আলীবাবার মৃত্যু– প্রথম পর্ব

পরিণামে যেসব লোক ধুঁকতে ধুঁকতে মরে যায়, অসংখ্য মানুষের ভিড়ে যারা একটা অফিসে যাবতীয় কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য চাকরি করে, তাদের নাম কেরানি। তাদেরই একজন টাউন হল অফিসের সর্বোচ্চ তলা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মরে গেছে।

পরদিন খবরের কাগজের তৃতীয় পৃষ্ঠায় নিচের দিকে, যেখানে স্থানীয় সংবাদে ডাকাতি, ধর্ষণ, আত্মহত্যা ও দুর্ঘটনার মতো খবরাদি ছাপা হয়, সেখানে আড়াই লাইনের একটা খবর বেরোল যে মিউনিসিপ্যাল করপোরেশনের রামলাল নামে এক কেরানি টাউন হলের সবচেয়ে ওপরের ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।

ওই একই দিন, বিকেলে মিসেস মিধার বাসায় মহাধুমধামে বিড়াল ছানাদের নিয়ে একটা পার্টি চলছিল। মিসেস মাথুর এ ধরনের পার্টি হলে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করে। কারণ পাঁচ বছর ধরে তার স্বামী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে এমন একটা শাখায় চাকরি করে, যেখানে বাড়তি দুই পয়সা কামানোর কোনো রাস্তা নেই। তার সেই সামর্থ্য নেই যে সর্বশেষ ডিজাইনের একটা শাড়ি কিনতে কিংবা অন্য মহিলাদের মতো এ ধরনের অনুষ্ঠানে ডাট দেখিয়ে এককভাবে কিছু করে; কিন্তু সে তো জগৎ সংসারে এভাবে নিজেকে পেছনে ফেলে রাখতে পারে না। এই ভিড়ভাট্টার মধ্যে তার একটা জায়গা করে নিতেই হবে। না করলে সে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ একাকী কী করে দিন কাটাবে?

অতএব প্রত্যেক দিন সকালে খবরের কাগজে পার্টির খবরাখবর খুব মনোযোগ দিয়ে পড়া শুরু করে। আসলেই খবরের কাগজই আসল জায়গা, যেখানে টাটকা খবরের মতো খবর থাকে। আহম্মকের বাক্স নামে যে জিনিসটি আছে, সেখানে শুধু ক্ষমতাবানদের খবরই শুধু খবর, বাকি সব বেনোজলে ভেসে যাওয়ার মতো সংবাদ। মনে হয় আহম্মকের বাক্সে কোনো খবর না থাকার খবরই মোদ্দা কথা।

হ্যাঁ, মিসেস মাথুর সকাল বেলায়ই খবরটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েছে। পড়া শেষে আলস্য ভরে কাঁটা চামচের মাথায় এক টুকরো চিকেন টিক্কা গেঁথে নিয়ে গভীর শ্বাস ফেলে ভাবে, কে জানে হতভাগা রামলাল আসলে কে, আর কে-ই বা টাউন হলের সর্বোচ্চ ছাদ থেকে গতকাল লাফ দিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করল?

অত সকালে তেমন কেউ-ই খবরটি পড়েনি। সাজুগুজু করা, মুক্তায় ঝকমকে, বাহারি চোখের পাতা, চোখ ধাঁধানো কানের গয়না ও সুগন্ধি প্রসাধনীতে সজ্জিতা মিসেস মিধা কাজ শেষ করে নিজেকেই ফিসফিস করে বলল, ‘হতভাগা শয়তান!’

পরে, দুপুরে খাবারের আগে বিকেলে প্রেসক্লাবে সাংবাদিকরা টেবিলের বিয়ারের ক্যানগুলো গা-ছাড়াভাবে পরিষ্কার করছিল। ছড়ানো-ছিটানো টেবিল ও অগোছালো অপরিষ্কার চারপাশ সাফসুতরো করছে। তারা গলার স্বর চড়িয়ে মাওবাদী ও নক্সালদের সম্পর্কে কথাও বলছে। নেপাল ও শ্রীলঙ্কা ছাড়াও ইন্দো-চীন সম্পর্কও আছে তাদের কথায়। আজ কোন হোমড়াচোমড়া কোথায় জমকালো পার্টির আয়োজন করছেন, সেটাও আছে তাদের আলোচনায়।

গুপ্ত নামের যে লোকটি দুই বছর আগে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন, যিনি এখন চার পৃষ্ঠার একটা সান্ধ্য দৈনিক বের করেন। তিনি তাঁর টেবিলের একজনকে জিজ্ঞেস করেন, ‘রামলালের আর কোনো খবর আছে?’

