রকম আবিষ্ট অবস্থায় পৃথ্বীশের মুখের ভঙ্গি বাঁশরি সইতে পারত না । নিজেকে সামলে নিয়ে বললে , “ সস্তা মিষ্টান্নের কারবার শুরু করতে আজ ডাকি নি তোমাকে । সত্যি করে দেখতে শেখো , তার পরে সত্যি করে লিখতে শিখতে পারবে । অনেক মানুষ অনেক অমানুষ আছে চারি দিকে , ঠাহর করলেই চোখে পড়বে । ”
“ নেই বা দেখলুম , তোমার কী তাতে ? ”
“ লিখতে যে পারি নে পৃথ্বীশ । চোখে দেখি মনে বুঝি । ব্যর্থ হয় যে সব । ইতিহাসে বলে একদিন বাংলা দেশে কারিগরদের বুড়ো আঙুল কেটে দিয়েছিল । আমিও কারিগর , বিধাতা বুড়ো আঙুলটা কেটে দিয়েছেন । আমদানি করা মালে কাজ চালাতে হয় । সেটা কিন্তু সাচ্চা হওয়া চাই । ”
এমন সময় কাছে এল সুষমা ।
সুষমাকে দেখলে আশ্চর্য হতে হয় । সচরাচর এরকম চেহারা দেখা যায় না । লম্বা সতেজ সবল , সহজ মর্যাদায় সমুন্নত , রঙ যাকে বলে কনক গৌর , ফিকে চাঁপার মতো , কপাল নাক চিবুক স্পষ্ট করে যেন কুঁদে তোলা ।
সুষমা পৃথ্বীশকে একটা নমস্কার করে বাঁশরিকে বললে , “ বাঁশি কোণে লুকিয়ে কেন ? ”
“ কুনো সাহিত্যিককে বাইরে আনবার জন্যে । সম্প্রতি বেকার হওয়াতে এই দায়িত্বটা নিয়েছি — দিন কাটছে একরকম । খনির সোনাকে শানে চড়িয়ে নাম করতে পারব । পূর্ব হতেই হাতযশ আছে । জহরৎকে দামি করে তোলে জহরী , পরের ভোগের জন্যে । সুষী , ইনিই হচ্ছেন পৃথ্বীশবাবু জানো বোধহয় । ”
“ খুব জানি , এই সেদিন পড়ছিলুম , এঁর ‘ বোকার বুদ্ধি ‘ গল্পটা । কাগজে কেন এত গাল দিয়েছে বুঝতেই পারলুম না । ”
পৃথ্বীশ বললে , “ অর্থাৎ বইটা এমনিই কি ভালো । ”
“ ও-সব ধারালো কথা বলবার ভার বাঁশরির উপর । আমি সময় পেলে শুধু পড়ি , তার পরে বলতে কিছু সাহস হয় না , পাছে ধরা পড়ে কালচারের খাক্তি । ”
বাঁশরি বললে , “ বাংলার মানুষ সম্বন্ধে গল্পের ছাঁচে ন্যাচরল হিস্ট্রি লিখছেন পৃথ্বীশবাবু , যেখানটা জানেন না দগদগে রঙ দেন লেপে মোটা তুলি দিয়ে । রঙের আমদানি সমুদ্রের ওপার থেকে । দেখে দয়া হল । বললুম , জীবজন্তুর সাইকোলজির খোঁজে গুহা-গহ্বরে যেতে যদি খরচে না কুলোয় জুওলজিকালের খাঁচাগুলোর ফাঁক দিয়ে দৃষ্টিপাত করতে দোষ কী ? ”
“ তাই বুঝি এনেছ এখানে ? ”
“ পাপ মুখে বলব কী করে তা কবুল করছি । পৃথ্বীশবাবুর হাত পাকা , কিন্তু মালমসলাও তো পাকা হওয়া চাই । যতদূর সাধ্য , জোগান দেবার মজুরিগিরি করছি । এর পরে যে জিনিস বেরবে পৃথিবী চমকে উঠবে , নোবেল প্রাইজ কমিটি পর্যন্ত । ”
