চোরাই ধন– ২য় অংশ– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

বাড়িতে । শৈলেন এল , তার অকস্মাৎ আবির্ভাব সুনেত্রার পছন্দ নয় , সেটা বোঝা কঠিন ছিল না । আমি শৈলেনকে বললেম , “ গণিতে আমার যেটুকু দখল তাতে হাল আমলের ফিজিক্সের তল পাই নে , তাই তোমাকে ডেকে পাঠানো ; কোয়ান্টম থিওরিটা যথাসাধ্য বুঝে নিতে চাই , আমার সেকেলে বিদ্যেসাধ্যি অত্যন্ত বেশি অথর্ব হয়ে পড়েছে । ”বলা বাহুল্য , বিদ্যাচর্চা বেশিদূর এগোয় নি । আমার নিশ্চিত বিশ্বাস অরুণা তার বাবার চাতুরি স্পষ্টই ধরেছে আর মনে মনে বলেছে , এমন আদর্শ বাবা অন্য কোনো পরিবারে আজ পর্যন্ত অবতীর্ণ হয় নি ।

কোয়ান্টম থিওরির ঠিক শুরুতেই বাজল টেলিফোনের ঘন্টা — ধড়ফড়িয়ে উঠে বললেম , “ জরুরি কাজের ডাক । তোমরা এক কাজ করো , ততক্ষণ পার্লার টেনিস খেলো , ছুটি পেলেই আবার আসব ফিরে । ”

টেলিফোনে আওয়াজ এল , “ হ্যালো , এটা কি বারোশো অমুক নম্বর । ”

আমি বললেম , “ না , এখানকার নম্বর সাতশো অমুক । ”

পরক্ষণেই নিচের ঘরে গিয়ে একখানা বাসি খবরের কাগজ তুলে নিয়ে পড়তে শুরু করলেম , অন্ধকার হয়ে এল , দিলেম বাতি জ্বেলে ।

সুনেত্রা এল ঘরে । অত্যন্ত গম্ভীর মুখ । আমি হেসে বললেম , “ মিটিয়রলজিস্ট্‌ তোমার মুখ দেখলে ঝড়ের সিগ্ নাল দিত । ”

ঠাট্টায় যোগ না দিয়ে সুনেত্রা বললে , “ কেন তুমি শৈলেনকে অমন করে প্রশ্রয় দাও বারে বারে । ”

আমি বললেম , “ প্রশ্রয় দেবার লোক অদৃশ্যে আছে ওর অন্তরাত্মায় । ”

“ ওদের দেখাশোনাটা কিছুদিন বন্ধ রাখতে পারলে এই ছেলেমানুষিটা কেটে যেত আপনা হতেই । ”

“ ছেলেমানুষির কসাইগিরি করতে যাবই বা কেন । দিন যাবে , বয়স বাড়বে , এমন ছেলেমানুষি আর তো ফিরে পাবে না কোনো কালে । ”

“ তুমি গ্রহনক্ষত্র মান ‘ না , আমি মানি । ওরা মিলতে পারে না । ”

“ গ্রহনক্ষত্র কোথায় কী ভাবে মিলেছে চোখে পড়ে না , কিন্তু ওরা দুজনে যে মিলেছে অন্তরে অন্তরে সেটা দেখা যাচ্ছে খুব স্পষ্ট করেই । ”

“ তুমি বুঝবে না আমার কথা । যখনি আমরা জন্মাই তখনি আমাদের যথার্থ দোসর ঠিক হয়ে থাকে । মোহের ছলনায় আর-কাউকে যদি স্বীকার করে নিই তবে তাতেই ঘটে অজ্ঞাত অসতীত্ব । নানা দুঃখে বিপদে তার শাস্তি । ”

“ যথার্থ দোসর চিনব কী করে । ”

“ নক্ষত্রের স্বহস্তে স্বাক্ষর-করা দলিল আছে । ”

আর লুকোনো চলল না ।

আমার শ্বশুর অজিতকুমার ভট্টাচার্য । বনেদি পণ্ডিত-বংশে তাঁর জন্ম । বাল্যকাল কেটেছে চতুষ্পাঠীর আবহাওয়ায় । পরে কলকাতায় এসে কলেজে নিয়েছেন এম. এ. ডিগ্রি গণিতে । ফলিত জ্যোতিষে তাঁর যেমন বিশ্বাস ছিল তেমনি ব্যুৎপত্তি । তাঁর বাবা ছিলেন পাকা নৈয়ায়িক, ঈশ্বর তাঁর মতে অসিদ্ধ ; আমার শ্বশুরও দেবদেবী কিছুই মানতেন না তার প্রমাণ পেয়েছি । তাঁর সমস্ত বেকার বিশ্বাস ভিড় করে এসে পড়েছিল গ্রহনক্ষত্রের উপর , একরকম গোঁড়ামি বললেই হয় । এই ঘরে জন্মেছে সুনেত্রা ; বাল্যকাল থেকে তার চার দিকে গ্রহনক্ষত্রের কড়া পাহারা ।

