অচেনা দ্বীপের গল্প– প্রথম পর্ব

এক লোক রাজার দরজায় টোকা মেরে বলল, আমাকে একটা জাহাজ দিন। রাজপ্রাসাদে আরও অনেক দরজা আছে, তবে এই দরজাটা শুধু আর্জি পেশ করার জন্য আলাদা করা। যেহেতু রাজা তাঁর পুরোটা সময় প্রাপ্য নামে দরজায় কাটান (যা কিছু সব রাজারই প্রাপ্য, আপনাকে বুঝতে হবে), যখনই আর্জির দরজায় কেউ টোকা মারে তিনি শুনতে না পাবার ভান করেন। দরজায় লাগানো ব্রোঞ্জের কড়া নাড়ার শব্দ যখন কানের পরদা ফাটানোর হুমকি দেয়,
হয়ে ওঠে নিখাদ কেলেঙ্কারীর সমতুল্য, প্রতিবেশীদের শান্তি হরণ করে (লোকজন ফিসফাস শুরু করবে-সে রাজা কেমন রাজা কড়া নাড়লেও যিনি সাড়া দেন না ), শুধুমাত্র তখনই তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে বলবেন-যেহেতু চুপ করানো যাচ্ছে না, দেখুন তো লোকটা কি চাইছে। এরপর প্রধানমন্ত্রী গুরুত্ব অনুসারে দ্বিতীয় মন্ত্রীকে বলবেন, দ্বিতীয় মন্ত্রী বলবেন তৃতীয় মন্ত্রীকে, তৃতীয় মন্ত্রী হুকুম করবেন তাঁর প্রথম সহকারীকে, প্রথম সহকারী নির্দেশ দেবেন দ্বিতীয় সহকারীকে, এভাবে রাজার আদেশ ক্রমশ নীচে নামতে নামতে গিয়ে পৌঁছুবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বে থাকা এক তরুণীর কাছে, যাকে সবাই পরিচ্ছন্ন নারী হিসেবে চেনে। কাউকে হুকুম করবে, এমন কেউ নেই তরুণীর, অগত্যা দরজা সামান্য ফাঁক করে তাকেই জিজ্ঞেস করতে হয়: কি চাই?
আগন্তুক তখন তার আর্জি পেশ করে। ওখানেই, দরজার পাশে, অপেক্ষা করতে বলা হয় তাকে-তার আবেদন এক মুখ থেকে আরেক মুখ হয়ে, অবশেষে রাজার কানে পৌঁছায়। রাজা যেহেতু তাঁর প্রিয় দরজায় উপস্থিত হয়ে খাজনা এবং হাজার রকমের উপহার গ্রহণে সব সময় ব্যস্ত থাকেন, তাই উত্তর দিতে অনেক লম্বা সময় লেগে যায় তাঁর। উত্তর দেয়ার সময় ও সুযোগ যখন পান, যেহেতু রাজা তাঁর প্রজাদের মঙ্গল চান এবং তাদেরকে সুখী দেখতে চান, ব্যাপারটাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেন তিনি-আর্জি সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর লিখিত বক্তব্য চেয়ে বসেন। বলাই বাহুল্য যে প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয় মন্ত্রীর কাছে এই একই জিনিস চান, লিখিত বক্তব্য। দ্বিতীয় মন্ত্রীও তাই চাইলেন তৃতীয় মন্ত্রীর কাছে। এভাবে শেষ পর্যন্ত আদেশটা পৌঁছাল কাপড় ও ঘরদোর পরিষ্কার করার দায়িত্বে থাকা সেই তরুণীর কানে। আর্জির জবাবে সে কিছু একটা বলবে, তবে জবাবটা কেমন হবে সেটা নির্ভর করবে তার ওই সময়কার মন আর মেজাজের ওপর।
যাই হোক, যে লোক জাহাজ চাইতে এসেছে, দেখা গেল তার বেলায় ঠিক তা ঘটল না। পরিচ্ছন্ন নারী যখন জিজ্ঞেস করল কি চাই গো তোমার, সে কিন্তু আর সবার মতো টাকা-পয়সা, পদ, পদক বা ক্ষমতা চাইল না; বলল, আমি রাজার সঙ্গে কথা বলতে চাই।
তরুণী জবাব দিলো: তুমি খুব ভালো করে জানো যে রাজা আসতে পারবেন না। কারণ তিনি তাঁর প্রিয় দরজা প্রাপ্যতে দাঁড়িয়ে উপহার আর খাজনা গ্রহণে ব্যস্ত।