“ ততদিন অপেক্ষা করব । ইতিমধ্যে আমাদের ওদিকে চলুন । সবাই উৎসুক হয়ে আছে আপনার সঙ্গে আলাপ করবার জন্য । মেয়েরা অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে ঘুরছে কাছে আসতে সাহস নেই । বাঁশি , একলা ওঁকে বেড়া দিয়ে রাখলে অনেকের অভিশাপ কুড়োতে হবে । ”
বাঁশরি উচ্চহাস্যে হেসে উঠল । “ সেই অভিশাপই তো মেয়েদের বর । সে তুমি জানো । রাজারা দেশ জয় করত ধন লুঠের জন্যে । মেয়েদের লুঠের মাল প্রতিবেশিনীদের ঈর্ষা । ” এ কথার উত্তর না দিয়ে সুষমা বললে , “ পৃথ্বীশবাবু , গন্ডি পেরোবার স্বাধীনতা যদি থাকে একবার যাবেন ওদিকটাতে ” – এই বলে চলে গেল ।
পৃথ্বীশ তখনি বলে উঠল , “ কী আশ্চর্য ওকে দেখতে । বাঙালি ঘরের মেয়ে বলে মনেই হয় না — যেন এথীনা , যেন মিনার্ভা , যেন ব্রূন্ হিল্ড । ”
উচ্চস্বরে হাসতে লাগল বাঁশরি । বলে উঠল , “ যত বড়ো দিগ্গজ পুরুষ হোক-না সবার মধ্যেই আছে আদিম যুগের বর্বর । নিজেকে হাড়পাকা রিয়ালিস্ট বলে দেমাক করো , ভান করো মন্তর মান না । এক পলকে লাগল মন্তর , উড়িয়ে নিয়ে গেল মাইথলজিক যুগে । মনটা তোমাদের রূপকথার , সেইজন্যেই কোমর বেঁধে কলমটাকে টেনে চলেছ উজানপথে । দুর্বল ব’লেই বলের এত বড়াই । ”
পৃথ্বীশ বললে , “ সে কথা মাথা হেঁট করে মানব , পুরুষ জাত দুর্বল জাত । ”
বাঁশরি বললে , “ তোমরা আবার রিয়ালিস্ট! রিয়ালিস্ট মেয়েরা । আমরা মন্তর মানি নে । যতবড়ো স্থূল পদার্থ হও , তোমরা যা , তোমাদের তাই বলেই জানি । রঙ আমরা মাখাই নে তোমাদের মুখে , মাখি নিজে । রূপকথার খোকা সব , মেয়েদের কাজ হয়েছে তোমাদের ভোলানো । পোড়া কপাল আমাদের । এথীনা , মিনার্ভা! হায় রে হায়! ওগো রিয়ালিস্ট , এটুকু বুঝতে পার না যে , রাস্তায় চলতে যাদের দেখেছ পানওয়ালির দোকানে এঁকেছ কড়া তুলিতে যাদের মূর্তি , তারাই সেজে বেড়াচ্ছে এথীনা , মিনার্ভা । ”
বাঁশরির ঝাঁঝ দেখে পৃথ্বীশ মনে মনে হাসলে । বললে , “ বৈদিক কালে ঋষিদের কাজ ছিল মন্তর পড়ে দেবতা ভোলানো ।– কিন্তু যাঁদের ভোলাতেন তাঁদের ভক্তি করতেন । তোমাদের যে সেই দশা দেখি বাঁশি । বোকা পুরুষদের ভোলাও তোমরা , আবার পাদোদক নিতেও ছাড় না , এমনি করে মাটি করলে এই জাতটাকে । ”
“ সত্যি সত্যি , খুব সত্যি! ওই বোকাদের আমরা বসাই উঁচু বেদীতে , চোখের জলে কাদামাখা পা ধুইয়ে দিই , নিজেদের অপমানের শেষ করি , যত ভোলাই তার চেয়ে হাজার গুণে ভুলি । ”
পৃথ্বীশ জিজ্ঞাসা করল , “ এর উপায় কী । ”
