পরী শুনছিস? আমার লন্ডভন্ড পাগলামি!– অতনু ব্যানার্জী

সেদিন অর্ণব দুটো কাঁচা খিস্তি মেরে বললো তুই ইমিডিয়েট কামু পড়, ইস্পেশালি দ্য ষ্ট্রেঞ্জার! বড্ড আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছিস!

– পড়েছি তো!

– তাও এতো কেন সিরিয়াসলি নিচ্ছিস জীবনটা!

– ওটা আমার রোগ। টাইফয়েডের মতো ভুগি আমি… অফিসে, আড্ডায়, প্রেমে! প্রোজেক্ট ম্যানেজারকে ঠারেঠোরে শুনিয়ে দিই… এই যে তোমার কেলানো দাঁতের ছুরির ফলা এর ধার আমি জানি! পেছন ফিরলেই ড্রাকুলা হয়ে কামড়াবে আমার পিঠ। এই যে এতো নলেনগুড়ের গন্ধ, কথায় কথায় সব আমি জানি। আমার ঘাড়ে বন্দুকের নল ক্ষমতার উৎস আর তোমাদের শোবার ঘরে ট্রিংকাস-এর উল্লাস!

অর্ণব বললো, এতো রেগে যাচ্ছিস কেন?

ওটা রেগে যাই না ওটা রোগে যাই! প্রেমিকার নগ্ন শরীরের নীল হ্রদে হিমালয় হয়ে বসে যখন দেখি ওর চোখের কোনে “বিমলার’ বাইরে উড়ে যাবার ছটফটানি… সত্যজিতের “কাট’ শোনার আগেই আমি ঘোড়া চালাই, মার্সিডিজ বেঞ্জের বেগে রাগে… অথবা রোগে! এটা ভেবোনা এটা কোনো রোজগেরে নৈমিত্তিকতা। এটা স্বপ্নও বা সত্যিও।

সেদিন নীল পুকুরের ধারে, পরীর ডানায় ঘুমোতে ইচ্ছে করছিলো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখতেও। জেগে থেকে পরীকে দেখতে পাচ্ছিলাম… নীল পুকুরের সব জলে ভেসে যাচ্ছিলো আমার দু চোখ। পরী ওর ডানা গুটিয়ে আমার চোখে ঘুম পাড়িয়ে দিলো। আমি উড়ে গেলাম…। এটাও রোগ! অর্ণব বুঝতে পারছিস তো রাগী নই!

এই সেদিন লাল গোধূলীর রঙ যখন মিশে যাচ্ছে জ্বলা সিগারেটের রঙে, ও বললো আমায় ছেড়ে যাবে না তো! মনে হলো, আমায় হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে পানাপুকুরে… প্যঁ¡ক প্যঁ¡ক করে অ্যালজেব্রার পুরুষেরা যেখানে হিসেব কষে দিনমান…। কোথায় ছেড়ে যাবো!কেউ কি ছেড়ে যেতে পারে ভালোবাসলে! আর যাই ভাবো…পানাপুকুরের অতিথি ভেবো না…আমায়! ও আমার কথায় জ্যামিতির উপপাদ্য দেখলো… আর আবার ডুব দিলো নির্জন ক্যাসলের ফ্যান্টাসিতে!

পরীকে আমি ছেড়ে আসিনি তো! নিয়ে এসেছি বুকে করে… ও জানতেই পারেনি… বোধহয়। রেখে দেবো কাঠের আলমারির মাথায় রাখা নারকেলের মালায়…। চুপটি করে থাক আমার প্রান ভোমরা… আমার মনের সাথে। কান্না পেলে তেপায়া টেবিলে ভরদিয়ে উঠে অপু পেড়ে দেবে… সেই নারকেলের মালা… না ডুবকি নিয়ে ফেলতে দেবো না… গ্রাম ছেড়ে গেলেও। আস্তে করে ঢুকিয়ে নেবো বুকের খাঁচায়… কেউ টেরই পাবে না!

সেদিন বাজারে গেছিলাম… চোখ ধাঁধাতে… আর মন ভোলাতে! কত রকমের হাঁক ডাকের মুখোমুখি। আমার মন তো ইন্দ্রিয়ের হাত চেপে ছুট্টে পালাতে পারলে বাঁচে… এদিকে চেতনার তখন অ্যাজমার টান। আমি তখন বালেশ্বরের মাইচা! যাই কোন দিকে। দেখলাম… ইউ এস পিজ্জার পাশে পরী হাসছে নীল পোশাকে। বললাম…পরী আমার কষ্ট হচ্ছে। পরী আমার হাত ছুঁলো… হাতে পড়ে রইলো ধূসর ইনহেলার… বেঁচে গেলাম আমি…একটুর জন্য!

