তেংগো কোয়েনজি স্টেশনে ফিরে আসা দ্রুতগামী ট্রেন চুও লাইনে উঠল। বগিটা ছিল বেশ ফাঁকা। সেদিন কোনো কিছুরই পরিকল্পনা ছিল না তার। কোথায় যাবে আর কী করবে (বা করবে না) তা ছিল পুরোপুরিই তার নিজের মর্জি। সেটা ছিল গ্রীষ্মের এক বাতাসহীন ভোরবেলা আর ছিল প্রখর সূর্যের তাপ। ট্রেনটা শিনজুকু, ইয়ৎসুয়া, ওচানোমিজু পেরিয়ে গেল আর পৌঁছাল টোকিও সেন্ট্রাল স্টেশনে। সেটাই ছিল পথের শেষ। সবাই নেমে পড়ল আর কেতা বজায় রেখে তেংগোও নেমে পড়ল। বসল একটা বেঞ্চির উপর। ভাবল কোথায় গেলে ভালো হয়। “যদি চাই তো যে কোনো জায়গায় যেতে পারি,” নিজেকেই বলল সে। “মনে হচ্ছে দিনটা খুব গরম যাবে, সমুদ্র উপকূলে যাওয়া যায়।” সে মাথা তুলল এবং প্ল্যাটফর্ম নির্দেশিকাটি পড়ল।
সেই মুহূর্তে, সে অনুধাবন করল এতক্ষণ ধরে সে কী করে আসছিল।
কয়েকবার সে মাথা ঝাঁকাবার চেষ্টা করল কিন্তু মাথায় খেলে যাওয়া ভাবনাটা কিছুতেই গেল না। সম্ভবত কোয়েনজি স্টেশনে চুও লাইনের ট্রেনে ওঠার সময়ই সে অচেতনে মনস্থির করে ফেলেছিল। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়াল, একজন স্টেশন-কর্মচারীকে জিজ্ঞেস করল, চিকুরা যাবার সংক্ষিপ্ত যোগাযোগ কোনটি। লোকটা ট্রেন-সময়সূচির মোটা খাতার পাতা উল্টে গেল। বলল, তাতেইয়ামার দিকে সাড়ে এগারোটার স্পেশাল এক্সপ্রেস ট্রেন ধরতে হবে এবং সেখান থেকে লোকালে উঠে চিকুরা; দুইটার অল্প কিছুক্ষণ পরেই সে গন্তব্যে পৌঁছাতে পারে। তেংগো টোকিও–চিকুরা আসা-যাওয়ার টিকিট কাটল। তারপর স্টেশনে একটা রেস্তরাঁয় গিয়ে ভাত-তরকারি আর সালাদ দিতে বলল।
বাবাকে দেখতে যাওয়া ছিল একটা বিষাদঘন ব্যাপার। লোকটাকে সে কখনোই ততটা পছন্দ করে নি, আর তার বাবারও তার প্রতি বিশেষ ভালোবাসা ছিল না। চার বছর আগে তিনি অবসর নিয়েছিলেন, তার কিছুকাল পরেই ঢুকেছিলেন চিকুরার স্বাস্থ্যনিবাসে যেটি বিশেষত ছিল মাথা খারাপ রোগীদের জন্য। তেংগো সেখানে দুবারের বেশি যায় নি— প্রথমবার গিয়েছিল তিনি ওখানে ওই ব্যবস্থাটি গ্রহণ করার অব্যবহিত পরেই, যখন একটা প্রক্রিয়াগত সমস্যায় তেংগোর দরকার পড়ল, যেহেতু সে ছিল একমাত্র আত্মীয়, সেখানে তাকে লাগবে। দ্বিতীয়বারও যেতে হয়েছিল প্রশাসনিক কোনো একটা ঝামেলার কারণে। এই দুবারই, ব্যস।
