সে — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– চতুর্থ অংশ

 গেছো বাবা

 উধো । কী রে , সন্ধান পেলি ?

গোবরা । আরে ভাই , তোমার কথা শুনে আজ মাসখানেক ধরে বনে – বাদাড়ে ঘুরে ঘুরে হাড় মাটি হল , টিকিও দেখতে পেলুম না।

পঞ্চু । কার সন্ধান করছিস রে।

গোবরা । গেছো বাবার ।

পঞ্চু । গেছো বাবা ? সে আবার কে রে ।

উধো । জানিস নে ? বিশ্বসুদ্ধ লোক তাকে জানে ।

পঞ্চু । তা , গেছো বাবার ব্যাপারটা কী শুনি ।

উধো । বাবা যে – গাছে চড়ে বসবে সেই গাছই হবে কল্পতরু । তলায় দাঁড়িয়ে হাত পাতলেই যা চাইবি তাই পাবি রে।

পঞ্চু । খবর পেলি কার কাছ থেকে ।

উধো । ধোকড় গাঁয়ের ভেকু সর্দারের কাছ থেকে । বাবা সেদিন ডুমুর গাছে চড়ে বসে পা দোলাচ্ছিল ; ভেকু জানে না , তলা দিয়ে যাচ্ছে , মাথায় ছিল এক হাঁড়ি চিটেগুড় , তামাক তৈরি করবে । বাবার পায়ে ঠেকে তার হাঁড়ি গেল টলে — চিটেগুড়ে তার মুখ চোখ গেল বুজে । বাবার দয়ার শরীর ; বললে , ভেকু , তোর মনের কামনা কী খুলে বল্‌ । ভেকুটা বোকা ; বললে , বাবা , একখানা ট্যানা দাও , মুখটা মুছে ফেলি। যেমনি বলা অমনি গাছ থেকে খসে পড়ল একখানা গামছা । মুখ চোখ মুছে উপরে যখন তাকালো তখন আর কারও দেখা নেই । যা চাইবে কেবল একবার । বাস্‌ , তার পরে কেঁদে আকাশ ফাটালেও সাড়া মিলবে না।

পঞ্চু । হায় রে হায় , শাল নয় , দোশালা নয় , শুধু একখানা গামছা ! ভেকুর আর বুদ্ধি কত হবে ।

উধো । তা হোক , নেপু । ঐ গামছা নিয়েই তার দিব্যি চলে যাচ্ছে — দেখিস নি ? রথতলার কাছে অত বড়ো আটচালা বানিয়েছে । গামছা হোক , বাবার গামছা তো।

পঞ্চু । কী করে বল । ভেল্‌‍কি নাকি ।

উধো । হোঁদলপাড়ার মেলায় ভেকু সেদিন বাবার গামছা পেতে বসল । হাজারে হাজারে লোক এসে জুটল । বাবার নামে টাকাটা সিকেটা আলুটা মুলোটা চার দিক থেকে গামছার উপর পড়তে লাগল । মেয়েরা কেউ বা এসে বলে , ও ভেকুদাদা , আমার ছেলেটার মাথায় বাবার গামছা একটু ঠেকিয়ে দে , আজ তিমমাস ধরে জ্বরে ভুগছে । ওর নিয়ম হচ্ছে নৈবিদ্যি চাই পাঁচ সিকে , পাঁচটা সুপুরি , পাঁচ কুন্‌‍কে চাল , পাঁচ ছটাক ঘি ।

পঞ্চু । নৈবিদ্যি তো দিচ্ছে , ফল পাচ্ছে কিছু ?

উধো । পাচ্ছে বৈকি । গাজন পাল গামছা ভরে পনেরো দিন ধরে ধান ঢেলেছে ; তার পরে ঐ গামছার কোণে দড়ি লাগিয়ে একটা পাঁঠাও দিলে বেঁধে , ঐ পাঁঠার ডাকে চার দিক থেকে লোক এসে জমল। কী বলব , ভাই , মাস এগারো পরেই গাজনের চাকরি জুটে গেল । আমাদের রাজবাড়ির কোতোয়ালের সিদ্ধি ঘোঁটে , তার দাড়ি চুম্‌‍রিয়ে দেয়।

পঞ্চু । সত্যি বলছিস ?

উধো । সত্যি না তো কী । গাজন যে আমার মামাতো ভাইয়ের ভায়রাভাই হয় ।

পঞ্চু । আচ্ছা ভাই উধো , গামছাটা তুই দেখেছিস ?

উধো । দেখেছি বৈকি । হটুগঞ্জের তাঁতে দেড়গজ ওসারের যে গামছা বুনুনি হয় , চাঁপার বরন জমি , লাল পাড় , এক্কেবারে বেমালুম তাই ।

পঞ্চু । বলিস কী । তা , সে গাছের উপর থেকে পড়ল কী করে ।

উধো । ঐ তো মজা । বাবার দয়া !

