মনে করো , আমাদের মাস্টারমশায় । তিনি অদ্ভুত ছিলেন , কিন্তু খাঁটি অদ্ভুত । তাই তাঁকে এত ভালো লাগত ।
আচ্ছা , তাঁর কথাটা একটু ধরিয়ে দাও – না ।
আজও তাঁর মুখখানা স্পষ্ট মনে পড়ে । ক্লাসে বসতেন যেন আলগোছে , বইগুলো ছিল কণ্ঠস্থ । উপরের দিকে তাকিয়ে পাঠ বলে যেতেন , কথাগুলো যেন সদ্য ঝরে পড়ছে আকাশ থেকে । আমরা ক্লাসে উপস্থিত থাকব , মন দিয়ে পড়া শুনব , সে গরজটা সম্পূর্ণ আমাদেরই বলে তিনি মনে করতেন।
তিনি তোমাদের মুখ চেনবার সুযোগ পান নি বোধ হয় ।
চেষ্টাও করেন নি । একদিন ছুটির দরবার নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকতেই তিনি শশব্যস্ত হয়ে চৌকি ছেড়ে উঠে পড়লেন ; মনে করলেন , আমি বুঝি যাকে বলে একজন রীতিমত মহিলা ।
অমনতরো অভাবনীয় ভুল করা তাঁর অভ্যস্ত ছিল ।
ছিল বৈকি । তোমার দাড়ি দেখে কোনোদিন তোমাকে নবাব খাঞ্জেখাঁর প্রাইভেট সেক্রেটারি বলে ভুল করেন নি তো ? না ,
ঠাট্টা নয় , তিনি তো তোমার বন্ধু ছিলেন , বলো – না তাঁর কথা।
তাঁর শত্রু কেউ ছিল না , কিন্তু সমজদার বন্ধু ছিলুম একলা আমি । লোকে যখন তাঁর খ্যাপামির কথা রটাত তিনি আশ্চর্য হয়ে যেতেন । একদিন আমাকে এসে বললেন , সবাই বলছে , আমি ক্লাস পড়াই কিন্তু ক্লাসের দিকে তাকাই নে ।
আমি বললুম , তোমার সাঙাৎরা তোমার বিদ্যের দোষ ধরতে পারে না , তোমার বুদ্ধির দোষ ধরে । তারা বলে , তোমার পড়ানোর ভুল হয় না কিন্তু পড়াচ্ছ যে সেইটেই ভুলে যাও ।
পড়াচ্ছি যদি না ভুলি তবে পড়াতে পারতুম না , নিছক মাস্টারিই করে যেতুম । পড়ানোটা নিঃশেষে হজম হয়ে গেছে , ওটা নিয়ে মনটা আইঢাই করে না ।
জলচর জলে সাঁতার দিলে টের পাওয়া যায় না , স্থলচর দিলে সেটা খুবই মালুম হয় । তুমি অধ্যাপন – সরোবরের গভীর জলের মাছ ।
আমি যদি ছাত্রদের দিকে তাকাই তবে ক্লাসের দিকে মন দেব কী করে ।
তোমার সেই ক্লাসটা আছে কোথায় ।
কোত্থাও না , সেইজন্যেই তো বাধা পাই নে । ছাত্ররাই যদি আমার চোখ জুড়ে বসে তা হলে ক্লাসের আত্মাপুরুষটা আড়ালে পড়ে যে ।
‘ পড়ো বাবা আত্মারাম’ এই বুঝি তোমার বুলি ?
