“জ্বিন কন্যা” একটি ভৌতিক রহস্য গল্প

কে, কে ওখানে?

— কে, কে ওখানে?

— আমি।

— আমি কে?

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ। কোনো উত্তর নেই। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ। আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম — আমি কে? কথা বলছেন না কেন?

— আমি!

— আমি কে? — আমি আবারও ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করলাম।

— আমি কেউ না।

— তবে আমার ঘরে কী করছেন? কীভাবে এসেছেন? দরজা খুলল কে? — একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করে আমি প্রায় হাঁপিয়ে উঠলাম। এমনিতেই আমার হার্টের অবস্থা ভালো নয়। এখন তো মনে হচ্ছে ভয়ে হার্ট ফেল করবে।

ঘুমিয়ে ছিলাম; হঠাৎ খুট খুট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ভেবেছিলাম ইঁদুর-টিদুর হবে। কাজের মেয়েটার ওপর মেজাজ খারাপ হলো। কতদিন বলেছি রাতে শোওয়ার আগে তেলাপোকা-ইঁদুরের ওষুধ ছিটিয়ে ঘুমাতে। না, তার কোনো খবর নেই। মনে হয় এনে দেওয়া ওষুধগুলোর কথা মেয়েটা ভুলেই গেছে। কাল নিজেই ছিটিয়ে দিতে হবে।

রাতে এমনিতেই আমার ঘুম হয় না। তাও আজ লেট নাইটে শুয়েছি। ভোরে অফিস ধরতে হবে। একবার ঘুম ভাঙলে আর ঘুম আসবে না। আমার স্ত্রী তিথি ছেলে-মেয়েকে নিয়ে দু’দিনের জন্য বাবার বাড়ি গেছে। পুরো বাসায় আমি একা।

অফিস থেকে ফিরে সামান্য লেখালেখির চেষ্টা করা আর টিভি দেখা ছাড়া করার তেমন কিছু নেই। আজ স্পিলবার্গের একটা ছবি দেখে শুতে এমনিতেই দেরি করে ফেলেছি। মনে হয় আধা ঘণ্টাও ঘুমাতে পারিনি, এর মধ্যে খুট খুট শব্দ করে যন্ত্রণা শুরু হয়েছে।

একবার মনে হলো ইঁদুর রান্নাঘরে শব্দ করছে। ঘুমের মধ্যেই হুস হুস শব্দ করে ইঁদুর তাড়াতে চেষ্টা করলাম।

হুস, হুস করলে কিছু সময়ের জন্য থেমে যাচ্ছে খুট খুট শব্দ। চোখ লেগে আসতেই আবার সেই শব্দ। কখন যে হুস হুস করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম খেয়াল নেই।

হঠাৎ অনুভব করলাম, কে যেন আমার বা-পায়ের বুড়ো আঙুল ধরে আলতো করে টানছে। চোখ থেকে ঘুম পুরোপুরি সরে গেছে। আমি চোখ হালকা করে তাকালাম — পুরো ঘর অন্ধকার। বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাতে ভুলে গেছি? এখন দেখছি বাতি নিবানো। যতদূর মনে আছে — টিভি বন্ধ করে শঙ্করের একটা বই পড়ছিলাম। ঘরের বাতি জ্বলছিল। তাহলে বাতিটা নেভাল কে?

পায়ের আঙুলে আবার কেউ স্পর্শ করল। আমি ভয় পেতে শুরু করলাম, কারণ চোখ খুলে কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। ইঁদুরের চিন্তাটা বাদ দিলাম। আমি মশারি টানিয়ে শুয়েছি। শোওয়ার আগে বেশ ভালোভাবে মশারি গুজে শুয়েছি। ভেতরে ইঁদুর থাকলে আগেই দেখতে পেতাম।

হঠাৎ ভূতের কথা মনে হলো! ভূত নয় তো? ভূতের কথা মনে হতেই ভয় বেড়ে গেল। ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। নড়তে পারছি না। মনে হলো নড়াচড়া করলে কেউ আমাকে মেরে ফেলবে। আবার ভয় পাচ্ছি দেখে নিজের ওপরই রাগ লাগছে। কেউ শুনলে হাসবে। ছেলেটার কথা মনে হলো — ও-ই বোধহয় আমার চেয়ে বেশি সাহসী।

বা-পা আমি একটু নাড়ালাম — এমনভাবে যেন ঘুমের মধ্যে নাড়াচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে স্পর্শটা বন্ধ হয়ে গেল। মনে হলো কেউ পায়ের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিল।

এবার ভাবলাম — ইঁদুর হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। ডাইনিং রুম থেকে ভেসে আসা ঘড়ির টিকটিক শব্দ শুনতে পাচ্ছি। এ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। চারদিকে শুনশান নীরবতা, একটু আগে যে খুট খুট শব্দ হচ্ছিল, সেটাও এখন আর নেই।