সেদিন সারাদিন একলা ঘর। একলা আমি… একলা আমার টুথ পেষ্ট। একলা আমার দৈনন্দিন কুলকুচি। মনের গলি দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ড্যানিউবের ধারে…। একলা নদীর পারে একলা আমি। ছলাত ছলাত ঢেউ। সাদা সাদা… কালো চোখের পাখি। ওই দূরে অর্ধনগ্ন নারীর সৌন্দর্য্য…ঘর্মাক্ত। আমার কানে… লেগে থাকা হিন্দী গানের ভাঁজ। অ্যাসোসিয়েশন অফ মেমোরি…তবে সেই পথে হাঁটছি কী করে… এই একলা ঘরে নরম বিছনায় সেই এক বছর আগের দিনগুলোতে ডুবে যেতে যেতে। গানটা শুনলেই আমার সেই পথটা মনে পড়ে। সাতসকালের বরফকুচির ছেঁটা… সেই উত্তুরে হাওয়া…আর গরম গরম স্পঞ্জ দিয়ে মোজার্টের সিম্ফনী মাখিয়ে টানা… পঁচিশে ডিসেম্বরের রাতে…ষ্টেফানপ্লাটজ-এ।

রক্ত আমার জীবনের আসে মৃত্যুর অতিথি হয়ে…মাঝে মাঝেই। সে ধানবাদের রাস্তায় রক্তাক্ত আমার সাদা জামায় সার্ফ এক্সেলের আপ্রান চেষ্টাতেই হোক…বা হায়দ্রাবাদের মাঝ রাস্তায়… ভটভটির কালো ধোঁয়া রক্তে লতপত হয়ে আঁশটে গন্ধ ছড়ানোতেই হোক! পরী বললো রক্ত ওরও ছোটবেলাকার সাথী। ছোটবেলাকে বড় করেছে নাকি রক্ত!

সাড়ে বিরানব্বই বছরের ঠাম্মা শেষকয়েক মাসে একেবারে যৌবনে চলে গেছিলেন। দেখেছি… বেডসোরে হাত ডোবানো আমার রাবীন্দ্রিক মা হয়ে গেছে ঠাম্মার প্রাক-স্বাধীনতার জন্মদাত্রী! আমার নামটা খুঁজে বেড়ান সাঁতার কাটতে কাটতে…। খাট থেকে নেমে পুকুর ঘাটে বাসন মাজতে যান!! যেমন যেতেন পঞ্চাশ ষাট বছর আগে! যেদিন ঠাম্মার গাল বেয়ে সাদা ফেনার ঢেউ… যেদিন বাড়ীতে কান্না আর কীর্তনের যুগলবন্দী…আমি বুকের মধ্যে পরীকে খুঁজছিলাম …পাগলের মতো।