পড়াচ্ছি কই । আমার আত্মারামকেই টহল দেওয়াচ্ছি ।
তোমার প্রণালীটা কিরকম ।
গঙ্গাধারার বহে যাবার প্রণালী যেরকম । ডাইনে বাঁয়ে কোথাও মরু , কোথাও ফসল , কোথাও শ্মশান , কোথাও শহর । এই নিয়ে গঙ্গামায়ীকে পদে পদে বিচার করতে যদি হত তা হলে আজ পর্যন্ত সগরসন্তানদের উদ্ধার হত না । যাদের যতটা হবার তাই হয় , বিধাতার সঙ্গে টক্কর দিয়ে তার চেয়ে বেশি হওয়াতে গেলেই চলা বন্ধ । আমার পড়ানো চলে মেঘের মতো শূন্য দিয়ে , বর্ষণ হয় নানা খেতে , ফসল ফলে খেত – অনুসারে । অসম্ভবকে নিয়ে ঠেলাঠেলি করে সময় নষ্ট করি নে বলে হেড্মাস্টার হন ক্ষাপা । ঐ হেড্মাস্টারটিকেও অত্যন্ত সত্য বলে গণ্য করলে অত্যন্ত ভুল করা হয় ।
পুপু বললে , ছাত্রীদের অনেকে মনে মনে খুঁত খুঁত করত । তাদের লক্ষ্য করে একদিন বলেছিলেন , এখানে যে মাস্টারটা আছে তাকে নেই করে দিয়েছি তোমাদের নিজের মনকেই বেড়ে ওঠবার জায়গা করে দেবার জন্যেই । আর – একদিন তিনি বলেছিলেন মাস্টারিতে আমি হচ্ছি ক্লাসিক , আর সিধুবাবু রোমাণ্টিক । বলা বাহুল্য , মাস্টারমশায়ের কথাটা আমরা কিছুই বুঝতে পারি নি ।
মনে হচ্ছে , মাস্টার সমগ্র ক্লাসকেই দিতেন উপরে তুলে , আর সিধু ছাত্রদের একে একে নিজের কাঁধে চড়িয়ে গর্তগাড়ি পার করত । বুঝেছ ?
না , বোঝবার দরকার নেই । তুমি তাঁর কথা বলে যাও , মজা লাগে শুনতে ।
আমারও লাগে , কেননা লোকটাকে বুঝতে লাগে দেরি । একদিন চীন – দার্শনিকের দোহাই দিয়ে মাস্টার আমাকে বললে , যে রাজ্যে রাজত্বটা নেই সেই রাজ্যই সকল রাজ্যের সেরা ।
পুপে সগর্বে বললে , আমাদের ক্লাস সেরা ক্লাস ছিল সন্দেহ নেই ।
আমি বললুম , তার কারণ , প্রমাণ সত্ত্বেও তোমার কম বুদ্ধির লক্ষণ মাস্টার লক্ষ্য করতেন না ।
পুপে মাথা ঝাঁকিয়ে বললে , এটাকে কি গাল বলব না ঠাট্টা ।
আমি বললুম , পাশ দিয়ে যেতে যেতে তোমার চুলটা টেনে দিই , এ ঠাট্টা সেই স্নিগ্ধ জাতের । এতে ক্যাসাস ব্যালাই অর্থাৎ ‘অদ্য যুদ্ধ ত্বয়া ময়া’র ঘোষণা নেই ।
পুপে বললে , মাস্টারমশায়ের ব্যবস্থা ছিল মজার রকমের । তিনি বলতেন , তোমাদের নিজের খবর নিজেই রাখবে ; তোমাদের খবরদারি করবার কাজ আমার নয় । প্রতিদিনের পড়ার ফল নিজেরাই রাখতুম ; মার্কা দেবার নিয়ম জানা ছিল ।
তার ফল কী হল ।
মার্কা বরঞ্চ কম করেই দিতুম ।
কখনো কি ঠকাতে না ।
বাইরের কেউ মার্কা দেবার থাকলে তাকে ঠকাবার লোভ হতে পারত । নিজেকে ঠকানো বোকামি । বিশেষত তিনি তো দেখতেন না ।
তার পরে ?
তার পরে প্রত্যেক তিন মাস অন্তর নিজেরাই হিসেব করে জানতুম উঠছি কি নাবছি ।
তোমাদের কি সত্যযুগের হাইস্কুল , অত্যন্ত হাই ? ফাঁকি দেবার লোকই বুঝি ছিল না ?
