ললাটের লিখন– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– সপ্তম অংশ

“ আমাকে ? নিতে সাহস আছে তোমার ?”

“ আছে । ”

“ সেন্টিমেন্ট এক ফোঁটাও থাকবে না । ”

“ নেই রইল । ”

“ নির্জলা একাদশী , নিষ্ঠুর সত্য । ”

“ রাজি আছি । ”

“ আচ্ছা , রাজি ? দেখো , নভেল লেখা নয় , সত্যিকার সংসার । ”

“ শিশু নই আমি , এ কথা বুঝি । ”

“ না মশায় , কিছু বোঝ না । বুঝতে হবে দিনে-দিনে পলে-পলে , বুঝতে হবে হাড়ে-হাড়ে । ”

“ সেই হবে আমার জীবনের সব চেয়ে বড়ো অভিজ্ঞতা । আমাকে ভয় দেখাতে পরবে না কিছুতেই । ”

“ সত্যি কথা বলি । এত দিন তোমাকে কাছে কাছেই দেখলুম , বুদ্ধি তোমার পাকে নি , তাই কেবলই ধার ক’রে ক’রে কাজ চালাও । মেয়েদের সম্বন্ধে বইপড়া কথা অনেক শুনেছি তোমার মুখে । একটা কথা শুনে রাখো , যারা অবুঝ তাদের উপর মেয়েদের খুব একটা টান আছে , যেমন মমতা রোগাদের ‘পরে । ওদের ভার পেলে মেয়েদের বেকার দশা ঘোচে । তোমার উপর আমার সত্যিকার স্নেহ জন্মেছে । এতদিন তোমাকে বাঁচিয়ে এসেছি তোমার নিজের নির্বুদ্ধিতা আর বাইরের বিরুদ্ধতা থেকে । সেইজন্যে যে সর্বনেশে প্রস্তাব এইমাত্র করলে সেটাতে সম্মতি দিতে আমার দয়া হচ্ছে । ”

“ সম্মতি যদি না দাও তা হলে যে নির্দয়তা হবে তার তুলনা নেই । ”

“ মেলোড্রামা ? ”

“ না , মেলোড্রামা নয় । ”

“ আজ না হোক কাল মেলোড্রামা হয়ে উঠবে না ? ”

“ যদি কোনোদিন হয়ে ওঠে তবে ওই খাতার মতো দিনগুলোকে নিজের হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ো । ”

বাঁশরি উঠে দাঁড়িয়ে বললে , “ আচ্ছা দিলেম সম্মতি । ”

পৃথ্বীশ ওর দিকে লাফ দিয়ে এল । বাঁশরি পিছু হঠে গিয়ে বললে , “ এখনি শুরু হল! এখনো ভালো করে ভেবে দেখো — পিছোবার সময় আছে । ”

পৃথ্বীশ হাত জোড় করে বললে , “ মাপ করো আমাকে । ভয় হচ্ছে পাছে তোমার মত বদলায় । ”

“ বদলাবে না । অমন করে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকো না । যাও রেজিস্ট্রারের আপিসে । যত শীঘ্র পার বিয়ে হওয়া চাই । নিমন্ত্রণের চিঠি ছাপতে দিয়ো আজই । ”

“ অনুষ্ঠান কিছু হবে না ? ”

“ কিছু না , একেবারে নির্জলা একাদশী । ”

“ কাউকে নিমন্ত্রণ ? ”

“ কাউকে না । ”

“ কাউকেই না ? ”

“ আচ্ছা , সোমশংকরকে । আর-একটা কথা বলি , গল্পটার কপি নিশ্চয় আছে তোমার ডেস্কে, সেটা পুড়িয়ে ফেলো, নইলে শান্তি পাবে না আমার হাতে । ”

 

পরের দিন সোমশংকর এল । বাঁশি বললে , “ তুমি যে । ”

“ নিমন্ত্রণ করতে এসেছি । জানি অন্য পক্ষ থেকে তোমাকে নিমন্ত্রণ করবে না । কিন্তু আমার দিক থেকে কোনো সংকোচ নেই । ”

“ কেন নেই ?”

