)। তাঁর শিষ্য হওয়ার শর্ত ছিল বিচিত্র। তিনটি শর্ত আরোপ করতেন তিনি।
(১) আমি তোমাদের পরিচর্যা করব। আপত্তি করবে না।
(২) নামাজের আযান আমিই দেব।
(৩) আমার যা খাবার জুটবে, তাই তোমাদের দেব। খেতে সংকচবোধ করবে না। দীর্ঘ দিন তাঁর সংস্পর্শে থেকে এক সহচর একদিন বিদায় নিলেন। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি বললেন, হুজুর, আমি অনেকদিন আপনার সঙ্গে ছিলাম। আমার মধ্যে যে দোষ-ত্রুটি দুর্বলতা দেখেছেন, দয়া করে বলুন। হযরত আদহাম ইব্রাহীম (রঃ) উত্তর দিলেন, তুমি আমার সর্বক্ষণের সৎ বন্ধু। সুতরাং তোমার দোষ-ত্রুটি দুর্বলতা আমার চোখে পড়েনি।
একটি বড় পরিবার। পরিবার সদস্য অনেক। সকলের অন্ন জোটাতে কর্তা হিমশিম খেয়ে যান। একদিন তো অন্নের সংস্থান করাই গেল না। ব্যর্থ, বিপন্ন মানুষটি বাড়ি ফিরছিলেন। রাস্তায় হযরত আদহাম ইব্রাহীম (রঃ)-এর সিঙ্গে দেখা। তাঁকে পরিবার-কর্তা বললেন, আপনাকে দেখে আমার হিংসা হয়। কেন, জানেন? আপনার সংসার নেই। তাই সংসারের চিন্তাও নেই। নিশ্চিন্তে দিব্যি রয়েছেন আপনি। আর আমি যে দুর্ভাবনায় দিন কাটাচ্ছি, সংসারী হলে বুঝতে পারতেন। হযরত আদহাম ইব্রাহীম (রঃ) তৎক্ষণাৎ জবাব দিলেন, ভাই, আমি সারা জীবন যে পুণ্য করেছি, সব তুমি নাও। আর তোমার আজকের এ ভাবনাটুকু আমায় দিয়ে দাও।
খলিফা মোতাসেম বিল্লাহর সমকালীন লোক ছিলেন হযরত আদহাম ইব্রাহীম (রঃ)। একদিন খলিফা তাঁকে বললেন, আপনি অপরের জন্য কী করছেন আর নিজের জন্যই বা কি করছেন?
হযরত উত্তর দিলেন, পার্থিব জীবনে যারা ভোগ-বিলাসের কামনা করে, তাদের অনুকূলে আমি সে সব পরিত্যাগ করেছি। যারা পরকাল চায়, আমি তাদের দিকে চেয়ে তা থেকে ফিরে গেছি। আল্লাহর দীদার লাভ করব বলে তাঁর ধ্যানে মগ থাকাই সার করেছি।
সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া