ঠিফ আছে, রাজাকে গিয়ে বলো যে তিনি এখানে না আসা পর্যন্ত আমি কোথাও যাচ্ছি না। আমি কি চাই, সেটা জানতে হলে সশরীরে এখানে তাঁকে আসতে হবে।
নিজের কথা বলে আর্জির দোরগোড়ায় শুয়ে পড়ল লোকটা। ঠাণ্ডা লাগছে দেখে একটা চাদর টেনে নিয়ে গায়ে দিলো। এখন যে-ই আর্জির দরজা দিয়ে আসা-যাওয়া করতে চাইবে, ওই লোককে ডিঙিয়ে যেতে হবে তার। সেটা বেশ বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। কারণ নিয়ম অনুসারে প্রতিবার মাত্র একজন ওই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের আর্জি পেশ করতে পারবে। এর মানে দাঁড়াল, ওই লোক যতক্ষণ ওখানে শুয়ে থাকবে ততক্ষণ আর কেউ রাজার কাছে কিছু চাইতে বা নিজের উচ্চাকাক্সক্ষার কথা জানাতে পারবে না।
প্রথমে মনে হতে পারে এই সমস্যা থেকে রাজা লাভবান হবেন, কারণ তুলনায় অনেক কম লোকের চাহিদা মেটাতে হবে তাঁকে-এমনকি কারও কোনও চাহিদাই হয়তো মেটাতে হবে না। ওই দরজায় এমন অনেকে আসে যারা তাঁকে দেখে ভেঁউ ভেঁউ করে কেঁদে ফেলে, ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেদের কাঁদুনি গাইতে থাকে-অপ্রীতিকর এ-ধরনের পরিস্থিতি থেকেও বাঁচবেন তিনি। কিন্তু দ্বিতীয় বিবেচনায় দেখা যাবে, লোকসান গুনতে হবে রাজাকেই। উত্তর পেতে অসম্ভব দেরি হচ্ছে দেখলে মানুষ প্রতিবাদ জানাবে, তাতে সামাজিক অসন্তোষ ছড়াবে, গ্রাপ্য নামে দরজা দিয়ে খাজনা আর উপহারের যে স্রোত রাজপ্রাসাদে ঢোকে সেটার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
তিন দিন পর অগত্যা বাধ্য হয়ে আর্জির দরজায় হাজির হলেন রাজা, শুনতে চান লোকটা কি চাইছে। দরজা খোলো, পরিচ্ছন্ন নারীকে বললেন তিনি। সে বলল, একটু, নাকি পুরো দরজা?
এক মুহূর্ত ইতস্তত করলেন রাজা। ভেবে দেখলেন সামান্য একটু ফাঁক দিয়ে নিজের প্রজার সঙ্গে কথা বললে রটে যাবে রাজা বোধহয় ভয় পেয়েছে। পরিচ্ছন্ন নারী ওঁদের কথাবার্তা শুনবে, এবং সুযোগ পাওয়া মাত্র গোটা রাজ্যে ছড়িযে দেবে সব। সবটুকু খোলো, হুকুম করলেন তিনি।
দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে জাহাজ চাইতে আসা লোকটা লাফ দিয়ে ধাপের ওপর সিধে হলো, চাদরটা ভাঁজ করে কাঁধে ফেলল, তারপর অপেক্ষায় থাকল। ইতিমধ্যে তার পেছনে ও দু’পাশে আগ্রহী লোকজনের বেশ বড়সড় ভিড় জমে গেছে। প্রজারা দেখতে এসেছে রাজা কেমন দয়া আর উদারতার পরিচয় দেন। হঠাৎ চাঞ্চল্য শুরু হওয়ায় আশপাশের বাড়ি-ঘরের জানালা খুলে গেল, মানুষজন অবাক হয়ে ঝুঁকে পড়ল, কি ঘটছে দেখতে চায়। যে ব্যক্তি রাজার কাছে জাহাজ চাইতে এসেছে, একা সেই শুধু অবাক হয়নি। সে হিসেবী, এবং তার ধারণা সত্যি প্রমাণিত হয়েছে-তিন দিন পর হলেও সশরীরে আর্জির দরজায় হাজির হতে হয়েছে রাজাকে, এটা জানতে যে তাঁর সঙ্গে কথা বলার জন্য এত দৃঢ়তা দেখাতে পারে কোন সে লোক।
যতই কৌত‚হলী হন, এত লোকের ভিড় দেখে বিরক্ত বোধ করলেন রাজা, মেজাজ ঠিক রাখতে না পেরে লোকটাকে একের পর এক তিনটে প্রশ্ন করলেন তিনি: কি চাও? যেটা দরকার সেটার কথা সোজাসাপ্টা বলোনি কেন? তোমার কি ধারণা আমার আর কিছু করার নেই?