বাঁশরি বললে , “ তাই তো বলি অন্তত লেখবার বেলায় সত্যি কথাটা লেখো । আর মন্তর নয় মাইথলজি নয় । মিনার্ভার মুখোশটা খুলে একবার দেখো । সেজেগুজে পানের ছিপে ঠোঁট লাল করে তোমাদের পানওয়ালি যে মন্তরটা ছড়ায় , ওই আশ্চর্য মেয়েও ভাষা বদলিয়ে সেই মন্তরই ছড়াচ্ছে । সামনে পড়েছে পথচলতি এক রাজা , তাঁকে ভোলাতে বসেছে কিসের জন্যে ? টাকার জন্যে । শুনে রাখো , টাকা জিনিসটা মাইথলজি নয় , ওটা ব্যাঙ্কের । ওটা তোমাদের রিয়ালিজমের কোটায় । ”
পৃথ্বীশ বললে , “ টাকার প্রতি ওঁর দৃষ্টি আছে সেটাতে বুদ্ধির পরিচয় পওয়া গেল , সেইসঙ্গে হৃদয়টাও থাকতে পারে । ”
“ আছে গো আছে । ঠিক জায়গায় খুঁজে দেখলে দেখতে পাবে পানওয়ালিরও হৃদয় আছে , কিন্তু টাকা এক দিকে হৃদয়টা আর-এক দিকে । এইটে যখন আবিষ্কার করবে তখন গল্প জমবে । পাঠিকারা ঘোর আপত্তি করবে , বলবে মেয়েদের খেলো করা হল , অর্থাৎ তাদের মন্ত্রশক্তিতে বোকাদের মনে খট্কা লাগানো হচ্ছে । উঁচু দরের পুরুষ পাঠকেরা গালি পাড়বে , তাদের মাইথলজির রঙ চটিয়ে দেওয়া , সর্বনাশ । কিন্তু ভয় কোরো না পৃথ্বীশ , রঙ যখন যাবে জ্বলে , মন্ত্র যখন পড়বে চাপা — তখনো সত্য থাকবে টিকে । ”
“ ওর হৃদয়ের ঠিকানা জিজ্ঞাসা করতে পারি কি ? অসভ্যতা হবে , কিন্তু লেখক তো ড্রয়িংরুমের পোষা ভদ্রলোক নয় , সে অত্যন্ত আদিম শ্রেণীর সৃষ্টিকর্তা , চতুর্মুখের তুল্য কিংবা প্রলয়কর্তা দিগম্বরের স্বজাত । ”
“ ঠিকানা বলতে হবে না , নিজের চোখেই দেখতে পাবে চোখ যদি থাকে । এখন চলো ওইদিকে , তোমাকে নিয়ে ওদের মধ্যে প্রসাদ ভাগ করে দেই গে । ”
“ তোমার প্রসাদ ? ”
“ হ্যাঁ , আমারই প্রসাদ । আমার নিন্দে দিয়েই এর স্বাদটা হয়ে উঠেছে উপাদেয় । ”
“ দুঃখের কথা জানাই তোমাকে বাঁশরি । চাদরটাতে মস্ত একটা কালির দাগ । অন্যমনস্ক হয়ে দেখতে পাই নি । ”
“ এখানে কারো কাপড়ে কোনো দাগ নেই , তা দেখেছ ? ”
“ দেখেছি । ”
“ তা হলে জিত রইল একা তোমারই । তুমি রিয়ালিস্ট , ওই কালির দাগ তোমার ভূষণ । আজও খাঁটি হয়ে ওঠনি বলেই এতক্ষণ লজ্জা করছিলে । ”
“ তুমি আমাকে খাঁটি করে তুলবে ? ”
“ হাঁ , তুলব , যদি সম্ভব হয় । ”
বাঁশরির প্রত্যেক কথায় পৃথ্বীশের মনটা যেন চুমুকে মদ খাচ্ছে । এই দলের মেয়ের সঙ্গে এই ওর প্রথম আলাপ । অপরিচিতের অভিজ্ঞতায় মনটা পথ হাতড়িয়ে বেড়াচ্ছে পদে পদে । কোন্ কথাটা পৌঁছোয় কোন্ অর্থ পর্যন্ত , কতদূর পা বাড়ালে পড়বে না গর্তের মধ্যে সম্পূর্ণ ঠাহর করে উঠতে পারছে না । এই অনিশ্চয়তা মনকে উদ্ভ্রান্ত করে রেখেছে দিনরাত । যে কথার যে উত্তর দেয় নি বাড়িতে ফিরে এসে সেইটে ও বাজাতে থাকে , ঠিক সময় কেন মনে আসে নি ভেবে হায় হায় করে । বাঁশরি ওকে অনেকটা প্রশ্রয় দিয়েছে , তবু পৃথ্বীশ বিষম ভয় করে তাকে । নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলে সাহসী পুরুষের স্পর্ধাকেই পুরস্কৃত করে মেয়েরা , যারা ওদের সসংকোচে পথ ছেড়ে দেয় , বঞ্চিত হয় তারাই । নিজের দৃঢ় বিশ্বাস , ওর গোঁয়ার্তুমি যদি হত খাঁটি গিনি সোনার দরের , বাজালে ঠন্ করে উঠত , তা হলে মেয়ে মহলে উড়ত ওর জয়-পতাকা । পুরুষের উপকরণে বিভীষিকা বীভৎসতার দাম আছে ওদের কাছে ।
পৃথ্বীশ স্পষ্ট বুঝেছে যে , নিজেদের সমাজের উপর বাঁশরির জোর দখল । ওকে সবাই যে ভালোবাসে তা নয় , কিন্তু তুচ্ছ করবার শক্তি নেই কারো । তাই সে যখন স্বয়ং পৃথ্বীশকে পাশে করে নিয়ে চলল আসরের মধ্যে , পৃথ্বীশ তখন মাথাটা তুলেই চলতে পারলে , যদিও লক্ষ্মীছাড়া এন্ডিচাদরের কালির লাঞ্ছনা মন থেকে সম্পূর্ণ ঘোচে নি ।
জনতার কেন্দ্রস্থলে এসে পৌঁছল , কিন্তু ওর উপর থেকে সমবেত সকলের লক্ষ্য তখন গেছে সরে ।
সবেমাত্র উপস্থিত হয়েছে আর-একটি লোক তার উপরে মন না দিয়ে চলে না ।
সোমশংকর তার কাছে বিনয়াবনত , সুষমার দেহমন ভক্তিতে আবিষ্ট । অন্য সকলে কীভাবে ওকে অভ্যর্থনা করবে স্থির করতে পারছে না , ভক্তি দেখাতেও সংকোচ , না দেখাতেও লজ্জা । দেহের দৈর্ঘ্য মাঝারি আয়তনের চেয়ে কিছু বড়ো , মনে হয় চারি দিকের সকলের থেকে পৃথক তার ঋজু সুদৃঢ় শরীর , যেন ওকে ঘিরে আছে একটা সূক্ষ্ম ভৌতিক পরিবেষ্টন । ললাট অসামান্য উন্নত , জ্বলজ্বল করছে দুই চোখ , ঠোঁটে রয়েছে অনুচ্চারিত অনুশাসন , মুখের রঙ পান্ডুর স্বচ্ছশ্যাম , অন্তর থেকে বিচ্ছুরিত দীপ্তিতে ধৌত । দাড়িগোঁফ কামানো , সুডৌল মাথায় ছোটো করে ছাঁটা চুল , পায়ে নেই জুতো , তসরের ধুতিপরা , গায়ে খয়েরি রঙের ঢিলে জামা । নাম মুক্তারাম শর্মা ; সকলেরই বিশ্বাস আসল নাম ওটা নয় । পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে ঈষৎ হেসে শান্ত হয়ে থাকে , তা নিয়ে কল্পনা করে নানা লোকে নানা প্রকার , কোনোটা অদ্ভুত অপ্রাকৃত , কোনোটা কুৎসায় কটু । ওর শিক্ষা য়ুরোপে এইরকম জনশ্রুতি — নিশ্চিত প্রমাণ নেই । কলেজের ছেলেরা অনেকে ওর কাছে আসে পড়া নেবার জন্যে , তাদের বিশ্বাস পরীক্ষায় উতরিয়ে দিতে ওর মতো কেউ নেই , অথচ কলেজি শিক্ষার ‘পরে ওর নিরতিশয় অবজ্ঞা । এই শেখাবার উপলক্ষ করে ছেলেদের উপর ওর প্রভাব পড়ছে ছড়িয়ে । এমন একদল আছে যারা ওর জন্য প্রাণ দিতে পারে । এই ছেলেদের ভিতর থেকে বাছাই ক’রে ও একটি অন্তরঙ্গ চক্র তৈরি করেছে কি না কে জানে — হয়তো করেছে । ছুটির সময় একদলকে সঙ্গে নিয়ে ও
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।