তাহাকে যথোচিত সংযত করিয়াছি । আমি ইংরাজি বড়ো বড়ো লেখকের লেখা দেখাইয়া তাহাকে অভিভূত করিতে ছাড়ি নাই । সে কোকিলের উপর একটা-কী লিখিয়াছিল , আমি শেলির স্কাইলার্ক্ ও কীট্সের নাইটিঙ্গেল শুনাইয়া তাহাকে একপ্রকার নীরব করিয়া দিয়াছিলাম । তখন বিদ্যার জোরে আমিও যেন শেলি ও কীট্সের গৌরবের কতকটা ভাগী হইয়া পড়িতাম । আমার স্ত্রীও ইংরেজি সাহিত্য হইতে ভালো ভালো জিনিস তাহাকে তর্জমা করিয়া শুনাইবার জন্য আমাকে পীড়াপীড়ি করিত , আমি গর্বের সহিত তাহার অনুরোধ রক্ষা করিতাম । তখন ইংরেজি সাহিত্যের মহিমায় উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়া আমার স্ত্রীর প্রতিভাকে কি ম্লান করি নাই । স্ত্রীলোকের কমনীয়তার পক্ষে এই একটু ছায়ার আচ্ছাদন দরকার , বাবা এবং বন্ধুবান্ধবেরা তাহা বুঝিতেন না — কাজেই আমাকে এই কঠোর কর্ত্যবের ভার লইতে হইয়াছিল । নিশীথের চন্দ্র মধ্যাহ্নের সূর্যের মতো হইয়া উঠিলে দুই দন্ড বাহবা দেওয়া চলে , কিন্তু তাহার পরে ভাবিতে হয় , ওটাকে ঢাকা দেওয়া যায় কী উপায়ে ।
আমার স্ত্রীর লেখা বাবা এবং অন্যান্য অনেকে কাগজে ছাপাইতে উদ্যত হইয়াছিলেন । নির্ঝরিণী তাহাতে লজ্জাপ্রকাশ করিত — আমি তাহার সে লজ্জা রক্ষা করিয়াছি । কাগজে ছাপিতে দিই নাই , কিন্তু বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে প্রচার বন্ধ করিতে পারা গেল না ।
ইহার কুফল যে কতদূর হইতে পারে , কিছুকাল পরে তাহার পরিচয় পাইয়াছিলাম । তখন উকিল হইয়া আলিপুরে বাহির হই । একটা উইল-কেস লইয়া বিরুদ্ধ পক্ষের সঙ্গে খুব জোরের সহিত লড়িতেছিলাম । উইলটি বাংলায় লেখা । স্বপক্ষের অনুকূলে তাহার অর্থ যে কিরূপ স্পষ্ট তাহা বিধিমতে প্রমাণ করিতেছিলাম , এমন সময় বিরোধী পক্ষের উকিল উঠিয়া বলিলেন , “ আমার বিদ্বান বন্ধু যদি তাঁহার বিদুষী স্ত্রীর কাছে এই উইলটি বুঝিয়া লইয়া আসিতেন , তবে এমন অদ্ভুত ব্যাখ্যা দ্বারা মাতৃভাষাকে ব্যথিত করিয়া তুলিতেন না । ”
চুলায় আগুন ধরাইবার বেলা ফুঁ দিতে দিতে নাকের জলে চোখের জলে হইতে হয় , কিন্তু গৃহদাহের আগুন নেবানোই দায় । লোকের ভালো কথা চাপা থাকে , আর অনিষ্টকর কথাগুলো মুখে মুখে হুহুঃ শব্দে ব্যাপ্ত হইয়া যয়ে । এ গল্পটিও সর্বত্র প্রচারিত হইল । ভয় হইয়াছিল , পাছে আমার স্ত্রীর কানে ওঠে । সৌভাগ্যক্রমে ওঠে নাই — অন্তত এ সম্বন্ধে তাহার কাছ হইতে কোনো আলোচনা কখনো শুনি নাই ।
একদিন একটি অপরিচিত ভদ্রলোকের সহিত আমার পরিচয় হইতেই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন , “ আপনিই কি শ্রীমতী নির্ঝরিণী দেবীর স্বামী । ” আমি কহিলাম , “ আমি তাঁহার স্বামী কি না সে কথার জবাব দিতে চাহি না , তবে তিনিই আমার স্ত্রী বটেন । ” বাহিরের লোকের কাছে স্ত্রীর স্বামী বলিয়া খ্যাতিলাভ করা আমি গৌরবের বিষয় বলিয়া জ্ঞান করি নাই ।
সেটা যে গৌরবের বিষয় নহে , সে কথা আমাকে আর-এক ব্যক্তি অনাবশ্যক স্পষ্ট ভাষায় স্মরণ করাইয়া দিয়াছিল । পূর্বেই পাঠকগণ সংবাদ পাইয়াছেন , আমার স্ত্রীর জাঠ্তুতো বোনের বিবাহ হইয়াছে । তাহার স্বামীটা অত্যন্ত বর্বর দুর্বৃত্ত । স্ত্রীর প্রতি তাহার অত্যাচার অসহ্য । আমি এই পাষন্ডের নির্দয়াচরণ লইয়া আত্মীয়সমাজে আলোচনা করিয়াছিলাম , সে কথা অনেক বড়ো হইয়া তাহার কানে উঠিয়াছিল । সে তাহার পর হইতে আমার প্রতি লক্ষ করিয়া সকলের কাছে বলিয়া বেড়াইতেছে যে , নিজের নামে হইতে আরম্ভ করিয়া শ্বশুরের নামে পর্যন্ত উত্তম-মধ্যম-অধম অনেকরকম খ্যাতির বিবরণ শাস্ত্রে লিখিয়াছে , কিন্তু নিজের স্ত্রীর খ্যাতিতে যশস্বী হওয়ার কল্পনা কবির মাথাতেও আসে নাই ।