মাস্টারমশায় ছিলেন অবিচলিত । তিনি বলতেন , সংসারে একদল লোক ফাঁকি দেবেই । কিন্তু , নিজের দায় যাদের নিজের হাতে , ওরই মধ্যে তারাই কম ফাঁকি দেয় । আমাদের শাস্তিও ছিল ঐ জাতের । বাইরে থেকে না । একদিন হাজিরি নাম – ডাক উপলক্ষে প্রিয়সখীর পর্সেণ্টেজ বাঁচাবার জন্যে মিথ্যে কথা বলে ফেলেছিলুম । তিনি বললেন , অশুচি হয়েছ , প্রায়শ্চিত্ত কোরো । তিনি জানতেও চাইতেন না করেছি কি না ।
প্রায়শ্চিত্ত কি করেছিলে ।
নিশ্চয়ই করেছিলুম ।
অর্থাৎ , তোমার পাউডারের কৌটোটা ঐ প্রিয়সখীকে দান করেছিলে ?
আমি কখ্খনো পাউডর মাখি নে ।
বলতে চাও , তোমার ঐ মুখের রঙ তোমার খাস নিজেরই ?
আর যাই হোক তোমার কাছ থেকে ধার নিই নি , মিলিয়ে দেখলেই বুঝতে পারবে ।
ছি , আমাকে নিয়ে তোমার দৃষ্টিতে যদি ভেদবুদ্ধি দেখা দেয় তা হলে জাতে দোষারোপ ঘটে । আমরা যে সবর্ণ — বর্ণভেদের জো কী । হাতের কাছে কবি থাকলে বলতেন , তোমার গায়ের রঙ ফুটে বেরিয়েছে ব্রহ্মার হাসি থেকে ।
আর তোমার রঙ তাঁর ঠাট্টার হাসি থেকে ।
একেই বলে অন্যোন্যস্তুতি , ম্যুচূয়ল অ্যাড্মিরেশন । পিতামহের দুই জাতের হাসি আছে — একটা দন্ত্য , একটা মূর্ধন্য । আমাতে লেগেছে মূর্ধন্য হাসি , ইংরেজিতে তাকে বলে উইট ।
দাদামশায় , নিজের গুণগান তোমার মুখে কখনো বাধে না ।
সেইটেই আমার প্রধান গুণ । আপনাকে যারা জানে আমি সেই অসামান্যের দলে ।
মুখ খুলে গেছে , কিন্তু আর নয় , এবার থামো । মাস্টারমশায়ের কথা হচ্ছিল , এখন উঠে পড়ল তোমার নিজের কথা ।
তাতে দোষ হয়েছে কী । বিষয়টা তো উপাদেয় , যাকে বলে ইণ্টারেস্টিঙ ।
বিষয়টা সর্বদাই রয়েছে সামনে । তাকে তো স্মরণ করবার দরকার হয় না । তাকে যে ভোলাই শক্ত ।
আচ্ছা , তা হলে মাস্টারের একটা বিশেষ পরিচয় দিই তোমাকে । এটা টুকে রাখবার যোগ্য । একদিন সন্ধেবেলায় মাস্টার জনকয়েক লোককে নেমন্তন্ন করেছিল । খবরটা তার মনে আছে কি না জানবার জন্যে সকাল – সকাল গেলুম তার বাড়িতে । সেবক কানাইয়ের সঙ্গে তার যে আলোচনাটা চলছিল , বলি সে কথাটা । কানাই বললে , জগদ্ধাত্রীপুজোর বাজারে গলদা চিংড়ির দাম চড়ে গেছে , তাই এনেছি ডিমওয়ালা কাঁকড়া ।
মাস্টার ঈষৎ চিন্তিত হয়ে বলে , কাঁকড়া কী হবে ।
ও বললে , লাউ দিয়ে ঝোল , সে তোফা হবে ।
আমি বললুম , মাস্টার , গল্দা চিংড়ির উপর তোমার লোভ ছিল ?