“ একদিন আমি তোমাকে যা দিয়েছি আর তুমি আমাকে যা দিয়েছ এ বিবাহে তাকে কিছুমাত্র স্পর্শ করবে না তা তুমি জান । ”

“ তবে বিবাহ করতে যাচ্ছ কেন ? ”

“ সে কথা বুঝতে যদি নাও পার , তবু আমার উপর দয়া কোরো । ”

“ নাই-বা বুঝলুম , তুমি বলো । ”

“ সন্ন্যাসীর কাছ থেকে যে ব্রত নিয়েছি বোঝাতে পারব না সে , আমার ভালোবাসার চেয়ে বড়ো । তাকে সম্পন্ন করতেই হবে বাঁচি আর মরি । ”

“ আমাকে সঙ্গে নিয়ে সম্পন্ন হতে পারত না ? ”

“ যদি পারত তবে বাধা ঘটত না । তুমি নিজেকে ভুল বোঝাও না , তাই জানি , তুমি নিশ্চিত জানো তোমার ভালোবাসা টলিয়ে দিল আমাকে কেন্দ্র থেকে । তোমার কাছে আমি দুর্বল । যে দুঃসাধ্য কর্মে সুষমার সঙ্গে সন্ন্যসী আমাকে মিলিয়েছেন , সেখানে আমাদের বিচলিত হবার অবকাশ নেই । সেখানে ভালোবাসার প্রবেশপথ বন্ধ । ”

অশ্রু গোপন করার জন্যে চোখ নিচু করে বাঁশরি বললে , “ এখনো সস্পূর্ণ করে বলো নি , কেন এলে আজ আমার এখানে ? ”

“ আমার ভালোবাসার কিছু চিহ্ন রেখে যাচ্ছি তোমার কাছে , ফিরিয়ে দিতে পারবে না । ”

ডুব সাঁতার দিয়ে জল থেকে তুলে এনেছিল , সেই কন্ঠী , সেই ব্রেসলেট , সেই ব্রোচ । ধরলে বাঁশরির সামনে । বাঁশরি বললে , “ মনে করেছিলাম হারিয়েছে , ফিরে পেয়ে আরো বেশি করে পেলুম । নিজের হাতে পরিয়ে দাও আমাকে । ”

সোমশংকর একে-একে গয়নাগুলি পরিয়ে দিলে যত্ন করে । বাঁশরি বললে , “ শক্ত আমার প্রাণ , তোমার কাছেও কোনো দিন কেঁদেছি বলে মনে পড়ে না । আজকে যদি কাঁদি কিছু মনে কোরো না । ” এই বলে মাথা রাখল সোমশংকরের বুকের উপর ।

 

বিবাহের আগের দিন সন্ধ্যাবেলা । সুষমাদের যে-ঘরে বিবাহ-সভা বসবে , যেখানে আসন পড়বে বর-কনের , সেখান থেকে সমস্ত লোকজন সরিয়ে দিয়ে , সুষমা একলা বসে মেঝের উপর একটা পদ্মফুলের আলপনা এঁকেছে । থালায় আছে নানা জাতের ফুল ফল , ধূপ জ্বলছে , ইলেকট্রিক আলো নিবিয়ে প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে । ঘরের দ্বারের কাছে সুষমা বসে আছে চুপ করে । মুক্তারামকে ডেকে পাঠিয়েছে । এখনি সে আসবে ।

এল মুক্তারাম । সুষমা অনেক্ষণ তার পায়ের উপর মাথা দিয়ে রইল পড়ে । তার পর সেই আলপনা-কাটা জায়গায় আসন পেতে বসালে তাকে । বললে , “ প্রভু দুর্বল আমি , মনের গোপনে যদি পাপ থাকে আজ সমস্ত ধুয়ে দাও । আমার সমস্ত আসক্তি দূর হোক , জয়যুক্ত হোক তোমার বাণী । আজ সন্ধ্যায় এইখানে তোমার প্রসন্ন দৃষ্টির সামনে তোমার চরণস্পর্শে আমার নতুন জীবন আরম্ভ হোক । কাল থেকে তোমার ব্রতের পথে যাত্রা করে চলব শেষ দিন পর্যন্ত । ”

মুক্তারাম উঠে দাঁড়ালে । কোনো কথা না বলে ডান হাতে স্পর্শ করলে সুষমার মাথা । সুষমা থালা থেকে ফুলগুলি নিয়ে মুক্তারামের দুই পা ঢেকে দিলে ।

পরিশিষ্ট

 

পৃথ্বীশ একখানা চিঠি পেলে । চলে গেল সব কাজ থেকে ছুটি নিয়ে ডেরাদুনে , একটা নিষ্ঠুর গল্প লেখবার জন্য । সকলের চেয়ে কালিমা লেপনে পূজনীয়ের চরিত্রে । এই তার প্রতিশোধ , তার সান্ত্বনা । পাঠকেরা বুঝলে কাদের লক্ষ্য করে লেখা , উপভোগ করলে কুৎসা , বললে এইটে নবযুগের বাংলা সাহিত্যের একটা শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য । একজন ভক্ত যখন লেখাটা মুক্তারামকে দেখালে , মুক্তারাম বললে — “ লেখকের শক্তি আছে রচনার । ”

গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!