আমি ছিলুম অধ্যাপকের প্রিয় ছাত্র , সুনেত্রাকেও তার পিতা দিতেন শিক্ষা । পরস্পর মেলবার সুযোগ হয়েছিল বার বার । সুযোগটা যে ব্যর্থ হয় নি সে খবরটা বেতার বিদ্যুদ্‌বার্তায় আমার কাছে ব্যক্ত হয়েছে । আমার শাশুড়ির নাম বিভাবতী । সাবেক কালের আওতার মধ্যে তাঁর জন্ম বটে , কিন্তু স্বামীর সংসর্গে তাঁর মন ছিল সংস্কারমুক্ত , স্বচ্ছ । স্বামীর সঙ্গে প্রভেদ এই , গ্রহনক্ষত্র তিনি একেবারেই মানতেন না , মানতেন আপন ইষ্টদেবতাকে । এ নিয়ে স্বামী একদিন ঠাট্টা করাতে বলেছিলেন , “ ভয়ে ভয়ে তুমি পেয়েদাগুলোর কাছে সেলাম ঠুকে বেড়াও , আমি মানি স্বয়ং রাজাকে । ”

স্বামী বললেন , “ ঠকবে । রাজা থাকলেও যা না থাকলেও তা, লাঠি-ঘাড়ে নিশ্চিত আছে পেয়াদার দল । ”

শাশুড়ি ঠাকরুন বললেন , “ ঠকব সেও ভালো । তাই বলে দেউড়ির দরবারে গিয়ে নাগরা জুতোর কাছে মাথা হেঁট করতে পারব না । ”

আমার শাশুড়ি আমাকে বড়ো স্নেহ করতেন । তাঁর কাছে আমার মনের কথা ছিল অবারিত । অবকাশ বুঝে একদিন তাঁকে বললেম , “ মা , তোমার নেই ছেলে আমার নেই মা । মেয়ে দিয়ে আমাকে দাও তোমার ছেলের জায়গাটি । তোমার সম্মতি পেলে তার পরে পায়ে ধরব অধ্যাপকের । ”

তিনি বললেন , “ অধ্যাপকের কথা পরে হবে বাছা , আগে তোমার ঠিকুজি এনে দাও আমার কাছে । ”

দিলেম এনে । তিনি বললেন , “ হবার নয় । অধ্যাপকের মত হবে না । অধ্যাপকের মেয়েটিও তার বাপেরই শিষ্যা । ”

আমি জিজ্ঞাসা করলুম , “ মেয়ের মা ? ”

বললেন , “ আমার কথা বোলো না । আমি তোমাকে জানি , আমার মেয়ের মনও জানি , তার বেশি জানবার জন্যে নক্ষত্রলোকে ছোটবার শখ নেই আমার । ”

আমার মন উঠল বিদ্রোহী হয়ে । বললেম , এমনতরো অবাস্তব বাধা মানাই অন্যায় । কিন্তু , যা অবাস্তব তার গায়ে ঘা বসে না । তার সঙ্গে লড়াই করব কী দিয়ে ।

এদিকে মেয়ের সম্বন্ধের কথা আসতে লাগল নানা দিক থেকে । গ্রহতারকার অসম্মতি নেই এমন প্রস্তাবও ছিল তার মধ্যে । মেয়ে জিদ করে বলে বসল , সে চিরকাল কুমারী থাকবে , বিদ্যার সাধনাতেই যাবে তার দিন ।

বাপ মানে বুঝলেন না , তাঁর মনে পড়ল লীলাবতীর কথা । মা বুঝলেন , গোপনে জল পড়তে লাগল তাঁর চোখ দিয়ে । অবশেষে একদিন মা আমার হাতে একখানি কাগজ দিয়ে বললেন , “ সুনেত্রার ঠিকুজি । এই দেখিয়ে তোমার জন্মপত্রী সংশোধন করিয়ে নিয়ে এসো । আমার মেয়ের অকারণ দুঃখ সইতে পারব না । ”

পরে কী হল বলতে হবে না । ঠিকুজির অঙ্কজাল থেকে সুনেত্রাকে উদ্ধার করে আনলেম । চোখের জল মুছতে মুছতে মা বললেন , “ পুণ্যকর্ম করেছ , বাছা । ” তার পরে গেছে একুশ বছর কেটে ।

গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!