‘রামলাল একটা বলির পাঁঠা। প্রত্যেক মুখ্যমন্ত্রীই ক্ষমতা ছাড়ার আগে কিংবা তাঁর জায়গায় অন্য কেউ আসার আগ দিয়ে এমন একটা ঘটনা ঘটান। তিনি তাঁর প্রতিপক্ষ কে, তা জেনে তাঁর বর্তমান ঘাপলাবাজি খুঁজে বের করা ছাড়াও আর কী কী অপকর্ম থাকতে পারে, তাও প্রকাশ করে প্রচারণা চালান, হাই কমান্ডের কাছে পেশ করেন। এটা এমন একটা নোংরা চক্র, যা কোনো দিনই শেষ হয় না। আমাদের এই হোমড়াচোমড়ারা মরে গেলে আসে আরেকজন। রামলালও এই নিয়মিত দুষ্টচক্রের এক শিকার।’ কথাগুলো বলল ‘হিন্দুস্তান টাইমস’-এর রাজ। ‘না, আমি সাবেক মুখ্যমন্ত্রীর কথা বলছি না। বলছি ওই রামলালের কথা, যে কিনা গতকাল আত্মহত্যা করেছে।’

‘আমাদের ক্রাইম রিপোর্টার এটা নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে। ঘটনায় যদি কোনো মালমাত্তা থাকে তাহলে আজ রাতেই সেটা জমা দেবে।’

আসলে এ ঘটনাটার সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের প্রত্যেকেরই পকেট কিংবা ব্যাগে তথ্যটি রয়েছে। পাওয়ান মানচান্দা নামের মানুষটি, যে কিনা গত সন্ধ্যায়ই সবাইকে সত্য ঘটনাটা জানিয়েছে। যদিও আমরা জানি শেষেরও কিছু না কিছু শেষ আছে। ওটাকে বলে নিপুণ হাতে কারসাজি, যার নাম অসত্যের বাটালি ছাঁদ।

পাওয়ান মানচান্দা! চিনলেন না পাওয়ান মানচান্দাকে? আশ্চর্য! রাজধানীর সব সামাজিক অনুষ্ঠানে যার উপস্থিতি অবধারিত, যেখানে নগরীর প্রায় সব চাকচিক্যের অধিকারিণীরা একে অপরকে দেখাতে ও দেখতে একত্র হয়। ওখানে প্রায় সবাই খুবই শক্তিমালন ভোজবাজিকর, যাদের কাজই হচ্ছে খালি চোখে যা দেখা যায় না, তা তারা দেখিয়ে দেয়।

না, আপনার কোনো ভুল হয়নি। এখানে কোনো ধাপ্পাবাজি নেই। এটা খুবই সাধারণ একটা মানুষের চাকরি। সে এই কাজের জন্যই এই করপোরেশনে চাকরি নিয়েছিল। প্রত্যেক বড় কম্পানি, জনপ্রতিষ্ঠান, সব সরকারি সংস্থা, সব নামকরা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, এমনকি প্রধানমন্ত্রীর নিজের খাতায় পর্যন্ত এ জাতীয় বেতনভুক কর্মচারীর নাম আছে।

আপনার ধারণাই ঠিক। পাওয়ান মানচান্দা একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা। আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, তার গোষ্ঠীর অন্য ভাই-বেরাদর তার মতো একজন দরের মানুষ প্রায় দেখা-সাক্ষাৎই পায় না। কারণ ওই যে ‘চতুর্থ রাষ্ট্র’ অর্থাৎ মিডিয়া জগতের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ, ওঠাবসা করতেই তার সব সময়টুকু ব্যয় হয়ে যায়।

যেকোনো খ্যাতিসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের জন্য এই মৃত্যু বা আত্মহত্যা, ধর্মঘট অথবা লকআউট, শ্রমিক অসন্তোষ কিংবা অস্বস্তিকর কোনো পরিস্থিতি বড্ড বিব্রতকর। অতএব এ ধরনের খবরাদি খুব কায়দা করে ও কৌশলী হয়ে পরিবেশন করতে হয়। তবে এসব খবর যদি ছলচাতুরি করে হাওয়া করে দেওয়া না যায়, তাহলে এটাকে কিভাবে স্বাদু করে গেলানো যায়, তারও ব্যবস্থা আছে। মূল ঘটনা নয়ছয় করে, সেটা হেলাফেলা ভরে, সংবাদপত্রের ভাষায় লঘু করে প্রকাশ করলেই হলো।

মোদ্দা কথা, গতকাল দুপুরে মিউনিসিপল কমিশনার পাওয়ান মানচান্দাকে নিজ ঘরে ডেকেছিলেন।

‘কী হচ্ছে এসব? রামলাল নামের আজেবাজে এই লোকটি কে? ওই শকুনের মতো সংবাদপত্রগুলোর কাছে খবরটি গেলই বা কিভাবে? সকাল থেকে এ পর্যন্ত ছয়-ছয়টি ফোন পেয়েছি। এ ব্যাপারে কেন কিছু করতে পারোনি?’

