“ উনি এতক্ষণ স্টেজের মনুবাবুর নকল করছিলেন । ভারি মজা । ”
“ পৃথ্বীশবাবুর নকল আসে নাকি ?”
“ ওঁর বই পড়লেই তো টের পাওয়া যায় । শোনো , ওর জন্যে মফিজকে কিছু খাবার আনতে বলে দাও তো । ”
পৃথ্বীশ বললে , “ না দরকার নেই , কাজ আছে , দেরি করতে পরব না । ” বলে দ্রুত নমস্কার করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল । বাঁশরি পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললে , “ মনে থাকে যেন আজ বিকেলে সিনেমা আছে । তোমারই সেই পদ্মাবতী । ” উত্তর এল , “ সময় হবে না । ”
বাঁশরি মনে মনে বললে , সময় হবেই জানি । অন্যদিনের চেয়ে দু ঘন্টা আগে ।
সতীশ জিজ্ঞাসা করলে , “ আচ্ছা তুমি ওই পৃথ্বীশের মধ্যে কী দেখতে পাও বলো দেখি । ”
“ ওর বিধাতা ওকে যে পরীক্ষার কাগজ দিয়েছিলেন দেখতে পাই তার উত্তর । আর তার মাঝখানটাতে দেখি পরীক্ষকের কাটা দাগ । ”
“ এমন ফেল-করা জিনিস নিয়ে করবে কী ? ”
“ ওকে প্রথম শ্রেণীতে পাস করাব । ”
“ তার পরে স্বহস্তে প্রাইজ দেবে নাকি ?”
“ সর্বনাশ , দিলে জীবের প্রতি নিষ্ঠুরতা করা হবে । ”
কথা ছিল বর-কনের পরস্পর আলাপ জমাবার অবসর দেওয়া চাই , তাই বিয়ের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে অন্তত আরো দু মাস । কিন্তু সেদিন বাঁশরির অনিমন্ত্রিত প্রবেশ দেখে কন্যাপক্ষ সকলে ভয় পেয়ে গেল । বুঝল যে দুর্গ আক্রমণ শুরু হল । সন্ন্যাসীর গাঁথা দেয়াল যদি কোনো মেয়ে টলাতে পারে , সে একা বাঁশরি ।
দিন-পনেরোর মধ্যে বিয়ে স্থির হল । বাইরে বাঁশরির উচ্চহাসি উচ্চতর হতে লাগল , কিন্তু ভিতরে যদি কারো দৃষ্টি পৌঁছত দেখতে পেত পিঁজরের মধ্যে সিংহিনী ঘুরছে ল্যাজ আছড়িয়ে । বেলা দশটা হবে , সোমশংকর বসে আছে বারান্দায় , সামনে মেঝের উপর বসেছে জহরী নানা-প্রকার গয়নার বাক্স খুলে , রেশমি ও পশমি কাপড়ের গাঁঠরি নিয়ে সুযোগের অপেক্ষা করছে কাশ্মীরি দোকানদার , এমন সময় কোনো খবর না দিয়েই এসে উপস্থিত বাঁশরি । বললে , “ ঘরে চলো । ” দুজনে গেল বৈঠকখানায় । সোফায় বসল সোমশংকর , বাঁশরি বসল পাশেই ।
বললে , “ ভয় নেই , কান্নাকাটি করতে আসি নি । তা হোক তবু তোমার ভাবনা ভাববার অধিকার আমাকে দিয়েছ , তাই একটা কথা জিজ্ঞাসা করি , জান কি তুমি , যে সুষমা তোমাকে ভালোবাসে না । ”
“ জানি । ”
“ তাতে তোমার কিছুই যায় আসে না । ”
“ কিছুই না । ”
“ তা হলে সংসারযাত্রাটা কীরকম হবে ?”
“ সংসারযাত্রার কথা ভাবছি নে । ”
“ তবে কিসের কথা ভাবছ । ”
“ ভাবছি একমাত্র সুষমার কথা । ”
“ অর্থাৎ তোমাকে ভালো না বেসেও কী করে ও সুখী হবে ? ”
“ সুষমার মতো মেয়ের সুখী হবার জন্যে ভালোবাসার দরকার নেই । ”
“ কিসের দরকার আছে , টাকার ?”