এমন-সব কথা লোকের মুখে মুখে চলিতে আরম্ভ করিলে স্ত্রীর মনে তো দম্ভ জন্মিতেই পারে । বিশেষত বাবার একটা বদ্ অভ্যাস ছিল , নির্ঝরিণীর সামনেই তিনি আমাদের পরস্পরের বাংলাভাষাজ্ঞান লইয়া কৌতুক করিতেন । একদিন তিনি বলিলেন , “ হরিশ যে-বাংলা চিঠিগুলো লেখে তাহার বানানটা তুমি দেখিয়া দাও-না কেন বউমা– আমাকে এক চিঠি লিখিয়াছে , তাহাতে সে ‘ জগদিন্দ্র ‘ লিখিতে দীর্ঘ ঈ বসাইয়াছে । ” শুনিয়া বাবার বউমা নীরবে একটুখানি স্মিতহাস্য করিলেন । আমিও কথাটাকে ঠাট্টা বলিয়া হাসিলাম , কিন্তু এরকম ঠাট্টা ভালো নয় ।
স্ত্রীর দম্ভের পরিচয় পাইতে আমার দেরি হইল না । পাড়ার ছেলেদের এক ক্লাব আছে ; সেখানে একদিন তাহারা এক বিখ্যাত বাংলা-লেখককে বক্তৃতা দিতে রাজি করিয়াছিল । অপর একটি বিখ্যাত লোককে সভাপতিও ঠিক করা হয় ; তিনি বক্তৃতার পূর্বরাত্রে অস্বাস্থ্য জানাইয়া ছুটি লইলেন । ছেলেরা উপায়ান্তর না দেখিয়া আমাকে আসিয়া ধরিল । আমার প্রতি ছেলেদের এই অহৈতুকী শ্রদ্ধা দেখিয়া আমি কিছু প্রফুল্ল হইয়া উঠিলাম। বলিলাম , “ তা বেশ তো , বিষয়টা কী বলো তো । ”
তাহারা কহিল , “ প্রাচীন ও আধুনিক বঙ্গসাহিত্য । ”
আমি কহিলাম , “ বেশ হইবে , দুটোই আমি ঠিক সমান জানি । ”
পরদিন সভায় যাইবার পূর্বে জলখাবার এবং কাপড়চোপড়ের জন্য স্ত্রীকে কিছু তাড়া দিতে লাগিলাম । নির্ঝরিণী কহিল , “ কেন গো , এত ব্যস্ত কেন — আবার কি পাত্রী দেখিতে যাইতেছ । ”
আমি কহিলাম , “ একবার দেখিয়াই নাকে-কানে খত দিয়াছি ; আর নয় । ”
“ তবে এত সাজসজ্জার তাড়া যে । ”
স্ত্রীকে সগর্বে সমস্ত ব্যাপারটা বলিলাম । শুনিয়া সে কিছুমাত্র উল্লাস প্রকাশ না করিয়া ব্যাকুলভাবে আমার হাত চাপিয়া ধরিল । কহিল , “ তুমি পাগল হইয়াছ ? না না, সেখানে তুমি যাইতে পারিবে না । ”
আমি কহিলাম , “ রাজপুতনারী যুদ্ধসাজ পরাইয়া স্বামীকে রণক্ষেত্রে পাঠাইয়া দিত — আর বাঙালির মেয়ে কি বক্তৃতাসভাতেও পাঠাইতে পারে না । ”
নির্ঝরিণী কহিল , “ ইংরেজি বক্তৃতা হইলে আমি ভয় করিতাম না , কিন্তু — থাক্ না , অনেক লোক আসিবে , তোমার অভ্যাস নাই — শেষকালে —”
শেষকালের কথাটা আমিও কি মাঝে মাঝে ভাবি নাই । রামমোহন রায়ের গানটা মনে পড়িতেছিল —
মনে করো শেষের সে দিন ভয়ংকর ,
অন্যে বাক্য কবে কিন্তু তুমি রবে নিরুত্তর ।
বক্তার বক্তৃতা-অন্তে উঠিয়া দাঁড়াইবার সময় সভাপতি যদি হঠাৎ ‘ দৃষ্টিহীন নাড়ীক্ষীণ হিমকলেবর ‘ অবস্থায় একেবারে নিরুত্তর হইয়া পড়েন, তবে কী গতি হইবে । এই-সকল কথা চিন্তা করিয়া পূর্বোক্ত পলাতক সভাপতিমহাশয়ের চেয়ে আমার স্বাস্থ্য যে কোনো অংশে ভালো ছিল , এমন কথা আমি বলিতে পারি না ।
বুক ফুলাইয়া স্ত্রীকে কহিলাম , “ নিঝর , তুমি কি মনে কর —”
স্ত্রী কহিল , “ আমি কিছুই মনে করি না- কিন্তু আমার আজ ভারি মাথা ধরিয়া আসিয়াছে , বোধ হয় জ্বর আসিবে , তুমি আজ আমাকে ফেলিয়া যাইতে পারিবে না । ”
আমি কহিলাম , “ সে আলাদা কথা । তোমার মুখটা একটু লাল দেখাইতেছে বটে । ”
সেই লালটা সভাস্থলে আমার দুরবস্থা কল্পনা করিয়া লজ্জায় অথবা আসন্ন জ্বরের আবেশে , সে কথা নিঃসংশয়ে পর্যালোচনা না করিয়াই আমি ক্লাবের সেক্রেটারিকে স্ত্রীর পীড়ার কথা জানাইয়া নিষ্কৃতিলাভ করিলাম ।
গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।