শেষের রাত্রি– দ্বিতীয় অংশ– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

“মাসি, ঘড়িতে কটা বেজেছে ।”

“নটা বাজবে ।”

“সবে নটা ? আমি ভাবছিলুম, বুঝি দুটো, তিনটে, কি কটা হবে । সন্ধ্যার পর থেকেই আমার দুপুর রাত আরম্ভ হয় । তবে তুমি আমার ঘুমের জন্যে অত ব্যস্ত হয়েছিলে কেন ।”

“কালও সন্ধ্যার পর এইরকম কথা কইতে কইতে কত রাত পর্যন্ত তোমার আর ঘুম এল না ,তাই আজ তোমাকে সকাল-সকাল ঘুমোতে বলছি ।”

“মণি কি ঘুমিয়েছে ।”

“না, সে তোমার জন্যে মসুরির ডালের সুপ তৈরি ক’রে তবে ঘুমোতে যায়।”

“বলো কী, মাসি, মণি কি তবে—”

“সেই তো তোমার জন্যে সব পথ্যি তৈরি করে দেয়। তার কি বিশ্রাম আছে ।”

“আমি ভাবতুম ,মণি বুঝি –”

“মেয়েমানুষের কি আর এ-সব শিখতে হয় । দায়ে পড়লেই আপনি করে নেয় ।”

“আজ দুপুরবেলা মৌরলা মাছের যে ঝোল হয়েছিল তাতে বড়ো সুন্দর একটি তার ছিল । আমি ভাবছিলুম, তোমারই হাতের তৈরি ।”

“কপাল আমার ! মণি কি আমাকে কিছু করতে দেয় । তোমার গামছা তোয়ালে নিজের হাতে কেচে শুকিয়ে রাখে । জানে যে, কোথাও কিছু নোংরা তুমি দেখতে পার না । তোমার বাইরের বৈঠকখানা যদি ঐকবার দেখ তবে দেখতে পাবে, মণি দুবেলা সমস্ত ঝেড়ে মুছে কেমন তক্‌তকে ক’রে রেখে দিয়েছে ; আমি যদি তোমার এ ঘরে ওকে সর্বদা আসতে দিতুম তা হলে কি আর রক্ষা থাকত ! ও তো তাই চায় ।”

“মণির শরীরটা বুঝি –”

“ডাক্তাররা বলে রোগীর ঘরে ওকে সর্বদা অনাগোনা করতে দেওয়া কিছু নয় । ওর মন বড়ো নরম কি না, তোমার কষ্ট দেখলে দুদিনে যে শরীর ভেঙে পড়বে ।”

“মাসি, ওকে তুমি ঠেকিয়ে রাখ কী ক’রে ।”

“আমাকে ও বড্ডো মানে বলেই পারি । তবু বার বার গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হয়— ঐ আমার আর-এক কাজ হয়েছে ।”

আকাশের তারাগুলি যেন করুণা-বিগলিত চোখের জলের মতো জ্বল্‌জ্বল্‌ করিতে লাগিল । যে জীবন আজ বিদায় লইবার পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যতীন তাহাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতার প্রণাম করিল— এবং সম্মুখে মৃত্যু আসিয়া অন্ধকারের ভিতর হইতে যে দক্ষিণ হাত বাড়াইয়া দিয়াছে যতীন স্নিগ্ধ বিশ্বাসের সহিত তাহার উপরে আপনার রোগক্লান্ত হাতটি রাখিল ।

একবার নিশ্বাস ফেলিয়া, একটুখানি উস্‌খুস্‌ করিয়া যতীন বলিল , “মাসি, মণি যদি জেগেই থাকে তা হলে একবার যদি তাকে—”

“এখনি ডেকে দিচ্ছি , বাবা ।”