“ এটা তোমার যোগ্য কথা হল না বাঁশরি — এটা যদি বলত কলুটোলার ঘোষগিন্নি আশ্চর্য হতুম না । ”
“ আচ্ছা , ভুল করেছি । কিন্তু প্রশ্নটার উত্তর বাকি আছে । কিসের দরকার আছে সুষমার । ”
“ জীবনে ও একটা কোন্ লক্ষ্য ধরেছে , সেইটে ওর ধর্ম । সাধ্যমতো আমি যদি কিছু পরিমাণে তাকে সার্থক করতে পারি তা হলেই হল । ”
“ লক্ষ্যটা কী বোধহয় জান না । ”
“ জানবার চেষ্টাও করি নি । যদি আপনা হতে ইচ্ছে করে বলে জানতে পাব । ”
“ অর্থাৎ ওর লক্ষ্য তুমি নও , তোমার লক্ষ্য ওই মেয়ে । ”
“ তাই বলতে পারি । ”
“ এ তো পুরুষের মতো শোনাচ্ছে না , ক্ষত্রিয়ের মতো নয়ই । ”
“ আমার পৌরুষ দিয়ে ওর জীবন সম্পূর্ণ করব , ওর ব্রত সার্থক করব — আর কিছু চাই নে আমি । আমার শক্তিকে ওর প্রয়োজন আছে এই জেনে আমি খুশি । সেই কারণে সকলের মধ্যে আমাকেই ও বেছে নিয়েছে এই আমার গৌরব । ”
“ এতবড়ো পুরুষকে মন্ত্র পড়িয়েছে সন্ন্যাসী । বুদ্ধিকে ঘোলা করেছে , দৃষ্টিকে দিয়েছে চাপা । শুনলুম ভালো হল আমার , শ্রদ্ধা গেল ভেঙে ; বন্ধন গেল ছিঁড়ে । শিশুকে মানুষ করার কাজ আমার নয় , সে কাজের ভার সম্পুর্ণ দিলুম এই মেয়েকে । ”
এমন সময় ঘরে প্রবেশ করল মুক্তারাম । পদধূলি নিয়ে তাকে প্রণাম করলে সোমশংকর ।
অগ্নিশিখার মতো বাঁশরি দাঁড়াল তার সামনে । বললে , “ আজ রাগ করবেন না । ধৈর্য ধরবেন , কিছু বলব , কিছু প্রশ্ন করব । ”
“ আচ্ছা বলো তুমি । ” – মুক্তারামের ইঙ্গিতে সোমশংকর চলে গেল ।
“ জিজ্ঞাসা করি , সোমশংকরকে শ্রদ্ধা করেন আপনি । ”
“ বিশেষ শ্রদ্ধা করি । ”
“ তবে কেন এমন মেয়ের ভার দিচ্ছেন ওর কাঁধে যে ওকে ভালোবাসে না । ”
“ যে ভার দিয়েছি আমি তাকেই বলি মহদ্ভাব । বলি পুরস্কার । একমাত্র সোমশংকর সুষমাকে গ্রহণ করবার যোগ্য । ”
“ ওর চিরজীবনের সুখ নষ্ট করতে চান আপনি ? ”
“ সুখকে উপেক্ষা করতে পারে ওই বীর মনের আনন্দে । ”
“ আপনি মানবপ্রকৃতিকে মানেন না ? ”
“ নবপ্রকৃতিকেই মানি , তার চেয়ে নীচের প্রকৃতিকে নয় । ”
“ এতই যদি হল — বিবাহ ওরা নাই করত । ”
“ তের সঙ্গে ব্রতকে প্রাণের বন্ধনে যুক্ত করতে চেয়েছিলুম । খুঁজেছিলুম তেমন দুটি মানুষকে , দৈবাৎ পেয়েছি । এটা একটা সৃষ্টি হল । ”
আর কেউ হলে বাঁশরি জিজ্ঞাসা করত — ‘আপনি নিজেই করলেন না কেন ? ‘ কিন্তু মুক্তারামের চোখের সামনে এ প্রশ্ন বেধে গেল ।
বললে , “ পুরুষ বলেই বুঝতে পারছেন না , ভালোবাসা নইলে দুজন মানুষকে সম্পুর্ণ করে মেলানো যায় না । ”
“ মেয়ে বলেই বুঝতে চাইছ না যে , প্রেমের মিলন ভালোবাসার চেয়ে সত্য , তাতে মোহের মিশেল নেই । ”
“ সন্ন্যাসী , তুমি জান না মানুষকে । তার হৃদয়গ্রনিথ জোর করে টেনে ছিঁড়ে সেই জায়গায় তোমার নিজের আইডিয়ার গ্রন্থি জুড়ে দিয়ে অসহ্য ব্যাথার ‘পরে বড়ো বড়ো বিশেষণ চাপা দিতে চাও । গ্রন্থি টিকবে না । ব্যাথাই যাবে থেকে । মানুষের লোকালয়ে তোমরা এলে কী করতে — যাও-না তোমাদের গুহার গহ্বরে বদরিকাশ্রমে — সেখানে মনের সাধে নিজেদের শুকিয়ে মারতে চাও মারো , আমরা সামান্য মানুষ আমাদের তৃষ্ণার জল মুখের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে মরুভুমিতে ছড়িয়ে দিয়ে তাকে সাধনা বলে প্রচার করতে এলে কোন্ করুণায় ? আমাদের অভিশাপ লাগবে না তোমাকে ? যা তুমি নিজে ভোগ করতে জান না তা তুমি ভোগ করতে দেবে না ক্ষুধিতকে ?