হঠাৎ মনে হলো, কেউ আমার শরীরে থাকা চাদরটা ধরে টানছে। আমি মনে মনে দোয়া-দরুদ পড়তে লাগলাম। নিজের ঘরে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবো, কল্পনাও করিনি। ভয়ে হাত-পা জমে যাচ্ছে। শরীর থেকে চাদরটা একটু একটু করে নিচের দিকে নামছে। যে করছে কাজটা, বোঝা যাচ্ছে সে খুব ধীরে-সুস্থেই করছে।

কি করব বুঝতে পারছি না। বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখাই আসল ব্যাপার। শুধু বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখার কারণে ৭০% লোক মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যায় — কোথায় যেন পড়েছিলাম। আমি মাথা ঠাণ্ডা রাখতে চেষ্টা করলাম।

একবার ভাবলাম জোরে চিৎকার করে উঠি — তাতে চাদর টেনে যে আমাকে ভয় দেখাতে যাচ্ছে, সে উল্টো ভয় পেয়ে যাবে।

তারপর মনে হলো, চোর নয় তো? বেশ কিছুদিন যাবত মহল্লায় চোরের আনাগোনা বেড়ে গেছে। সেদিন নাকি জানালা দিয়ে বাড়িওয়ালির ব্যাগ থেকে মোবাইল-টাকা নিয়ে গেছে চোর। কিন্তু আমার বিছানা তো জানালা থেকে অনেক দূরে। জানালাও বন্ধ। তবে কি চোর আগেই ঘরের ভেতরে ঢুকে ছিল? এখন আফসোস হচ্ছে কেন শোওয়ার আগে চেক করিনি।

অনেকক্ষণ অন্ধকারে থাকার ফলে অন্ধকারটা চোখে সয়ে এসেছে। পায়ের দিকে কিছু একটা নড়ে উঠল। আবছা আলোয় একটা অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আমি চোখ কুচকে ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলাম। মনে হলো কেউ একজন মেঝেতে হাঁটু গেড়ে খাটের উপর কুনি রেখে বসে আছে। ভয়ে আমার অন্তর কেঁপে উঠল। শুয়ে থেকেও স্পষ্ট নারী অবয়ব দেখতে পাচ্ছি — ঘাড়ের উপরে উড়ন্ত চুল পর্যন্ত।

আমার শরীর ঘেমে উঠল। কখন যে পুরোপুরি চোখ খুলে তাকিয়ে আছি, বলতে পারব না।

হঠাৎই অবয়বটা আমার পায়ের উপর থেকে হাত সরিয়ে নিয়ে আমার মুখের দিকে তাকাল। আমার মনে হলো — সে বুঝে গেছে আমি তাকিয়ে আছি। আমি চোখ বন্ধ করার সাহস পেলাম না। দুজন চোখাচোখি তাকিয়ে থাকলাম।

হঠাৎ ঘরের ভেতর প্রচণ্ড বেগে বাতাস বইতে শুরু করল — মনে হলো সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যাবে। আমি দু’হাত দিয়ে খাটের কিনারা আঁকড়ে ধরলাম। কিছুক্ষণ পর বাতাস হঠাৎই থেমে গেল।

অবয়বটা একসময় উঠে দাঁড়াল। আমি কিছু বলতে চাইলাম, কিন্তু পারলাম না — মনে হলো গলার ভেতরের সব রস কেউ চেপে বের করে নিয়েছে। তবুও মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিজেকে বোঝালাম — ভয় পেলে চলবে না, ভয় পেলে চলবে না। বাঁচতে হলে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। সঙ্গে সঙ্গেই একটা হিন্দি ছবির ডায়লগ মনে হলো — জো ডর গয়া, ও মর গয়া!

আমি শরীরের সব শক্তি একত্র করার চেষ্টা করলাম। তখনই আমার মুখ থেকে প্রশ্নটা বেরিয়ে গেল — কে, কে ওখানে? নিজের গলার স্বর চিনতে পারলাম না। মনে হলো আমার গলায় অন্য কেউ কথা বলছে। আমি আবারও একই প্রশ্ন করলাম — কে, কে ওখানে?

এবার মৃদু একটা হাসির শব্দ ভেসে এলো।

আমি আবার বললাম — কে?

— আমি, খুব আস্তে উত্তর এলো — খেয়াল না করলে শোনা যেত না।

— আমি কে? — ভয়ে আমার হাত-পা অসাড় হয়ে আছে।

— আমি কেউ না — বলে অবয়বটা হেসে উঠল। হাসির শব্দ যেন কানে বাজছে। আমি মুগ্ধ হলাম। তিথির ভাষায় — খুব তাড়াতাড়ি মুগ্ধ হয় “গাধা মানুষ”রা। নিজেকে গাধা মানুষই মনে হলো।

— আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি। দয়া করে বলুন, আপনি কে? — নিজেকে কেমন শিশু-শিশু লাগল।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!