“আমি বেশিক্ষণ তাকে এ ঘরে রাখতে চাই নে— কেবল পাঁচ মিনিট— দুটো একটা কথা যা বলবার আছে—”
মাসি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মণিকে ডাকিতে আসিলেন । এদিকে যতীনের নাড়ী দ্রুত চলিতে লাগিল । যতীন জানে, আজ পর্যন্ত সে মণির সঙ্গে ভালো করিয়া কথা জমাইতে পারে নাই । দুই যন্ত্র সুরে বাঁধা ,একসঙ্গে আলাপ চলা বড়ো কঠিন । মণি তাহার সঙ্গিনীদের সঙ্গে অনর্গল বকিতেছে হাসিতেছে,দূর হইতে তাহাই শুনিয়া যতীনের মন কতবার ঈর্ষায় পীড়িত হইয়াছে । যতীন নিজেকেই দোষ দিয়াছে— সে কেন অমন সামান্য যাহা-তাহা লইয়া কথা কহিতে পারে না । পারে না যে তাহাও তো নহে,নিজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যতীন সামান্য বিষয় লইয়াই কি আলাপ করে না । কিন্তু পুরুষের যাহা-তাহা তো মেয়েদের যাহা-তাহার সঙ্গে ঠিক মেলে না । বড়ো কথা একলাই একটানা বলিয়া যাওয়া চলে, অন্য পক্ষ মন দিল কি না খেয়াল না করিলেই হয়, কিন্তু তুচ্ছ কথায় নিয়ত দুই পক্ষের যোগ থাকা চাই ; বাঁশি একাই বাজিতে পারে, কিন্তু দুইয়ের মিল না থাকিলে করতালের খচমচ জমে না । এইজন্যে কত সন্ধ্যাবেলায় যতীন মণির সঙ্গে যখন খোলা বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে, দুটো-চারটে টানাবোনা কথার পরেই কথার সূত্র একেবারে ছিঁড়িয়া ফাঁক হইয়া গেছে ; তাহার পরে সন্ধ্যার নীরবতা যেন লজ্জায় মরিতে চাহিয়াছে । যতীন বুঝিতে পারিয়াছে, মণি পালাইতে পারিলে বাঁচে; মনে মনে কামনা করিয়াছে, এখনই কোনো একজন তৃতীয় ব্যক্তি যেন আসিয়া পড়ে। কেননা, দুই জনে কথা কহা কঠিন, তিন জনে সহজ ।

মণি আসিলে আজ কেমন করিয়া কথা আরম্ভ করিবে, যতীন তাহাই ভাবিতে লাগিল । ভাবিতে গেলে কথাগুলো কেমন অস্বাভাবিক রকম বড়ো হইয়া পড়ে— সে-সব কথা চলিবে না । যতীনের আশঙ্কা হইতে লাগিল, আজকের রাত্রের পাঁচ মিনিটও ব্যর্থ হইবে । অথচ,তাহার জীবনে এমনতরো নিরালা পাঁচ মিনিট আর কটাই বা বাকি আছে ।

“একি, বউ, কোথাও যাচ্ছ না কি ।”

“সীতারামপুরে যাব ।”

“সে কী কথা । কার সঙ্গে যাবে ।”

“অনাথ নিয়ে যাচ্ছে ।”

“লক্ষী মা আমার , তুমি যেয়ো , আমি তোমাকে বারণ করব না, কিন্তু আজ নয় ।”

“টিকিট কিনে গাড়ি রিজার্ভ করা হয়ে গেছে ।”

“তা হোক, ও লোকসান গায়ে সইবে— তুমি কাল সক্কালেই চলে যেয়ো— আজ যেয়ো না ।”

“মাসি, আমি তোমাদের তিথি বার মানি নে, আজ গেলে দোষ কী ।”

“যতীন তোমাকে ডেকেছে, তোমার সঙ্গে তার একটু কথা আছে ।”

“বেশ তো, এখনো একটু সময় আছে, আমি তাঁকে ব’লে আসছি ।”

“না, তুমি বলতে পারবে না যে যাচ্ছ ।”

“তা বেশ, কিছু বলব না, কিন্তু আমি দেরি করতে পারব না । কালই অন্নপ্রাশন— আজ যদি না যাই তো চলবে না ।”

“আমি জোড়হাত করছি, বউ, আমার কথা আজ একদিনের মতো রাখো । আজ মন একটু শান্ত করে যতীনের কাছে এসে বসো— তাড়াতাড়ি কোরো না ।”

“তা, কী করব বলো, গাড়ি তো আমার জন্যে বসে থাকবে না । অনাথ চলে গেছে— দশ মিনিট পরেই সে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এই বেলা তাঁর সঙ্গে দেখা সেরে আসি গে।”

