মেজর বাংলাদেশ– রাগিব নিযাম জিসান

১৯৪২ সালের কোনো এক জানুয়ারির সকালে, আছিয়া খাতুন খবর পান যে তার ছেলে শহিদুল্লাহ মুস্তাকিম ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর পদাতিক সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়েছেন। ফিরতি একটি টেলিগ্রামে আছিয়া তার ছেলেকে সাবধানে থাকতে বলেন।

তার ঠিক দুদিন পর শহিদুল্লাহ লাপাত্তা হয়ে যান। সাথে ছিলো পাক-ভারত উপমহাদেশের সমুদ্র সীমার রেপ্লিকা করা একমাত্র ম্যাপ। সেই ম্যাপে এমন কি ছিলো যার কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী গরুখোজা শুরু করে শহিদুল্লাহকে? ৬৯ এর আগে তার কিছুই জানা যায় নি।

৭০ সালে হঠাৎ লাহোরে খোজ পাওয়া যায় শহিদুল্লাহ বেচে আছেন এবং পাকিস্তান আর্মিতে মেজর পদে আছেন। সেই বছরের শেষদিকে তার মতো কিছু বাংগালিকে হঠাৎ কোনরকম কারণ ছাড়াই বহিষ্কার করা হয়। এই ঘটনায় বিচলিত না হয়ে শহিদুল্লাহ ধৈর্য ধরে বাংলাদেশে চলে আসার চেষ্টা করেন এবং ৭১ সালের ফেব্রুয়ারিতে পারমিট পেয়ে যান। তার আগের বছরের নভেম্বর মাসে হঠাৎ করে একজন বাংগালি ডাক্তার তাকে বাসায় নিয়ে যান জরুরি বৈঠকে। সেই ২৯শে নভেম্বর রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কি নিয়ে আলোচনা হয়েছিলো তা জানা যায়নি। তবে পরদিন সকালে শহিদুল্লাহ ডাক্তারের কাছ থেকে এক বাক্স বোতল পান যা নাকি শক্তিবর্ধক।

১৯ মার্চে একটা জাম্বো জেট প্লেনে চড়ে আরো অনেকের সাথে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন শহিদুল্লাহ। প্লেনটি যখন ভারতের বর্ডার ক্রস করছিলো তখন হঠাৎ প্লেনে খুনাখুনি শুরু হয়ে যায়। শহিদুল্লাহ আত্নরক্ষার্থে ফুয়েল ট্যাংক রুমে ঢোকেন। সাথে সেই বাক্স। এক পর্যায়ে পাইলট খুন হয়ে যান এবং খুনি কন্ট্রোল নিতে না পেরে প্লেন থেকে প্যারাসুটসসহ লাফ দেয়। ক্রাশ খেয়ে প্লেনটি এমন জায়গায় পড়ে যা থেকে প্লেনের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার সম্ভব নয়। এমনকি বোতলের বাক্সটিও নয়। শেষ সময়ে বুঝতে পেরে মেজর বোতল সবগুলির ভেতরের তরল গিলে ফেলেন। তারপরের ঘটনা অজানা থেকে যায়।

অতঃপর ২০১৩ সাল। জানুয়ারি মাসে নৃতাত্ত্বিক একটি রিসার্চ টিম শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে প্রাচীন সভ্যতা আবিষ্কারের উদ্দেশ্য গিয়ে হতবাক হয়ে যায়। প্লেনটির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করতে গিয়ে বের করে আনে মাটির তলা থেকে এক মৃতপ্রায় মানুষকে।

শহিদুল্লাহ’র বেচে ফেরাটা অনেকটা অলৌকিক। তবে আরো বিস্ময়কর ছিলো তার শরীরের বার্ধক্য প্রতিরোধ ক্ষমতা। সেই বোতলগুলিতে রহস্যজনক সেই তরল পদার্থ তার শরীরের কোষ ধ্বংসের ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। যার কারণে প্রায় ৪৩ বছর অক্ষত থাকে তার জীবন প্রক্রিয়া। হাসপাতালে নেয়ার পর দ্রুত ব্লাড স্যাম্পল নেয়া হয় যাতে তার রক্তে এমন কি উপাদান আছে তা দেখার জন্য।

