সে — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– সপ্তদশ অংশ

গান হবে রঙের সংগত । বড়ো সহজ হবে না । তান যখন ঠিকরে পড়তে থাকবে , ঝলক মারবে আকাশের দিকে দিকে । তখনকার তানসেনরা দিগন্তে অরোরা বোরিয়ালিস বানিয়ে দেবে ।

আর , তোমার গদ্যকাব্য কী হবে বলো তো ।

তাতে লোহার ইলেক্‌ট্রন্ও মিশবে , আবার সোনারও ।

সেদিনকার দিদিমা পছন্দ করবে না ।

আমার ভরসা আছে সেদিনকার আধুনিক নাতনিরা মুগ্ধ হয়ে যাবে ।

তা হলে সেই আলোর যুগে তোমার নাতনি হয়েই জন্মাব । এবারকার মতো দেহধারিণীর ‘পরে ধৈর্য রক্ষা কোরো । এখন চললুম সিনেমায় ।

কিসের পালা ।

বৈদেহীর বনবাস ।

১৪

পরদিন সকালবেলায় প্রাতরাশে আমার নির্দেশমত পুপেদিদি নিয়ে এল পাথরের পাত্রে ছোলাভিজে এবং গুড় । বর্তমান যুগে পুরাকালীন গৌড়ীয় খাদ্যবিধির রেনেসাঁস – প্রবর্তনে লেগেছি। দিদিমণি জিগেস করলে , চা হবে কি ।

আমি বললুম , না , খেজুর – রস ।

দিদি বললে , আজ তোমার মুখখানা অমন দেখছি কেন । কোনো খারাপ স্বপ্ন দেখছ না কি।

আমি বললুম , স্বপ্নের ছায়া তো মনের উপর দিয়ে যাওয়া – আসা করছেই — স্বপ্নও মিলিয়ে যায় , ছায়ারও চিহ্ন থাকে না । আজ তোমার ছেলেমানুষির একটা কথা বারবার মনে পড়ছে , ইচ্ছে করছে বলি ।

বলো – না ।

সেদিন লেখা বন্ধ করে বারান্দায় বসে ছিলুম । তুমি ছিলে , সুকুমারও ছিল । সন্ধে হয়ে এল , রাস্তার বাতি জ্বালিয়ে গেল , আমি বসে বসে সত্যযুগের কথা বানিয়ে বানিয়ে বলছিলুম।

বানিয়ে বলছিলে ! তার মানে ওটাকে অসত্যযুগ করে তুলছিলে।

ওকে অসত্য বলে না । যে রশ্মি বেগ্‌‍নির সীমা পেরিয়ে গেছে তাকে দেখা যায় না বলেই সে মিথ্যে নয় , সেও আলো । ইতিহাসের সেই বেগ্‌নি পেরোনো আলোতেই মানুষের সত্যযুগের সৃষ্টি । তাকে প্রাগৈতিহাসিক বলব না , সে আলট্রা – ঐতিহাসিক।

আর তোমার ব্যাখ্যা করতে হবে না । কী বলছিলে বলো ।

আমি তোমাদের বলছিলুম , সত্যযুগে মানুষ বই পড়ে শিখত না , খবর শুনে জানত না , তাদের জানা ছিল হয়ে – উঠে জানা।

কী মানে হল বুঝতে পারছি নে ।

একটু মন দিয়ে শোনো বলি । বোধ হয় তোমার বিশ্বাস তুমি আমাকে জান ?

দৃঢ় বিশ্বাস ।

জান কিন্তু সে জানায় সাড়ে – পনেরো আনাই বাদ পড়ে গেছে । ইচ্ছে করলেই তুমি যদি ভিতরে ভিতরে আমি হয়ে যেতে পারতে তা হলেই তোমার জানাটা সম্পূর্ণ সত্য হত ।

তা হলে তুমি বলতে চাও আমরা কিছুই জানি নে ?

জানিই নে তো । সবাই মিলে ধরে নিয়েছি যে জানি , সেই আপোসে ধরে নেওয়ার উপরেই আমাদের কারবার ।

কারবার তো ভালোই চলছে ।

চলছে , কিন্তু এ সত্যযুগের চলা নয় । সেই কথাই তোমাদের বলছিলুম — সত্যযুগে মানুষ দেখার জানা জানত না , ছোঁওয়ার জানা জানত না , জানত একেবারে হওয়ার জানা ।

মেয়েদের মন প্রত্যক্ষকে আঁকড়ে থাকে ; ভেবেছিলেম আমার কথাটা অত্যন্ত অবাস্তব ঠেকবে পুপুর কাছে , ভালোই লাগবে না । দেখলুম একটু ঔৎসুক্য হয়েছে । বললে , বেশ মজা ।

একটু উত্তেজিত হয়ে উঠেই বললে , আচ্ছা , দাদামশায় , আজকাল তো সায়ান্সে অনেক বুজ্‌রুগি করছে ; মরা মানুষের গান শোনাচ্ছে , দূরের মানুষের চেহারা দেখাচ্ছে , আবার শুনছি সীসেকে সোনা করছে — তেমনি একদিন হয়তো এমন একটা বিদ্যুতের খেলা খেলাবে যে ইচ্ছে করলে একজন আর-একজনের মধ্যে মিলে যেতে পারবে ।