“না, তবে থাক— তুমি যাও । এমন করে তার কাছে যেতে দেব না । ওরে অভাগিনী, তুই যাকে এত দুঃখ দিলি সে তো সব বিসর্জন দিয়ে আজ বাদে কাল চলে যাবে— কিন্তু যত দিন বেঁচে থাকবি এ দিনের কথা তোকে চিরদিন মনে রাখতে হবে— ভগবান আছেন, ভগবান আছেন, সে কথা একদিন বুঝবি ।”

“মাসি, তুমি অমন ক’রে শাপ দিয়ো না বলছি ! ”

“ওরে বাপরে, আর কেন বেঁচে আছিস রে বাপ। পাপের যে শেষ নেই— আমি আর ঠেকিয়া রাকতে পারলুম না।”
মাসি একটু দেরি করিয়া রোগীর ঘরে গেলেন। আশা করিলেন, যতীন ঘুমাইয়া পড়িবে। কিন্তু ঘরে ঢুকিতেই দেখিলেন, বিছানার উপর যতীন নড়িয়া-চড়িয়া উঠিল। মাসি বলিলেন, “এই এক কাণ্ড করে বসেছে।”

“কী হয়েছে। মণি এল না ? এত দেরি করলে কেন, মাসি।”

“গিয়ে দেখি, সে তোমার দুধ জ্বাল দিতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে ব’লে কান্না। আমি বলি, ‘হয়েছে কী, আরো তো দুধ আছে।’ কিন্তু, অসাবধান হয়ে তোমার খাবার দুধ পুড়িয়ে ফেলেছে, বউয়ের এ লজ্জা আর কিছুতেই যায় না । আমি তাকে অনেক ক’রে ঠাণ্ডা ক’রে বিছানায় শুইয়ে রেখে এসেছি । আজ আর তাকে আনলুম না । সে একটু ঘুমোক ।”

মণি আসিল না বলিয়া যতীনের বুকের মধ্যে যেমন বাজিল, তেমনি সে আরামও পাইল। তাহার মনে আশঙ্কা ছিল যে, পাছে মণি সশরীরে আসিয়া মণির ধ্যান-মাধুরীটুকুর প্রতি জুলুম করিয়া যায় । কেননা,তাহার জীবনে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে । দুধ পুড়াইয়া ফেলিয়া মণির কোমল হৃদয় অনুতাপে ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে, ইহারই রসটুকুতে তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিতে লাগিল ।

“মাসি! ”

“কী, বাবা ।”

“আমি বেশ জানছি, আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে । কিন্তু, আমার মনে কোনো খেদ নেই । তুমি আমার জন্যে শোক কোরো না ।”

“না, বাবা, আমি শোক করব না । জীবনেই যে মঙ্গলই আর মরণে যে নয়, এ কথা আমি মনে করি নে ।”

“মাসি, তোমাকে সত্য বলছি, মৃত্যুকে আমার মধুর মনে হচ্ছে ।”

অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাইয়া যতীন দেখিতেছিল,তাহার মণিই আজ মৃত্যুর বেশ ধরিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে । সে আজ অক্ষয় যৌবনে পূর্ণ– সে গৃহিণী,সে জননী; সে রূপসী, সে কল্যাণী । তাহারই এলোচুলের উপরে ঐ আকাশের তারাগুলি লক্ষীর স্বহস্তের আর্শীবাদের মালা । তাহাদের দুজনের মাথার উপরে এই অন্ধকারের মঙ্গলবস্ত্রখানি মেলিয়া ধরিয়া আবার যেন নূতন করিয়া শুভদৃষ্টি হইল । রাত্রির এই বিপুল অন্ধকার ভরিয়া গেল মণির অনিমেষ প্রেমের দৃষ্টিপাতে । এই ঘরের বধূ মণি, এই একটুখানি মণি, আজ বিশ্বরূপ ধরিল; জীবনমরণের সংগমতীর্থে ঐ নক্ষত্রবেদীর উপরে সে বসিল ; নিস্তব্ধ রাত্রি মঙ্গলঘটের মতো পুণ্যধারায় ভরিয়া উঠিল । যতীন জোড়হাত করিয়া মনে মনে কহিল, ‘এতদিনের পর ঘোমটা খুলিল, এই ঘোর অন্ধকারের মধ্যে আবরণ ঘুচিল— অনেক কাঁদাইয়াছ— সুন্দর,হে সুন্দর,তুমি আর ফাঁকি দিতে পারিবে না।’

গল্পের তৃতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!