মাস্টার বললে , ছিল বৈকি ।
তা হলে তো লোভ সংবরণ করতে হবে ।
তা কেন । লোভটা প্রস্তুত হয়েই আছে , তাকে শাণ্ট্ করে চালিয়ে দেব কাঁকড়ার লাইনে ।
দেখছি , তোমাকে বিস্তর শাণ্ট্ করতে হয় ।
মাস্টার বললে , কাঁকড়ার ঝোল তো খেয়েছি অনেকবার , সম্পূর্ণ মন দিই নি । এবার যখন দেখলুম কানাইয়ের জিভে জল এসেছে , তখন তার সিক্ত রসনার নির্দেশে খাবার সময় মনটা ঝুঁকে পড়বে কাঁকড়ার দিকে , রসটা পাব বেশি করে । কাঁকড়ার ঝোলটাকে ও যেন লাল পেন্সিলে আণ্ডর্লাইন করে দিলে ; ওটাকে ভালো করে মুখস্থ করবার পক্ষে সুবিধে হল আমার ।
মাস্টার জিগেস করলে , আঁঠি – বাঁধা ওটা কী এনেছিস ।
কানাই বললে , সজনের ডাঁটা ।
মাস্টার সগর্বে আমার দিকে চেয়ে বললে , এই দেখো মজা । ও বাজারে যাবার সময় আমার মনে ছিল লাউডগা । ও বাজার থেকে ফিরে এল , আমি পেয়ে গেলুম সজনের ডাঁটা । হুকুম না করবার এই সুবিধে ।
আমি বললুম , সজনের ডাঁটা না এনে ও যদি আনত চিচিঙ্গে ?
মাস্টার জবাব দিলেন , তা হলে ক্ষণকালের জন্যে ভাবনা করতে হত । নাম জিনিসটার প্রভাব আছে । চিচিঙ্গে শব্দটা লোভজনক নয় । কিন্তু , কানাই যদি ওটা বিশেষ করে বাছাই করে আনত , তা হলে সংস্কার কাটাবার একটা উপলক্ষ হত । জীবনে সব – প্রথমে ভেবে দেখবার সুযোগ হত ‘দেখাই যাক – না’ ; হয়তো আবিষ্কার করতুম , ওটা মন্দ চলে না । চিচিঙ্গে পদার্থটার বিরুদ্ধে অন্ধ বিরাগ দূর হয়ে উপভোগ্যের সীমানা বেড়ে যেত । এমনি করেই কাব্যে কবিরা তো নিজের রুচিতে আমাদের রুচির প্রসার বাড়িয়ে দিচ্ছে । সৃষ্টিকে আণ্ডর্লাইন করাই তাদের কাজ ।
তোমার রুচির প্রসার বাড়াবার কাজে কানাইয়ের আরো এমন হাত আছে ?
আছে বৈকি । ও না থাকলে পিড়িং শাকে আমি কোনোদিন মনোযোগই দিতুম না । শব্দটা আমাকে মারত ধাক্কা । সংসারে সংস্কারমুক্তিই তো অধিকারব্যাপ্তি ।
সেই মহৎ কাজে আছে তোমার কানাই ।
তা মানতে হবে , ভাই। ওর ইচ্ছার যোগে আমার ইচ্ছার সংকীর্ণতা ঘুচে যায় প্রতিদিন। আমি একলা থাকলে এমনটা ঘটত না।
বুঝলুম , কিন্তু কানাইয়ের ইচ্ছার সীমানাটা —
বাড়িয়েছি বৈকি । পূর্ববঙ্গের লোক , কলাইয়ের ডালের নাম শুনতে পারত না । আজকাল হিঙ দিয়ে কলাইয়ের ডাল ও খাচ্ছে বেশ ।
এমন সময়ে কানাইয়ের পুনঃপ্রবেশ । বললে , একটা কথা বলতে ভুলে গেছি , আজ দইটা আনি নি । কবরেজমশায় বলেন , রাত্রে দইটা বারণ ।
দইয়ের দাম চড়ে গেছে বললে দ্বিরুক্তি হয় , এইজন্যে কবরেজমশায়কে পাড়তে হল । সান্ত্বনা দেবার জন্যে বললে , অল্প একটু আদার রস মিশিয়ে পাতলা চা বানিয়ে দেব , শীতের রাত্রে উপকার দেবে ।
আমি জিগেস করলেম , কী বল হে মাস্টার , আদা দিয়ে চা সবাইকে খাওয়াবে না কি ।
সবাইকার কথা বলব কী করে । যারা খাবে তারা খাবে । হতে পারে উপকার । যারা খাবে না তাদের অপকার হবে না ।
আমি বললুম , মাস্টার , চীন – দার্শনিকের উপদেশমতে তোমার গেরস্থালিতে মনিব নেই বুঝি ?