স্বাস্থ্যনিবাসটি দাঁড়িয়ে আছে সৈকতের ধারের একটা বড় জমির উপর। অভিজাত একটি পুরানো কাঠের ভবনের পাশে তিনতলা কংক্রিটের ভবনটা ছিল একটা অদ্ভুত সমন্বয়। ছিল বিশুদ্ধ বাতাস, আর ঢেউয়ের গর্জন ছাড়া জায়গাটি ছিল সর্বদা শান্ত। বাগানের প্রান্ত বরাবর লাগানো পাইন-বীথিকা গড়ে তুলেছিল একটা সারি। চিকিৎসা সুবিধা ছিল দুর্দান্ত। তার স্বাস্থ্য-বীমা, অবসরের বোনাস, সঞ্চয় এবং পেনশন দিয়ে তেংগোর বাবা হয়তো নিজের বাকি জীবনটা বেশ আরামেই কাটাতে পারবেন। তিনি অবশ্যই পেছনে কোনো বিশাল উত্তরাধিকার রেখে যাবেন না, কিন্তু অন্তত তার যত্নটা ভালোভাবে হবে, যার জন্য তেংগো খুবই কৃতজ্ঞ। বাবার কাছ থেকে তার কিছু পাওয়ার কিংবা তাকে কিছু দেবার অভিলাষ নেই। তারা দুজন আলাদা মানব সত্তা, যারা এসেছে একেবারেই আলাদা জায়গায় এবং আছেও আলাদা জায়গায়। দৈবাৎ তারা কিছু বৎসরকাল একসঙ্গে কাটিয়েছে— ব্যস। এটা লজ্জাজনক যে ব্যাপারটি এমন হয়েছে, কিন্তু তেংগোর এতে একেবারেই কিছু করার ছিল না।
তেংগো তার বিল শোধ করল এবং প্ল্যাটফর্মে গেল তাতেইয়ামার ট্রেনের অপেক্ষা করতে। তার সহযাত্রী ছিল সুখী দেখতে কিছু পরিবার যারা কয়েকটা দিন সমুদ্র সৈকতে কাটাতে যাচ্ছে।
প্রায় সবাই রবিবারকে দেখে বিশ্রামের দিন হিসেবে। তার শৈশবজুড়ে, যাহোক, তেংগো রবিবারকে কখনো আমোদের দিন হিসেবে দেখে নি। তার জন্য রবিবার ছিল কদাকার চাঁদের মতো যা কেবল তার অন্ধকার পিঠটাই দেখায়। যখন সপ্তাহ শেষ হতো, তার সমস্ত শরীর আলসেমি আর ব্যথায় ভরে উঠত, আর তার ক্ষুধা যেত গায়েব হয়ে। সে এমনকি প্রার্থনা করতো যেন রবিবারগুলো না আসে, যদিও তার প্রার্থনা কখনো কবুল হয় নি।
তেংগো যখন বালক, তার বাবা জাপানের আধা-সরকারি রেডিও ও টেলিভিশন নেটওয়ার্ক এনএইচকে-র গ্রাহক চাঁদা সংগ্রহের কাজ করতেন। আর, প্রতি রবিবার তেংগোকে সঙ্গে নিতেন যখন তিনি মানুষের দ্বারে দ্বারে পাওনার জন্য দেনদরবার করতে যেতেন। তেংগোকে এই ঘোরাঘুরিতে যাওয়া শুরু করতে হয়েছিল তার কিন্ডারগার্টেনে ঢোকার আগে এবং এটা চলেছিল পঞ্চম শ্রেণিতে ওঠা পর্যন্ত, কোনো একটি সপ্তাহের বিরতি ছাড়া। তার ধারণা ছিল না যে, এনএইচকের অন্য সংগ্রহকারীরাও রবিবারেই কাজ করে কিনা, তবে তার যতদূর মনে পড়ে, তার বাবা তেমনি করতেন। তার বাবা এমনকি স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উদ্যম নিয়ে করতেন— তার একটাই কারণ হতে পারে, রবিবারগুলিতে তিনি তাদের পেতে পারতেন যারা অন্য দিনগুলিতে কাজের কারণে বাইরে থাকতেন।
ঘোরাঘুরিতে তাকে সঙ্গে নেবার পক্ষে তেংগোর বাবার কিছু যুক্তি ছিল। একটা কারণ ছিল তিনি বালক বয়সী তেংগোকে একা বাসায় রেখে যেতে পারতেন না। সপ্তাহের অন্যদিন কিংবা রবিবারগুলিতে তেংগো ইশকুল বা শিশুযত্নকেন্দ্রগুলিতে যেতে পারতো কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলি রবিবারে বন্ধ থাকতো। অন্য কারণ যেটা তেংগোর বাবা বলতেন, একজন বাবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, তিনি সন্তানকে দেখাবেন কী ধরনের কাজ তিনি করেন। একজন শিশুর আগেভাগেই জানা উচিত কোন ধরনের কাজ তাকে পরিপোষণ করছে এবং তার কদর করা উচিত শ্রমের গুরুত্বকে। তেংগোর বাবাকেও কাজ করতে পাঠানো হয়েছিল তার বাবার খামারে, রবিবারের মতো অন্যান্য দিনেও, যে সময় থেকে তার কোনো কিছু বোঝার বয়স হয়েছে। কর্মব্যস্ততার মরশুমগুলিতেও এমনকি তাকে ইশকুলের বাইরে রাখা হয়েছিল। তার জন্য এরকম জীবনটাই লেখা ছিল।
তেংগোর বাবার তৃতীয় এবং চূড়ান্ত যুক্তিটি ছিল আরও বেশি বিচক্ষণ, সেটাই ছিল কারণ যা তার সন্তানের হৃদয়ে গভীর ক্ষত রেখে গিয়েছিল। তেংগোর বাবা খুব ভালো করেই সচেতন ছিলেন একটা ছোট শিশু সঙ্গে থাকলে তার কাজটা সহজতর হয়। এমনকি যেসব লোক চাঁদা না দেবার ব্যাপারে সংকল্পবদ্ধ মাঝে মধ্যে তারাও টাকা দিয়ে বসে যখন একটা ছোট্ট ছেলে তাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সবচেয়ে কঠিন রাস্তাগুলো রবিবারের জন্য রেখে দেবার সেটাই ছিল কারণ। তেংগো শুরু থেকেই বুঝতে পেরেছিল যে, এই ভূমিকাটাই তার বাবা চাইতেন, আর সে চূড়ান্তভাবে ঘৃণা করতো এটা। তবে সে এটাও অনুভব করতো যে যতটা চালাকির সঙ্গে পারা যায় অভিনয়টা তাকে করতে হবে যাতে তার বাবা খুশি হন। সে তার বাবাকে খুশি করতে পারলে সেদিন বাবা তার সঙ্গে সদয় আচরণ করতেন। যেন সে ছিল একটা প্রশিক্ষিত বানর।
তেংগোর একটা সান্ত্বনা ছিল যে বাবার কারবার ছিল বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তারা থাকতো ইচিকাওয়া শহরের বাইরে উপশহরীয় আবাসিক জেলায়, আর তার বাবাকে ঘোরাঘুরি করতে হতো শহরের কেন্দ্রে। অন্ততপক্ষে সে তার সহপাঠীদের বাড়িগুলি থেকে চাঁদা সংগ্রহের ব্যাপারটা পাশ কাটাতে সমর্থ হতো। মাঝে মধ্যে, যদিও শহরকেন্দ্রের বাণিজ্যিক এলাকায় হাঁটাহাঁটির সময় দু’একজন সহপাঠীর সঙ্গে দেখা হয়ে যেত রাস্তায়। যখন এটা ঘটতো সে তার বাবার পেছনে গিয়ে আশ্রয় নিত যাতে তাকে দেখা না যায়।
সোমবারের সকালগুলোতে তার ইশকুলের বন্ধুরা খুব উত্তেজিতভাবে আগের দিন তারা কোথায় গেছে, কী করেছে, এসব বলতো। তারা যেত প্রমোদউদ্যানে এবং চিড়িয়াখানায় আর বেসবল খেলতে। গ্রীষ্মে তারা যেত সাঁতার কাটতে আর শীতে যেত স্কিইং করতে। কিন্তু তেংগোর বলবার কোনো বিষয় ছিল না। রবিবারের সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সে এবং তার বাবা অপরিচিতদের বাড়ির দরজায় বেল বাজাত, তাদের মাথা নমিত করে দাঁড়াত এবং দরজায়…
গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।
 
					