অনেকদিন হলো কিছুই লিখতে পারি না । কখনো খাতা কখনো মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের শাদা পৃষ্ঠা খুলে বসে থাকি। মাথার ভেতরে অজস্র দৃশ্য,তারাও হয়তো মুদ্রিত হতে চায়। কিন্তু আমার খাতা বা মাইক্রোসফট ওয়ার্ডের পাতা শাদাই থেকে যায়। অপেক্ষারত দৃশ্যগুলোতে ঝিম ধরে। হয়তো মরে যায় তারা অপেক্ষা করতে করতেই, মগজে। নাকি হৃদয়ে?
হৃদয় কী আসলে? হৃদয় বলতে কিছু কি আছে? বিজ্ঞান বলে হৃদয় হলো কাব্যিকতা। বিজ্ঞানে কাব্যের স্থান নাই। সে সহজে বলে দ্যায়, যাকে আমি/আমরা/তুমি/তোমরা হৃদয় বলো সে আসলে রক্ত সঞ্চালন করার একটি যন্ত্র বাদে কিছুই না। আবারো ভাবি, হৃদয় কী? জীবনানন্দ দাশ বলেছেন, “তবুও হৃদয়ে গান আসে।” কোন সে গান? কেউ লিখেছিল,“ক্ষুধাই সবচেয়ে মৌলিক গান।” অনেকদিনরাত এই ক্ষুধা টের পাওয়ার জন্য স্টার্ভ করেছি। জেগে থেকেছি সারারাত, প্রতিটা মিনিট টের পেয়েছি এই গানকে নিজের ভেতর। এই নাতিশীতোষ্ণ ভূমি, যেখানে আমার বাড়ি, আমাদের বাড়ি— সেইখানে এইগান সবচেয়ে ভালো ও বেশি বাজে ক্ষুধা।
লিখতে না পারার কষ্ট অসীম। একসময় ওয়ার্ডফাইল বন্ধ করে ফ্যালি। খাতা ছুঁড়ে ফেলি। মফস্বল শহরটার সবচেয়ে এককোণার চায়ের দোকান, যেইখানে শুধু রিকশাওয়ালারা আসে, চা খায় সিগারেট খায়– অইখানে যাই। বসি। আমার পোশাক-আশাক দেখে ওরা খানিক সম্ভ্রমে তাকায়। যে রিকশাওয়ালার পাশে আমি বসি সে যেন একটু অপ্রস্তুত হয়।
তার দেয়ালঘেঁষা চেয়ারে সে আরো মিশে যায়, সংকুচিত হয়ে বসে। দুপুরবেলা আমার সামনের চেয়ারে আরেকজন এসে বসে। বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ। চোখ ও দাঁত ঈষৎ লাল। একসময়কার শাদা রঙের শার্টখানি মলিন এক ধরণের ময়লাটে এখন। তার উপরের দুটো বোতাম ছেঁড়া। তার কালো হাতের উপর রগটা দৃশ্যায়মান স্পষ্ট। যেন এই নদীপ্রবণ ভূমির আরেকটি নির্বেগ নদী সেটা। রক্ত ভেইন থেকে ভেইনে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পঞ্চাশবছর বয়সী ক্লান্ত রক্ত। প্লেটলেট ডিস্ট্রিবিউশান হয়তো অনিয়মিত। এই রক্তের অনেকটুকু ঘাম হয়ে ঝরে গ্যাছে। বাকিটুকুও ঝরে যাওয়ার অপেক্ষায়। সে খানিক মুখ হা করে শ্বাস নেয়। আমি জিজ্ঞেস করি, “আপনার কি হাঁপানি?” সে একটা শূন্য হাসি হাসে। শূন্য ও বিষণœ। এই হাসিটুকু শুধু মুখের চামড়ার একটু প্রসারণ। এই হাসি তার চোখকে স্পর্শ করে না। হয়ত অনেকদিন হল তার কোনো হাসি তার চোখ, যেগুলো ঈষৎ রক্তাভ ও প্রোটিনশূন্য, কে স্পর্শ করে নাই। হয়তো চামড়াকে খানিক প্রসারিত করা এইটুকুই হাসির