লোকটা শুধু তাঁর প্রথম প্রশ্নের জবাব দিলো, আমাকে একটা জাহাজ দিন।
কথাটা শুনে রাজা এতটাই হকচকিয়ে গেলেন যে পরিচ্ছন্ন নারী তাড়াতাড়ি নিজের ব্যবহার করা পুরোনো চেয়ারটা টেনে এনে বসতে দিলো তাঁকে। এই চেয়ারে বসে সেলাই-ফোঁড়াইয়ের কাজ করে সে, প্রাসাদের আরও অনেক বাড়তি কাজের মতো এটাও করতে হয় তাকে।
চেয়ারে বসে একটু আড়ষ্ট বোধ করছেন রাজা, কারণ তাঁর সিংহাসনের চেয়ে অনেক ছোট এটা। পা দুটোকে নিয়েই বেশি সমস্যা হলো, কোথায় রাখবেন। প্রথমে সামনে লম্বা করে দিলেন, কিন্তু সেটা দেখতে খারাপ লাগছে, শেষমেষ হাঁটু দুটো যতটুকু পারা যায় দু’পাশে মেলে দিলেন।
ওদিকে, যে লোক জাহাজ চাইতে এসেছে, রাজা কখন আবার প্রশ্ন করবেন তার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
বসে আরাম পাবার পর রাজা প্রশ্ন করলেন, এই জাহাজ তুমি কেন চাইছ, হে?
লোকটা উত্তর দিলো, জাহাজ চাইছি অচেনা দ্বীপ খুঁজতে বেরুব বলে।
কিসের অচেনা দ্বীপ! হাসি চেপে জিজ্ঞেস করলেন রাজা।
অচেনা দ্বীপ, আবার বলল লোকটা।
আরে, বোকা নাকি! তুমি জানো না, আর তো কোনও দ্বীপ অচেনা নেই! যেখানে যত দ্বীপ আছে, সব তুমি মানচিত্রে পাবে। জাহাজ নিয়ে যে দ্বীপেই তুমি যাও না কেন, এই আমি তোমাকে বলছি, সেটা আর অচেনা থাকবে না।
আমি অচেনা দ্বীপই খুঁজতে বেরুব।
রাজা এবার সিরিয়াস হয়ে উঠলেন, জানতে চাইলেন, তুমি কি এই দ্বীপের কথা কাউকে বলতে শুনেছ?
না, কেউ আমাকে কিছু বলেনি।
তাহলে তো বোঝা যাচ্ছে না কেন তুমি জেদ ধরছ যে অচেনা দ্বীপের অস্তিত্ব আছে। যে জিনিস নেই, তুমি সেটা খুঁজতে যাবে বলে আমার কাছে জাহাজ চাইতে এসেছ।
হ্যাঁ, আমি আপনার কাছে জাহাজ চাইতে এসেছি।
তুমি কে হে যে আমি তোমাকে একটা জাহাজ দেবো।
আপনিই বা কে যে আমাকে একটা জাহাজ দিতে অস্বীকার করবেন?
আমি এই রাজত্বের মালিক, সবাই জানে আমি এখানকার রাজা, এবং এই দেশের সব নৌকা আর জাহাজ আমার।
ওগুলো আপনার, ঠিক আছে, কিন্তু তারচেয়ে বেশি আপনিও ওগুলোর।
কী বলতে চাও তুমি? চিন্তিত রাজা প্রশ্ন করলেন।
আমি বলতে চাইছি, ওগুলো ছাড়া আপনি কিছু না, অথচ আপনাকে ছাড়া ওগুলো সাগর পাড়ি দিতে পারবে।
সেটা পারবে আমার হুকুমে, আমার নাবিক আর মাঝি-মাল্লাদের নিয়ে।
কিন্তু আমি আপনার কাছে নাবিক বা মাঝি-মাল্লা চাইনি, আমি শুধু আপনার কাছে একটা জাহাজ চেয়েছি।
আর এই অচেনা দ্বীপের ব্যাপারটা কি হবে, ওটা যদি তুমি খুঁজে পাওই? ওটা কি আমার হবে?
আপনি, হুজুর, শুধু ইতিমধ্যে পরিচিত দ্বীপ সম্পর্কে আগ্রহী।
না, আমি অচেনা দ্বীপ সম্পর্কেও আগ্রহী, একবার সেটা চেনা হয়ে গেলে।

গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!