গ্রাহাম হক, চার্লজ বালিৎজ ও শয়তানের ত্রিভুজ নিখোঁজ

নিখোঁজ… ৬ ডিসেম্বর, ১৯৪৫। ২য় বিশ্বযুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। ফ্লোরিডার, লডারডেল বিমান ঘাঁটি থেকে পাঁচটি অ্যাভেঞ্জার বোমারু বিমান মার্কিন নৌবাহিনীর প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে আকাশে উঠেছে। প্রতিদিনই উড়ছে তারা, কিন্তু ঐ দিন কিছুক্ষণ পরে গ্রাউন্ড স্টেশন একটি বিপদ-বার্তান পায় দলনেতা লেফটেন্যান্ট চার্লস টেলরের কাছ থেকে। ১৩ জন ক্রুসহ একটি উদ্ধারকারী বিমান তাৎক্ষণিকভাবে আকাশে ওড়ে। কিন্তু অল্পক্ষণ পরে সেটিও অদৃশ্য হয়ে যায়। ফ্লোরিডার তীর বরাবর সাগরে অনেক খোঁজাখুঁজি করেও এই ছয়টি বিমান বা তার ২৭ জন আরোহীর কোন খোঁজ মিলল না।

তিরিশ বছর পর আলোড়ন…বার্মুডা ট্রায়াঙ্গেল

সেই সময়ে এই ঘটনা তেমন কোন আলোড়ন তোলেনি। কারণ এই ধরনের বিমান দুর্ঘটনা হরহামেশাই ঘটতো। সেই সময়ে মার্কিন নৌবাহিনীর ১৩৯টি অ্যাভেঞ্জার বিমান দুর্ঘটনা কবলিত হয়েছিল। কিন্তু আলোড়ন শেষ পর্যন্ত উঠল, প্রায় তিরিশ বছর পরে। চার্লজ বার্লিৎজ নামে এক মার্কিন ভদ্রলোক(?) একখানা বই লিখলেন-বার্মুডা ট্রায়াঙ্গেল। এই বইতে তিনি আটলান্টিকের একটি বিশেষ অঞ্চলকে চিহ্নিত করলেন- অভিশপ্ত ত্রিভুজ হিসেবে। বার্মুডা, ফ্লোরিডা ও পুয়েরটেরিকো-কে শীর্ষবিন্দু ধরলে যে ত্রিভুজ পাওয়া যায় তাই-ই বার্মুডা ট্রায়াঙ্গেল বা বার্লিৎজের ভাষায় ‘শয়তানের ত্রিভুজ’। আরো অনেকগুলো ঘটনার উল্লেখের সঙ্গে সঙ্গে ফাঁদলেন। ব্যাস, বার্লিৎজের কল্পনা বিমান হারানোর ব্যাপারটিকে রহস্যময় ও অলৌকিক করে তুলল।

রহস্য, মুনাফা এবং কী যে সব ব্যাখ্যা…

জানা কথা, রহস্যের প্রতি মানুষের এক দরনের ভয়মিশ্রিত কৌতূহল থাকে। মুনাফালোভীরা সেই সুযোগটাই কাজে লাগালো। এক বছরের মধ্যে বইটির লক্ষাধিক কপি বিক্রি হয়ে গেল, বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হল। এমনকি বাঙালিরাও পিছিয়ে থাকলো না। এভাবে একটি সহজ বিমান দুর্ঘটনা হয়ে উঠলো অলৌকিক রহস্যময়তার এক নিদর্শন। অচিরে বিভিন্ন ব্যাখ্যা হাজির করা হল। যেমন- বার্মুডা ট্রায়াঙ্গেল এলাকায় শয়তানের বিশেষ কাজকর্ম চলছে, ওখানে রয়েছে হারিয়ে যাওয়া মহাদেশ ‘আটলান্টিস’ কিংবা কোন চৌম্বক ক্ষেত্র। তবে সবকিছু ছাপিয়ে উঠলো ‘বহির্জাগতিক’ ব্যাখ্যা। বলা হলো, বিমান বহরটি হাইজ্যাক করেছে উড়ন্ত সবার (উড়ন্ত সসার হল আর একটি উচ্চ মার্গের চাপা ও ধোঁকাবাজি)। এই ব্যাখ্যাটি এতই জনপ্রিয় হল যে, হলিউড চিত্রনির্মাতা ষ্টিফেন স্পিলবার্গ তা চলচ্চিত্রায়িত পর্যন্ত করে ফেললেন। ‘ক্লোজ এনকাউন্টার অব দি থার্ড কাইন্ড’ নামের জনপ্রিয় চলচ্চিত্রে ঐ বিমান বহরগুলিকে একটি মরুময় গ্রহে দেখানো হয়। পরে আরোহীরা একটি মহাকাশযানে করে পৃথিবীতে ফিরে আসে!