না ।
তা হলে চাকরই বা আছে কেন ।
মনিব না থাকলেই চাকর স্বতই থাকে না ।
তোমার এখানে চাকরে মনিবে বেমালুম মিশিয়ে গিয়ে একটা যৌগিক পদার্থ খাড়া হয়েছে বুঝি ?
মাস্টার হেসে বললে , অক্সিজেন হাইড্রোজেন দাহ্য মেজাজ ঘুচে দোঁহে মিলে একেবারে জল ।
আমি বললুম , যদি বিয়ে করতে ভায়া , পাড়া ছেড়ে চীনের দর্শন দৌড় দিত । থেকেও থাকবে না , গিন্নি এমন নির্বিশেষ পদার্থ নয় । মুখের উপর ঘোমটা টেনেও তোমার সংসারে সে হত অতিশয় স্পষ্ট । তার রাজ্যে রাজত্বটা তার কটাক্ষে খেত দোলা ; সর্বদা ধাক্কা লাগাত , কখনো পিঠে , কখনো বুকে ।
মাস্টার বললে , তা হলে কর্তা রিটর্ন্ টিকিট না কিনেই দৌড় মারত ডেরাগাঁজিখাঁয়ে , গিন্নিত্ব অন্তর্ধান করতে ইস্টার্ন্ বেঙ্গল রেলের রাস্তা বেয়ে বাপের বাড়িতে ।
মাস্টার মাঝে মাঝে হাসির কথা বলে , কিন্তু হাসে না ।
পুপুদিদি বললে , আমাদের মাস্টারমশায়কে নিয়ে যদি গল্পের পালা বাঁধতে হয় কিরকম করে বাঁধ ।
তা হলে দশ লক্ষ বছর বাদ দিই ।
তার মানে , আজগুবি গল্প বানাতে , অথচ আজকের দিনের বিরুদ্ধ – পক্ষের সাক্ষীর শঙ্কা থাকত না ।
কোনো সাহিত্যওয়ালা কখনো সাক্ষীর ভয় করে না । আসল কথা , আমার গল্পটা ফুটে উঠতে যুগান্তরের দরকার করবে । কেন , সেইটে বুঝিয়ে বলি — পৃথিবী – সৃষ্টির গোড়াকার মালমসলা ছিল পাথর লোহা প্রভৃতি মোটামোটা ভারী ভারী জিনিস । তারই ঢালাই পেটাই চলেছিল অনেককাল । কঠোরের বে – আব্রুতা ছিল বহু যুগ ধরে । অবশেষে নরম মাটি পৃথিবীকে শ্যামল আস্তরণে ঢাকা দিয়ে সৃষ্টিকর্তার যেন লজ্জা রক্ষা করলে । তখন জীবজন্তু আসরে নামল স্তূপাকার হাড়মাংসের বোঝাই নিয়ে ; মোটা মোটা বর্ম পরে তারা দুশো পাঁচশো মোন অসভ্য লেজ টেনে টেনে বেড়াতে লাগল । তারা ছিল দর্শনধারী জীব । কিন্তু সেই মাংসবাহীর দল সৃষ্টিকর্তার পছন্দসই হল না । আবার চলল বহু যুগে ধরে নিষ্ঠুর পরীক্ষা । শেষকালে এল মনোবাহী মানুষ । লেজের বাহুল্য গেল ঘুচে , হাড়মাংস হল পরিমিত , কড়া চামড়াটা নরম হয়ে এল ত্বকে । না রইল শিঙ , না রইল ক্ষুর , না রইল নখের জোর , চার পা এসে ঠেকল দুটিমাত্র পায়ে । বোঝা গেল , বিধাতা তাঁর হাতিয়ার চালাচ্ছেন সৃষ্টির যুগটাকে ক্রমশ সূক্ষ্ম করে আনবার জন্যে । স্থূলে সূক্ষ্মে জড়িয়ে আছে মানুষ । মনের সঙ্গে মাংসের চলেছে ঠেলাঠেলি মারামারি । বিধাতা পুনশ্চ মাথা নাড়ছেন , উঁহু , হল না । লক্ষণ দেখা যাচ্ছে , এটাও টিঁকবে না ; এ আপনিই আপনাকে নিকেশ করে দেবে আশ্চর্য বৈজ্ঞানিক উপায়ে । যাবে কয়েক লক্ষ বছর কেটে । মাংস পড়বে ঝরে , মন উঠবে একেশ্বর হয়ে । সেই বিশুদ্ধ মনের যুগে তোমার মাস্টারমশায় বসেছেন শরীররিক্ত ক্লাসে । মনে করে দেখো , তাঁর শিক্ষা দেবার প্রণালী হচ্ছে ছাত্রদের মধ্যে নিজেকে মেলাতে থাকা মনের উপর মন বিছিয়ে , বাইরের বাধা নেই বললেই হয় ।
স্থূল বুদ্ধির বাধাও নেই ?