পঞ্চু । চল্‌ ভাই , চল্‌ , খোঁজ করতে বেরোই । কিন্তু , চিনব কী করে ।

উধো । সেই তো মুশকিল । কেউ তো তাকে দেখে নি । আবার হবি তো হ , ভেকু বেটার চোখ গেল চিটেগুড়ে বুজে ।

পঞ্চু । তবে উপায় ?

উধো । আমি তো হাটে ঘাটে যাকে দেখছি তাকেই জোড়হাত করে জিগেস করছি , দয়া করে জানাও , তুমিই কি গেছো বাবা । শুনে তারা তেড়ে মারতে আসে । একজন তো দিল আমার মাথায় হুঁকোর জল ঢেলে ।

গোবরা । তা দিক গে । ছাড়া হবে না । খুঁজে বের করবই । যা থাকে কপালে ।

পঞ্চু । ভেকু বলে , গাছে চড়লেই তবে বাবার চেহারা ধরা পড়ে , যখন নীচে থাকেন চেনবার জো নেই ।

উধো । গাছে চড়িয়ে চড়িয়ে মানুষকে পরখ করব কী করে ভাই । আমি এক বুদ্ধি করেছি , আমার আমড়া গাছ আমড়ায় ভরে গেছে , যাকে দেখছি তাকেই বলছি , আমড়া পেড়ে নাও — গাছটা প্রায় খালি হয়ে এল , ডালগুলোও ভেঙেছে ।

পঞ্চু । আর দেরি নয় রে , চল্‌ । কপালের জোর যদি থাকে তবে দর্শনলাভ হবেই । একবার গলা ছেড়ে ডাক দে – না , ভাই ! গেছো বাবা , ও বাবা , দয়াল বাবা , পারুলবনে কোথাও যদি থাক লুকিয়ে , একবার অভাগাদের দর্শন দাও ।

গোবরা । ওরে হয়েছে রে , দয়া হল বুঝি ।

পঞ্চু । কই রে , কই ।

গোবরা । ঐ – যে চালতা গাছে ।

পঞ্চু । কী রে , চালতা গাছে কী । দেখছি নে তো কিছু ।

গোবরা । ঐ – যে দুলছে ।

পঞ্চু । কী দুলছে । ও তো লেজ রে ।

উধো । তোর কেমন বুদ্ধি গোবরা , ও বাবার লেজ নয় রে , হনুমানের লেজ । দেখছিস নে মুখ ভ্যাঙাচ্ছে ।

গোবরা । ঘোর কলি যে ! বাবা ঐ কপিরূপ ধরেছেন আমাদের ভোলাবার জন্যে ।

পঞ্চু । ভুলছি নে , বাবা , কালামুখ দেখিয়ে ভোলাতে পারবে না । যত পার মুখ ভ্যাঙাও , নড়ছি নে — তোমার ঐ শ্রীলেজের শরণ নিলুম ।

গোবরা । ওরে , বাবা যে লম্বা লাফ দিয়ে পালাতে শুরু করল রে ।

পঞ্চু । পালাবে কোথায় । আমাদের ভক্তির দৌড়ের সঙ্গে পারবে কেন ।

গোবরা । ঐ বসেছে কয়েৎবেল গাছের ডগায় ।

উধো । পঞ্চু , উঠে পড় – না গাছে ।

পঞ্চু । আরে , তুই ওঠ্‌ – না ।

উধো । আরে , তুই ওঠ্‌ ।

পঞ্চু । অত উচ্চে উঠতে পারব না , বাবা , কৃপা করে নেমে এসো ।

উধো । বাবা , তোমার ঐ শ্রীলেজ গলায় বেঁধে অন্তিমে যেন চক্ষু মুদতে পারি এই আশীর্বাদ করো ।

[ প্রস্থান

ওহে কমবুদ্ধি , হাসাতে পারলে ?

না । যে মানুষ সবই বিনা বিচারে বিশ্বাস করতে পারে তাকে হাসানো সোজা নয় । ভয় হচ্ছে , পুপেদিদি পাছে গেছো বাবার সন্ধান করতে আমাকে পাঠায় ।

মুখ দেখে আমারও তাই বোধ হচ্ছে । গেছো বাবার ‘পরে ওর টান পড়েছে । আচ্ছা , কাল পরীক্ষা করে দেখব , বিশ্বাস না করিয়েও মজা লাগাতে পারা যায় কি না ।

 

কিছুক্ষণ বাদে পুপু এসে বললে , আচ্ছা , দাদামশায় , গেছো বাবার কাছে তুমি হলে কী চাইতে ।

আমি বললেম , পুপুদিদির জন্যে এমন একটা কলম চাইতেম যা নিয়ে লিখতে বসলে অঙ্ক কষতে একটা ভুলও হত না ।

গল্পের পঞ্চম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!