উইদাউট এ ট্রেস

‘বার্মূডা ট্রায়াঙ্গেল’-এর সাফল্যে(?) অনুপ্রাণিত হয়ে বার্লিৎজ লিখলেন তার দ্বিতীয় হটকেক ‘উইদাউট এ ট্রেস’। এটিও বার্মুডা ট্রায়াঙ্গেলের গল্প গাঁথা। প্রকাশের পর পরই এটিও কয়েক লক্ষ কপি বিক্রি হয়েছে, বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। চার্লজ বার্লিৎজের অসাধারণত্ব হচ্ছে তার চাপাবাজি ও মিথ্যাচার। তিনি মিথ্যা খুব ভাল বলেন, একেবারে সত্যের মতো করে। তবে, একটু খুটিয়ে পড়লে মিথ্যেগুলো ধরা সম্ভব। পাঁচ বিমান বহরের নেতা চার্লস টেলরের রেডিও বার্তাটির কথা ধরা যাক। বার্লিৎজ লিখেছেন সেটি হল- ‘আমায় অনুসরণ করো না, দেখে মনে হচ্ছে ওরা বহির্বিশ্ব থেকে এসেছে।’ অথচ রেডিও লগে স্পষ্ট করেই লেখা আছে- ‘আমি আমার অবস্থান জানি, -আমি এখন ২৩০০ ফিটে আছি, আমায় অনুসরণ করো না।’ – বুঝুন ঠ্যালা! বার্লিজ-এর আর একটি অদ্ভুত গল্প। ইস্টার্ণ এয়ারলাইন্স-এর একটি বিমান যাচ্ছিলো মিয়ামিতে। হঠাৎ দশ মিনিট ধরে সেটি উধাও হয়ে যায় রাডারের পর্দা থেকে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বাহিনীকে সতর্ক রাখা হয়। শেষ পর্যন্ত বিমান অবতরণের পর দেখা গেল সব যাত্রীর ঘড়ি দশ মিনিট ‘স্লো’ হয়ে গেছে। পাঠক ইতিমধ্যে বার্লিৎজ-এর ভূত হয়তো ধরে ফেলেছেন। হ্যাঁ, ঘটনার দিনক্ষণের কোন উল্লেখ বার্লিৎজ উল্লেখ করেন নি। আর তাই ইস্টার্ণ এয়ারলাইন্সের রেকর্ডপত্র ও মিয়ামি বিমান বন্দরের রেকর্ডপত্রে তেমন কোন ঘটনার খবর মিলছে না!

অনুসন্ধিৎসু গ্রাহাম হক

বার্লিজ-এর কথা থাক। এবারে একজন মার্কিন প্রকৌশলীর কথা বলা যাক। গ্রাহাম হকের কাজ কারবার হচ্ছে সোনার (ঝঙঘঅজ) যন্ত্র দিয়ে সমুদ্রের তলদেশে অনুসন্ধান করা। গেল বছরের (১৯৯২) মে মাসে তিনি ফ্লোরিডার উপকূল থেকে বেশ দূরে, গালফ স্রোতের ওখানে অনুসন্ধান করছিলেন। মে’র দু’তারিখে তার টিভি স্ক্রিনে একটা বিমানের ছবি ফুটে উঠে। বাকি দু’দিনের মধ্যে বাকি চারটি অ্যাভেঞ্জারেরও খোঁজ পাওয়া যায়। প্রায় ৪৫ বছর পরেও এগুলোর পরিচিতি নম্বরগুলো পড়া যাচ্ছিলো এবং চার্লজ টেলারের বিমানটিকে শনাক্ত করতে কষ্টও হয়নি। হকের এই আবিষ্কার চূড়ান্তভাবে বার্লিৎজের গালগল্পের অবসান ঘটাবে বলে আশা করা যায়। তবে মুশকিল হচ্ছে বার্লিৎজের পুরোপুরি উৎখাত করা যায় না। এরা ঘাপটি মেরে বসে থাকে একটি অভিশপ্ত ত্রিভুজের মধ্যে। মানবজাতির জন্য অভিশপ্ত এই ত্রিভুজের তিন শীর্ষবিন্দু হচ্ছে মৌলবাদ, সমরবাদ ও পুঁজিবাদ। গ্রাহাম হকের উচিত ছিল চার্লস টেলরের জুতো জোড়া খুঁজে পাওয়া। তাহলে বার্লিৎজদের আচ্ছামতো জুতিয়ে দেয়া যেত। বার্লিৎজ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের উত্থান ছিল উপসাগরে যুদ্ধের সময়ও-নষ্ট্রাডামুসকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সে অন্য কাহিনী, অন্য গল্প।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!