অসম্ভব নয় । কিন্তু , তুমি তা হলে কী করবে । কিছুই লুকোতে পারবে না ।

সর্বনাশ ! সব মানুষেরই যে লুকোবার আছে অনেক ।

লুকোনো আছে বলেই লুকোবার আছে । যদি কারও কিছুই লুকোনো না থাকত তা হলে দেখা – বিন্‌‍তি খেলার মতো সবার সব জেনেই লোকব্যবহার হত ।

কিন্তু , লজ্জার কথা যে অনেক আছে ।

লজ্জার কথা সকলেরই প্রকাশ হলে লজ্জার ধার চলে যেত ।

আচ্ছা , আমার কথা কী বলতে যাচ্ছিলে তুমি ।

সেদিন আমি তোমাকে জিগেস করছিলুম , তুমি যদি সত্যযুগে জন্মাতে তবে আপনাকে কী হয়ে দেখতে তোমার ইচ্ছে হত । তুমি ফস্‌ করে বলে ফেললে , কাবুলি বেড়াল ।

পুপে মস্ত ক্ষাপা হয়ে বলে উঠল , কখ্‌খনো না । তুমি বানিয়ে বলছ ।

আমার সত্যযুগটা আমার বানানো হতে পারে কিন্তু তোমার মুখের কথাটা তোমারই । ওটা ফস্‌ করে আমি – হেন বাচালও বানাতে পারতুম না ।

এর থেকে তুমি কি মনে করেছিলে আমি খুব বোকা ।

এই মনে করেছিলুম যে , কাবুলি বেড়ালের উপর অত্যন্ত লোভ করেছিলে অথচ কাবুলি বেড়াল পাবার পথ তোমার ছিল না , তোমার বাবা বেড়াল জন্তুটাকে দেখতে পারতেন না । আমার মতে সত্যযুগে বেড়াল কিনতেও হত না , পেতেও হত না , ইচ্ছে করলেই বেড়াল হতে পারা যেত ।

মানষ ছিলুম , বেড়াল হলুম — এত কী সুবিধেটা হল । তার চেয়ে যে বেড়াল কেনাও ভালো , না কিনতে পারলে না পাওয়া ভালো ।

ঐ দেখো , সত্যযুগের মহিমাটা মনে ধারণা করতে পারছ না । সত্যযুগের পুপে আপনার সীমানা বাড়িয়ে দিত বেড়ালের মধ্যে । সীমানা লোপ করত না । তুমি তুমিও থাকতে , বেড়ালও হতে । তোমার এ – সব কথার কোনো মানে নেই ।

সত্যযুগের ভাষায় মানে আছে । সেদিন তো তোমাদের অধ্যাপক প্রমথবাবুর কাছে শুনেছিলে , আলোকের অণুপরমাণু বৃষ্টির মতো কণাবর্ষণও বটে আবার নদীর মতো তরঙ্গধারাও বটে । আমাদের সাধারণ বুদ্ধিতে বুঝি , হয় এটা নয় ওটা ; কিন্তু বিজ্ঞানের বুদ্ধিতে একই কালে দুটোকেই মেনে নেয় । তেমনি একই কালে তুমি পুপুও বটে , বেড়ালও বটে — এটা সত্যযুগের কথা ।

দাদামশায় , যতই তোমার বয়স এগিয়ে চলছে ততই তোমার কথাগুলো অবোধ্য হয়ে উঠছে , তোমার কবিতারই মতো ।

অবশেষে সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যাব তারই পূর্বলক্ষণ ।

সেদিনকার কথাটা কি ঐ কাবুলি বেড়ালের পরে আর এগোল না ।

 

এগিয়েছিল । সুকুমার এক কোণে বসে ছিল , সে স্বপ্নে কথা বলার মতো বলে উঠল , আমার ইচ্ছে করে শালগাছ হয়ে দেখতে ।

সুকুমারকে উপহসিত করবার সুযোগ পেলে তুমি খুশি হতে । ও শালগাছ হতে চায় শুনে তুমি তো হেসে অস্থির । ও চমকে উঠল লজ্জায় । কাজেই ও বেচারির পক্ষ নিয়ে আমি বললেম — দক্ষিণের হাওয়া দিল কোথা থেকে , গাছটার ডাল ছেয়ে গেল ফুলে , ওর মজ্জার ভিতর দিয়ে কী মায়ামন্ত্রের অদৃশ্য প্রবাহ বয়ে যায় যাতে ঐ রূপের গন্ধের ভোজবাজি চলতে থাকে । ভিতরের থেকে সেই আবেগটা জানতে ইচ্ছা করে বৈকি ! গাছ না হতে পারলে বসন্তে গাছের সেই অপরিমিত রোমাঞ্চ অনুভব করব কী করে ।

গল্পের অষ্টদশতম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!