পরী আমিও একদিন মরে যাবো! মরার আগে উড়বোনা তোর সাথে? পরী উড়েছিলো আমাকে নিয়ে…উড়তে উড়তে এলো এই সাদা কালো অক্ষরে ভরা শহরটার উত্তুরে হাওয়ায় যারা বেঁচে থাকে…সেই সাঁঝবাতির চড়া মেক আপের গলিতে। পরী ছুঁড়ে দিয়েছিলো প্রশ্নের নামাবলি আমায়… তুমি কি আহম্মক… কেঁদে মরো…এর চেয়েও ঢের ভালো নেই কো তুমি! ভক করে নাকে এসেছিলো ধেনোর পচা গন্ধ। গন্ধটা আমায় উড়িয়ে নিয়ে গেলো বালেশ্বরের গেঁয়ো হাটে…। ধেনো খেয়ে মুখ পুঁছে মাধব মল্লিক, মাধ্যমিক… তেল ভরে পেট্রোলপাম্পে… মাইনে সাতশো টাকা…মাসে! ও ভোলে ধেনোর গন্ধে…আমি ভুলি… বিজ্ঞাপনের আঁশটে গন্ধে! সবাই ভুলছি …দিনকে দিন। ভুলতে চাইছি জ্যান্ত মেটামরফোসিস…। কি চাইছি…শুধু হাতড়ানো… সিনেমা হলের পেছন সিটের মতো। কি পাচ্ছি!… ধোঁয়াটে উত্তর জীবনে… টিভির সাধুদের জ্ঞানের মতো। সবাই ধেনো খাওয়াতে চাইছে পরী…। পরী হেসে বললো খাও কেন? খাই না রে… গিলি…। আর কোনো নৌকা নেই তো…এ গিলোটিনে ঢুকে পড়েছি তো। খাঁড়াটা নেমে আসছে একটু একটু করে…। পরী আমার সামনে থেকে যাস না রে। ওরা আমার মুন্ডহীন দেহটাকে রিসাইকেল বিন থেকে রেষ্টোর করে বাজারে ছাড়বে…। ওটাই ওদের চাই… মুন্ডহীন একটা “দেহ’। আর আমার প্রশ্নে ভরা মুন্ডুটা নিয়ে ওরা ৭০ দশকে পাঠাবে… ময়দানে ফুটবল খেলার জন্য… কোনো কাকভোরে। ওরা প্রশ্ন চায়না পরী…ওরা আনুগত্য চায়। ভিয়েতনামের ধানক্ষেত থেকে বোকা চাষা যখন প্রশ্ন ছুঁড়লো বোমারু পাখীর চোখে… ওরা আগ্নেয়গিরি ঢেলে দিলো ইরাকের খনিতে। যখন জেডকিষ্টের রেডিও কানে আসে মাঝরাত্তিরে, খুন হয়ে যায় বিহারের আলপথে,… প্রশ্নেরা… চাঁদের কাস্তেটা ধারালো করতে করতে… মার্সিকিলিং এর নাম দিয়ে। বুর্জোয়া, প্রলেতারিয়েত আর কমরেডরা কাড়াকাড়ি করছে পরী… মুখোশগুলো নিয়ে। বুড়ো গর্ভাচব… পাহাড়ের বুকে সবুজের ওম নিতে নিতে যখন দেখেন ফায়ারপ্লেসের লাল আগুনটা নিভু নিভু… আলমারি থেকে টান মেরে গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রৈকার ফাইলগুলো ফেলে দেন ফায়ারপ্লেসের অন্ধকারে… দপ করে জ্বলে ওঠে আগুন… আরেকবার, ঠিক যেমন কারা যেন বলে ওঠে… জার্মানির কোনো এঁদো গলির স্যঁ¡তস্যাতে ঘরে এখনো ফুয়েরার আসেন আগুন জ্বালতে… আরেকটা ধ্বংসের মশাল হাতে নিয়ে!

আজ যখন তোর পিঠে আমার আদরের লাল লাল ছোঁয়া, তোর কালো পাতায় মোড়া চোখ দুটো বোজা… কোনো অলীক স্বপ্নের সুখে… তোর সারা দেহে সাঁতার কাটতে কাটতে… বাঁচতে ইচ্ছে করে আরেকবার। সত্যি করে… ভুলে যেতে ইচ্ছে করে বাঁচতে গেলে চে এর মতো মহান হয়ে যাবো… যদিও ইতিহাস বলে মহান শুধু মৃত্যুর পরিণতি…। ভুলে যেতে ইচ্ছে করে কবির লড়াইয়ে নানুরের রক্ত লাগিয়ে সারা রাজ্য এখন জঙ্গল আমার। প্রশ্নগুলো লাশ হয়ে পড়ে থাকে… মেদিনীপুরে… আর উত্তর দেয় মিডিওকার কোনো মুখোশ… যেটা নন্দনের ফুটপাথে আজকাল সস্তায় পাওয়া যায়… টাকায় দশটা! ডিকনষ্ট্রাকশন আজ কলেজষ্ট্রিটে জেরক্স বই এর পাতা… এখন তো রি-কনষ্ট্রাকশন এর যুগ! পরী আমাকে একটা চশমা কিনে দিবি… যে চশমায় শুধু তোকে দেখা যায়… না দিবি তো অন্ধ করে দে আমায়।শক্তিবাবুর কথাটা মনে আছেতো…ভালোবাসা পেলে লন্ডভন্ড করে চলে যাবো একদিন! আমাকে একটু ভালোবাসবি পরী? আমি কি পারবো… এই জমকালো মেকওভার ছেড়ে সবকিছু লন্ডভন্ড করে বেরিয়ে পড়তে… নীল আকাশে… কী রে… বলনা পরী?

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!