সেটা না থাকলে বুদ্ধি মাত্রই হয়ে পড়ে বেকার । ভালো – মন্দ বোকা – বুদ্ধিমানের ভেদ আছেই । চরিত্র আছে নানা রকমের । ভাবের বৈচিত্র্য আছে , ইচ্ছার স্বাতন্ত্র্য আছে । এখন তিনিই ভালো মাস্টার যিনি সেই অনেকের মধ্যে প্রবেশ করতে পারেন , শিক্ষা এখন অন্তরে অন্তরে ।
দাদামশায় , ইস্কুলটা কোথায় আছে সেটা ঠিক মনে আনতে পারছি নে ।
পৃথিবীতে তিনটে বাসা আছে — এক সমুদ্রতলে , আর – এক ভূতলে , আর আছে আকাশে যেখানে সূক্ষ্ম হাওয়া আর সূক্ষ্মতর আলো । এইখানটা আজ আছে খালি আগামী যুগের জন্যে ।
তা হলে তোমার ক্লাস চলেছে সেই হাওয়ায় সেই আলোয় । কিন্তু , ছাত্রদের চেহারাটা কিরকম ।
বুঝিয়ে বলা শক্ত , তাদের আকার নিশ্চয়ই আছে , কিন্তু আকারের আধার নেই ।
তা হলে বোধ হচ্ছে নানা রঙের আলোয় তারা গড়া ।
সেইটেই সম্ভব । তোমাদের বিজ্ঞান – মাস্টার তো সেদিন বুঝিয়ে দিয়েছেন , বিশ্বজগতে সূক্ষ্ম আলোর কণাই বহুরূপী হয়ে স্থূল রূপের ভান করছে । সেদিন আলো আপন আদিম সূক্ষ্মরূপেই প্রকাশ পাবে । ক্লাসে তোমরা সবাই আলো করে বসবে । সেদিন ওটিন – স্নো – ওয়ালারা একেবারে দেউলে হয়ে গেছে ।
দেউলে কেন , আলো হয়ে গেছে ।
দেউলে হয়ে যাওয়ার মানেই তো আলো হয়ে যাওয়া ।
আমি কোন্ রঙের আলো হব , দাদামশায় ।
সোনার রঙের !
আর তুমি ?
আমি একেবারে বিশুদ্ধ রেডিয়ম ।
সেদিন আলোয় আলোয় লড়াই হবে না তো ? ইলেক্ট্রন নিয়ে হবে না কি কাড়াকাড়ি ।
ভাবনা ধরিয়ে দিলে । লীগ অব লাইট্স্ – এর দরকার হবে বোধ হচ্ছে । ইলেকট্রন নিয়ে টানাটানির গুজব এখনই শুনতে পাচ্ছি ।
ভালোই তো , দাদামশায় । বীররসের কবিতা তোমার ভাষায় উজ্জ্বল বর্ণে বর্ণিত হবে । ঐ যাঃ , ভাষা থাকবে তো ?
শব্দের ভাষা নিছক ভাবের ভাষায় গিয়ে পৌঁছবে , ব্যাকরণ মুখস্থ করতে হবে না ।
আচ্ছা , গান ?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।