গ্লাসের এপাশে দাড়িয়ে আইসিইউ সেন্টারের ওপাশে ঘুমিয়ে থাকা মানুষটিকে দেখছেন ডিজিএফআই কমান্ডার মেজর তালহা। অদ্ভুত রকমের শক্ত গড়নের শরীরের মানুষ শহিদুল্লাহ। লম্বায় পাচ ফিট এগারো ইঞ্চি। ১৯৭০ এর পর থেকে আজ পর্যন্ত যদি ৪৩ বছর হয় শহিদুল্লাহর থাকার কথা কবরে। অথচ ৩৫ বছর বয়সের যুবক লাগছে। শহিদুল্লাহ কি মানুষ নক অন্যকিছু?

-মেজর তালহা?
-ইয়েস?
-ব্লাড স্যাম্পল রিপোর্ট রেডি।
-জ্বি দেখান!

ব্লাড স্যাম্পল রিপোর্ট দেখে একটু ভ্রু কুচকে উঠলো তালহার। হজম করতে কষ্ট হলো। এটা কি করে সম্ভব? এভাবে কি কোন মানুষ অমরত্বের কাছাকাছি যেতে পারে?

সেই সময়টা শাহবাগ আন্দোলন এর সময়। হঠাৎ এমন অদ্ভুত খবর পেয়ে নড়েচড়ে বসলো পত্রিকাগুলো। টিভি চ্যানেলগুলো পিজি হাসপাতালে এসে ঘাপটি মেরে রইলো।

শীর্ষ হেডলাইন ছিলো- “major bangladesh is alive”।
সিরিঞ্জটা একটানে খুলে নিয়ে বেড থেকে নেমে পড়লো শহিদুল্লাহ। পেছন পেছন দৌড়ে আসছেন তালহা, নার্স, ওয়ার্ড বয় এবং আরো অনেকে। দৌড়ে ছুট লাগালো স্টেডিয়াম অভিমুখে। হতবাক হয়ে গেলো চারপাশের অবস্থা দেখে। ৬৬ বছর আগে এসব কল্পনা করা যায় না। আর আজ যেনো কতো তারিখ? একটা লোককে জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো শহিদুল্লাহ। একটা ভ্যানগাড়িতে আগুন জ্বলতে দেখে চারপাশে চোখ বুলালো। মানুষের আহাজারি। “হায় হায় কুরআন পুড়াইলোরে” চারদিকে আর্তধ্বনি। মাথা ঘুরিয়ে দেখলো একদল লোক ভ্যানে আগুন দিচ্ছে।
-আ্যই বেজন্মার গুষ্টি! তোরা কিসে আগুন দিচ্ছিস তোরা জানিস?
-কি আমরা বেজন্মা?
-তো আর কি?

সাথে সাথে একটা লোক রিভলবার বের করে শহিদুল্লাহর বুক বরাবরে গুলি চালালো। দেখাদেখি আরো কয়জন গুলি চালালো। মুহুর্মুহু গুলিতে গোটা স্টেডিয়াম মার্কেট এলাকা নরকে পরিনত হলো। ঢেকে গেলো ধোয়ায়।

কিইইচ করে টায়ার পিছলা খাওয়ার আওয়াজ হলো রাস্তায়। ধোয়ায় সরে গিয়ে মুক্ত বাতাসের দখলে গেলো স্টেডিয়াম এলাকা। মানুষটা তারপরও ঠায় দাঁড়িয়ে। দুই হাত মুঠ করে পাজরের দিকে টানতে লাগলো ভ্যানে আগুন দেয়া লোকগুলোর বরাবর।

“খট খট খটাং” বিশ্রী ধাতব শব্দ তুলে বুলেটগুলো ফিরে গেলো তাদের আগের জায়গায়।

মুহুর্তে দশগুণ নরকের আগুনে পরিনত হলো। আক্রমণকারীদের দিক থেকে গগনবিদারী আওয়াজ এলো। এক লোক হাটুতে হাত দিয়ে ক্ষত চেপে ধরে চোখ বড়ো বড়ো করে নিশ্বাস নিয়ে বললো, “কে তুমি?”

পেছন থেকে শহিদুল্লাহর পাশে এসে দাঁড়ালেন মেজর তালহা।

“উনি মেজর বাংলাদেশ”

দুঃখিত!