“ এই যে সুষমা , শোনো বলি , মেয়েরা চিতার আগুনে মরেছে অনেকে , ভেবেছে তাতেই পরমার্থ । তেমনি করে দিনে দিনে মরতে চাও জ্বলে — চাও না তুমি ভালোবাসা । কিন্তু যে চায় , পাষাণ করে নি যে আপন নারীর প্রাণ , কেন কেড়ে নিতে এলে তার চিরজীবনের সুখ । এই আমি আজ বলে দিলুম তোমাকে , ঘোড়ায় চড়ো , শিকার করো যাই কর , তুমি পুরুষ নও , আইডিয়ার সঙ্গে গাঁঠছড়া বেঁধে তোমার দিন কাটবে না গো , তোমার রাত বিছিয়ে দেবে কাঁটার শয়ন । ”
বাঁশরির উত্তেজিত কন্ঠস্বর শুনে বাইরে থেকে তাড়াতাড়ি এল সোমশংকর । বললে , “ বাঁশি , শান্ত হও , চলো এখান থেকে । ”
“ যাব না তো কী । মনে কোরো না বুক ফেটে মরব , জীবন হয়ে থাকবে চির-চিতানলের শ্মশান । কখনো আমার এমন বিচলিত দশা হয় নি — আজ কেন বন্যার মতো এল এই পাগলামি! লজ্জা , লজ্জা , লজ্জা — তোমাদের তিনজনের সামনেই এই অপমান । মুছে ফেলব লজ্জা , এর চিহ্ন থাকবে না । চললুম । ”
সন্ধেবেলায় কোনো একটা উপলক্ষে সানাই বাজছে সুষমাদের বাড়িতে । বাঁশরি তখন তার একলা বাড়ির কোণের ঘরে বসে পড়ছে একটা খাতা নিয়ে । শেষ হয়ে গেছে পৃথ্বীশের লেখা গল্প । নাম তার , ‘ভালোবাসার নীলাম’ ।
নায়িকা পঙ্কজা কেমন করে অর্থলোভে দিনে দিনে সার চন্দ্রশেখরের মন ভুলিয়ে তাকে আয়ত্ত করলে তার খুব একটা টকটকে ছবি , সুনিপুণ তন্নতন্ন তার বিবরণ । দুই নম্বরের নায়িকা দীপিকা নির্বোধকে উদ্ধার করবার চেষ্টা করছে প্রাণপণে , শেষকালে কী অসহ্য ঘৃণা , কী বুকফাটা কান্না । ছুটে বেরোলে আত্মহত্যা করতে , শীতকালে জলে পা দিতে গিয়েই হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে শীত করে উঠল , কিংবা হঠাৎ মনে সংকল্প এল বেঁচে থেকেই শেষ পর্যন্ত ওদের দুজনকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারবে । দ্বিধার এই দুটো কারণের মধ্যে কোন্টা সত্য সেটা কৌশলে অনিশ্চিত রাখা হয়েছে ।
পৃথ্বীশ কখন এক সময় পা টিপে টিপে একটা চেয়ারে এসে বসেছে পিছন দিকে । বাঁশরি জানতে পারে নি । পড়া হয়ে যেতেই বাঁশরি খাতাখানা যখন ধপ করে ফেললে টেবিলের উপর — পৃথ্বীশ সামনে এসে বললে , “ কেমন লাগল । মেলোড্রামার খাদ মিশোই নি এক তোলাও । সেন্টিমেন্টালিটির তরল রস চায় যারা তাদের পক্ষে নির্জলা একাদশী ; একেবারে নিষ্ঠুর সত্য । ”
বাঁশরি বললে , “ কেমন লাগল ? এই দেখিয়ে দিচ্ছি । ” বলে পাতাগুলো ছিঁড়তে লাগল একটার পর একটা । পৃথ্বীশ বললে , “ করলে কী ? আমার সকলের চেয়ে শ্রেষ্ঠ লেখা নষ্ট করলে , তা জান । ”
“ কী দাম চাই ? ”
“ তোমাকে । ”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।