রহস্যময় এক পুতুলের গল্প -দেলোয়ার হোসেন

গাঁয়ের নাম মনপুরা—না বনপুরা, সে কথা এখন আর ঠিক মনে নেই। তবে সে গাঁয়ের বদরউদ্দিন বুড়োর কথা ঠিক মনে আছে। শুধু মানুষটাকেই নয়, তার মুখ থেকে শোনা রহস্যময় সেই গল্পটাও হুবহু এখনো মনের পর্দায় ভাসে।

আজ থেকে অনেক বছর আগে, ছোট কাকার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলাম বেড়াতে। তখন আমি হাইস্কুলের ছাত্র, ঢাকাতেই পড়ালেখা করি। কাকার শ্বশুরবাড়িটা গড়াই নদীর ভাটিতে—সবুজ অরণ্যে ঘেরা ছবির মতো একটি গ্রাম। গ্রামের মধ্যে এলোমেলো কোনো পথ নেই—ঢাকার বনানী, গুলশানের মতো। দেবদারু, নারকেল, জারুল ও খেজুরগাছের সারি রাস্তার দুই পাশ জুড়ে। তার মধ্যে সাজানো ঘরবাড়ি। গল্পে গল্পে দু’পা হাঁটলেই নদী। সব দেখে-শুনে এত ভালো লাগলো যে, সাত দিন কাটার পরও মনে হচ্ছিল আরও দু’দিন থেকে যাই। কিন্তু নতুন আত্মীয়ের বাড়ি, লোকলজ্জা বলেও তো একটা কথা আছে!

সে যাই হোক—সেখানে যিনি আমাকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছিলেন, তিনি হলেন বদরউদ্দিন সাহেব, যাকে সবাই বদি বুড়ো বলে থাকে। একেবারেই বৃদ্ধ; কিন্তু তার শিশুর মতো সরল প্রাণ আর মনকাড়া কথা বলার ভঙ্গি আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল এক মায়াবী জগতে।

গ্রামের মধ্যে বদরউদ্দিন সাহেবের সুন্দর একটা তিনতলা বাড়ি। আমি প্রায়ই যেতাম সেখানে। বৈঠকখানায় বসে আমরা গল্প করতাম। একদিন পশ্চিমা দেশগুলোর গল্প বলতে বলতে কেমন আনমনা হয়ে গেলেন তিনি এবং বললেন—অকৃত্রিম ভালোবাসার ছোঁয়ায় পাথরের পুতুলও কথা বলে। আমি হাসতে হাসতে বললাম, তাই কি কখনো হয়? এসব কথার কথা! তিনি হাসলেন; বললেন—পৃথিবীতে কত কিছু ঘটে চলেছে, সবাই কি তার খোঁজ রাখে? এমন অনেক গল্প আছে, যা রূপকথার মতো শোনায়। আবার অনেক রূপকথা শুধুই রূপকথা নয়। আমি পাথরের পুতুলকে হাঁটতে দেখেছি, কথা বলতেও শুনেছি। এ আমার জীবনের অনেক বড় বিস্ময়।

বদরউদ্দিন সাহেবের কথা শুনে আমি তো অবাক! বললাম—শুনেছি, মানুষের তৈরি রোবট নাকি মানুষের মতো কথা বলে, হাঁটা-চলা করে। হয়তো সেটাও একটা রোবট ছিল, দেখতে পাথরের মতো।
তিনি বললেন—তুমি যা ভাবছো তা নয়। পাথরের সেই পুতুলটা আমি নেড়েচেড়ে দেখেছি। প্রতিদিন দেখেছি।

—কোথায় দেখেছেন?
—পারস্য উপসাগরের দক্ষিণ তীরে, আরব উপদ্বীপে আমার মালিকের বাসায়।
—তা হলে সেটা কি জাদুর পুতুল?
—তা হবে কেন!
—আপনি কি দীর্ঘদিন সেখানে ছিলেন?

হ্যাঁ, অনেক দিন আগে স্টিমারে চড়ে আমি আরব দেশে যাই। চাকরির সুবাদে অনেক বিদেশির সাথেই সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার। আরব দেশগুলোতে অনেক ঘুরেছি আমি। আমার সততায় মুগ্ধ হয়ে একদিন ইসমাইল নামে এক শেখ আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। মনোমুগ্ধ এক বিশাল বাড়ির মালিক তিনি। মালিকের দুটি ছেলে-মেয়ে—দুজনেরই শাদি হয়ে গেছে, আলাদা বাড়ি আছে। মালিকের স্ত্রী মারা গেছেন। বাড়িতে তিনটি কাজের লোক, আমাকে নিয়ে চারজন। মালিক কাজের লোকদের পরিচালনার দায়িত্ব দিলেন আমার ওপর।

এ কাজ ছাড়াও মালিকের আরও দুটি কাজ আমাকেই করতে হতো—একটা, মালিকের পছন্দ মতো রান্না করা; আরেকটি, পুতুল পরিষ্কার করা। তিনতলায় বিশেষ একটি ঘরে মালিক থাকেন। ঘরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। ঘরের একপাশে কালো পাথরের গোল একটি বেদির ওপর দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতপাথরের একটি নারী মূর্তি। তার পরনে সাদা নেটের ঘাঘরা, মাথায় হলুদ রঙের ওড়না। মূর্তির ঘাড়টা একটু বাঁকানো। তার চোখের দিকে তাকালে মনে হয় পুতুলটা একেবারেই জীবন্ত, যেন কিছু একটা বলার জন্য লাজুক চোখে চেয়ে আছে।

এই ঘরে মালিক কাউকে ঢুকতে দেন না। শুধু আমি প্রতিদিন সারা ঘরখানা একবার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করি। মালিক বেশিরভাগ সময় ব্যবসার কাজে বিদেশে থাকেন। তখন সেই ঘরের চাবি থাকতো আমার কাছে। আমরা কর্মচারীরা নিচের ঘরগুলোতে থাকতাম। দোতলায় অনেক ঘর মালিকের ব্যবহারের জন্য ছিল। ছাদটা ছিল চমৎকার।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!