পাওয়ান মানচান্দা তার সুখী-সুখী মুখখানায় সামান্য একটু হাসির রেখার সঙ্গে ভীতির ভাব ফুটিয়ে বলল, ‘স্যার, রামলাল যখন ডোডো পাখির মতো সশব্দে হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে অক্কা পেল, তখন আমি কী করে তার লাশ গায়েব করে ফেলব?’

‘আমি কোনো অজুহাত শুনতে চাই না। তুমি যখন তার লাশ গায়েবই করতে পারলে না, তখন তোমার উচিত ছিল এ খবর যাতে খবরের কাগজে না যায়’-খেপে গিয়ে কমিশনার যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখনো পাওয়ান মানচান্দার সেই দুঃখ-দুঃখ ভাবের করুণ হাসিটা মুখে লেপ্টে ছিল।

সে যা-ই হোক, দুজনই একমত হলো যে এই সাংবাদিক জাতটা বড্ড অকৃতজ্ঞ। যখনই তারা গন্ধ পায় এই খবরে কিছু মালমাত্তা আছে, তখনই তাদের সব ভালো মানুষী উড়ে যায় এবং সেই দয়াবানদের দান গপগপ করে গিলতে থাকে। তারা স্বীকার করে, হ্যাঁ, গণমাধ্যমের সবারই পেটে বড় ক্ষিদে। সব সময়ই। সর্বক্ষণ মৃত হোক আর জীবিত, তাদের প্রয়োজন মাংস, আরো মাংস।

পাওয়ান মানচান্দা খুব দ্রুত তার কাজে লেগে যায়।

প্রথমেই সে রামলালের নিজের বাড়ি থেকে আত্মহত্যার মূল কারণটি খুঁজতে শুরু করে। বহু লোক আছে, যারা নিজের জীবন নিজেই শেষ করে দেয় পারিবারিক অশান্তির কারণে। করে না তারা?

হাজারও কারণ থাকতে পারে : রামলালের বউয়ের সঙ্গে আর কারো পরকীয়া চলছে, রামলালের অবিবাহিতা মেয়েটি হয়তো গর্ভবতী হয়েছে, কে জানে রামলালের ছেলেটি ডাকাতি বা রাহাজানির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে কি না! যেকোনো কিছু হতে পারে।

কিন্তু তার সব তদন্ত-চেষ্টা একেবারে মৃতবৎ নিষ্ফলা হয়ে গেল।

রামলালের বউ তার তিরিশ বছরের জীবনটার গোড়াটা পাগলের মতো খুঁজতে থাক, সেখানে সে শুধু পায় ছেঁড়াফাটা রংচটা কাপড়ের কিছু টুকরো। রামলালের মেয়েটির বয়স মাত্র সাত; অতএব তাকে ফুসলে বের করে নিয়ে যাওয়া বা গর্ভবতী করার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তার ছেলেটা একটা সরকারি স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে মাত্র, যেখানে শুধু লেখাপড়া ছাড়া ডাকাতি, রাহাজানির কিছুই পড়ানো হয় না।

আপনারা জানেন, একমাত্র একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী রাজনীতিবিদ। অথচ অঢেল মালকড়ির মালিক ব্যবসায়ীর সন্তানরা দেশের সবচেয়ে ভালো পাবলিক স্কুলে যায়। তারা সেখানে শেখে কী করে কৌশলে আইন অমান্য করতে হয়, আরো শেখে লাখ লাখ ডলার ধাপ্পাবাজির মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব, এমনকি এটাও শেখে ফুটপাতে অজস্র ঘুমন্ত মানুষের শরীরের ওপর দিয়ে প্রচণ্ড বেগে বিএমডাব্লিউ গাড়ি চালিয়ে দেওয়া যায়। এটাও জানে মধ্যরাতেরও পরে পানশালায় যেসব মেয়ে পানীয় সরবরাহ করতে রাজি হয় না, তাদের কী করে গুলি করে মেরে ফেলতে হয়, কিভাবে তাদের সর্বশেষ মডেলের অস্ত্রটা প্রদর্শন এবং পানীয়টা ব্যবহার করতে হবে।

কেন নয়? গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণেতারা ভালো করেই জানে, তারা আইনের ঊর্ধ্বে এবং সে অধিকার তার আছে। পাওয়ান মানচান্দা গভীরভাবে চিন্তা করতে থাকে, একটা কিছু অবশ্যই করা দরকার। প্রকৃতপক্ষে তার চাকরির জন্য সে প্রতি মাসে একটা মোটা অঙ্কের বেতন পায়। এটাই তার প্রবল আত্মবিশ্বাস।

আর এ কারণেই সে একটা ফাইল তৈরি করে ফেলে। ফাইলটা অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে টেবিল থেকে টেবিলে চালাচালি হতে থাকে। দ্রুতগতির চলাচলে বক্তব্যটা ছিল যে জনৈক ভরদ্বাজের…

গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!