মানে তার কাছে। এটাকে আমার হাসি মনে হয় না। মনে হয় অসুখ। আমি চায়ের দোকানের উপর আবার নজর বুলাই। সবার মুখেই মিইয়ে যাওয়া হাসি। সবার চোখেই অসুখ। এই দোকানটাই একটা আস্ত অসুখ- আমার কাছে এমন মনে হয়। সে দুটো সিঙ্গারা দিতে বলে। দুপুরের খাবার। আমি সাতটাকা দামের যে সিগারেটটা টানছি, যেটা ফেলে এখুনি হয়তো আরেকটা সাতটাকা দামের সিগারেট ধরাবো সেই একটি সিগারেটের দামের চেয়ে আরো একটাকা কমে একজনের দুপুরের খাবার হয়ে যায়। বেশ অবাক লাগে ভেবে। আমি দোকান থেকে বের হই।
একে একে চল্লিশবছর হয়ে গ্যালো আমাদের। একটা মানচিত্র যেটা বুড়ি মাছওয়ালির বামহাতে জন্মদাগ হয়ে ঘুমায়– এইতো আছে শুধু। এই চল্লিশবছরে আমরা জড়ো করেছি শুধু নিবিড় বেদনা, প্রলেতারিয়েত। আমি এই ধূলির মফস্বলে হাঁটি। স্তূপাকৃত ধুলোর বাইরে চোখে আসে শুধু অসুখ। বৃক্ষেরা অসুস্থ। মানুষেরা অসুস্থ। প্রতিটি নিঃশ্বাসের সাথে সাথে আমরা আরো গহিন অসুখের দিকে যাচ্ছি। রাস্তায় শিশুদের ফোলা পেটে অসুখ। বাজারের মাছের কানকোতে অসুখ। মাঠে, ধানক্ষেতের সোনালিতে অসুখ। বৃদ্ধ ঠেলাওয়ালার নীলটুপিতে অসুখ। এই বেদনার মানচিত্রে কোনো মানুষ নেই আর। এরা জন্মায়। হয়তো একদিন ঘুড়ি ওড়ায়। তিনদিন খায় না। হয়তো একদিন মেলায় যায়। সাতদিন ঘুমায় না। এবং একদিন এভাবেই মরে যায়। টুপ করে, নির্বিঘেœ, নির্লিপ্তে মরে যায়। মরে যাওয়া এতো সহজ দেখেও বিশ্বাস হতে চায় না যেন! আমার পাশে ক্রমাগত লাশেদের দেখি। যাদের হাসি কখনো তাদের চোখ স্পর্শ করে নাই। এটাই কি মৃত্যু? যখন তোমার হাসি তোমার চোখকে আর স্পর্শ করবে না তখনই তুমি মরে যাবে?
এইসব প্রোফেসি দেওয়া আমার কাজ না। আমার কাজ লিখা এবং আমি লিখতে পারছি না। তাই আমি হাঁটি। হাঁটতে হাঁটতে মফস্বলের আরো একটু ভেতরের দিকে যাই। নদীর দিকে। অইখানে মূলত জেলেদের বাস। লাল নীল ফিতে পরা চুল নিয়ে জেলেকন্যারা হাঁটে। আমি নদীর পাড়ে দিয়ে বসি। একটা কুকুর যার সাথে কিছুদিন হল পরিচয় সেও এসে আমার পাশে বসে। আমি সিগারেট ধরাই। আমরা বসে থাকি। সন্ধ্যার নদী খিলখিলিয়ে হেসে উঠছে কই? সন্ধ্যার নদী হেসে ওঠে না। স্থিমিত তার স্রোত। নির্বেগ তার প্রবহন। এঞ্জিনের একটি নৌকা খুব সমারোহে দক্ষিণে চলে গ্যালে অবশ নীরবতা নামে নদীর পাড়ে। এক সময় কুকুরটাও চলে যায়। আমি বসেই থাকি। আমার কোথাও পৌছুবার তাড়া নেই— বাড়ি ফেরারও।
একটা পাখি উড়ে যায় নদীর উপর দিয়ে। কী তার নাম জানি না। তবু তাকে আজ পরম আত্মীয় মনে হয় কেন জানি!
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।