হাসান ও পবিত্র হাসির গল্প

একশ টাকার ভাংতি নাই।কথাটি বলে শেষ করতে না করতেই লোকটি চোখ গরম করে বলল,একশ টাকার ভাংতি দিতে না পারলে,দোকান দিয়ে রাখছ কেন?
লোকটির চেহারায় ভদ্রতার ছাপ সুস্পষ্ট।সুন্দর শার্ট-প্যান্ট পড়ে আছে,উচ্চারণ ভালো,শুধু ব্যবহার খারাপ।আমি চোখে মাসুম বাচ্চাদের মতো হাসি ফুটিয়ে তুললাম।ভাইজান,মাত্র তিন টাকা বিল হয়ছে,এই টাকার জন্য ভাংতি কেমনে দিই?এক কাজ করেন,কার্ড নিয়া যান।
ওই ব্যাটা,এত বেশি বুঝস কেন?ভাংতি দে।
লোকটা বেশী বেয়াদব,খবিশ টাইপের।আমি তাই তর্ক না করে ভাংতি দিয়ে দিলাম।
আমার পড়াশোনা বেশীদূর না;মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত আর আমার দৌড় ছিল ইন্টার পর্যন্ত।শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে পারি,বাইরের কেউ কথা শুনে বুঝবে না,আমার বাড়ী ময়মসিংহ।অথচ লোকটাকে দেখেশুনে শিক্ষিত মনে হল-তবু ব্যবহারের এই দশা কেন?আমার জ্ঞান বুদ্ধি কম থাকতে পারে,আমার বিবেকে ঘাটতি থাকার কথা না।
সবাই একরকম হয় না।যেমন আমাদের আকুয়া এলাকার সবচেয়ে পরিচিত মুখ ফাহিমা।মানুষ দেখলে যাকে সুন্দরী বলে,সে ওমন না;তবে আর সবার মত তার সুন্দর দু’টো চোখ আছে,কাঁধ পর্যন্ত নামানো চুল আছে,মাতাল করা হাসি সঙ্গে হৃদয় তোলপাড় করা কন্ঠ আছে-শুধু গায়ের রঙ একটু কালো।গায়ের রঙ সুন্দরের প্রতিযোগীতায় তাকে পিছিয়ে দিয়েছে;তবে আমার কাছে ও তুলনাহীনা!একসময় আমাদের ভেতর প্রেম ছিল।এখন আর নেই।দোকানদারের সঙ্গে কি আর ওসব চলে?আবেগ দিয়ে সংসার চলে না-আমার মত ইন্টার পাস গাধাও জানে।আমি তাই এই বিচ্ছেদকে স্বাভাবিক ভাবেই নিয়েছি।
আমার দোকান “হাসান ফোন স্টোর”এর মোবাইল দিয়ে প্রায় নতুন প্রেমিককে ফোন করে ফাহিমা।অচেনা সেই মানুষের সঙ্গে যখন কথা বলে,বুকের মাঝে অবশ্য চিনচিন ব্যথা অনাহূত আগন্তুকের ন্যায় হাজির হয়।হার্টের অসুখ না মনের অসুখ ঠিক বুঝতে পারি না।যদিও ওর হাসির জন্য দূরে সরে এসেছি,এখন ভালোই আছে-তাই আমারও ভালো থাকা উচিত,কিন্তু পারি না সবসময়।আমি হাসান,কোন ফেরেশতা না।
অনেক রাত হয়েছে।এত রাতে কাস্টমার আসবে বলে মনে হয় না।ফাহিমার কোন খোঁজ নেই দু’দিন হয়ে গেল।মন খারাপের সঙ্গে কিছুটা টেনশন হচ্ছে।কোন বিপদ হল কী?ফাহিমার কাছে মোবাইল নেই।থাকলেও মনে হয় না ফোন দিতাম।পাখি উড়ে গেলে তার পালক পড়ে থাকে।পালকের কোন মূল্য নেই আর পাখি উড়েই চলে গেল-আমি সেই পাখির খোঁজ নিয়েই বা কী করব?
দোকান বন্ধ করতে গিয়ে চোখে পড়ল আজহারকে।সে আমার স্কুলের বন্ধু।রেজাল্ট খারাপ করত সবসময়।বাবার টাকাপয়সা ছিল,জীবনে তাই সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে।আর আমি?তীর হারা এই ঢেউ এর সাগর পাড়ি দিব গানটার মত তরী বেয়ে যাচ্ছি একা হাতে।
ওই ব্যাটা,কই যাস?
আজহারের মুখের অবস্থা দেখে মনে হল,সে চোর আর আমি পুলিশ।আহা,সবাই যদি এমন ভাবত,তাহলে আর মাসে মাসে চাঁদা দেয়া লাগত না,উল্টো বাড়তি ইনকাম হত।
ধরা খাওয়া কয়েদীর মত হাসি দিয়ে বলল,বাসায় যাই।দোস্ত পরে আসব তোর দোকানে।
গত এক সপ্তাহে তিনবার কথাটা বলল,আজহার।শুধু শুধু মিথ্যে বলার কী দরকার?আমি রাগ করলে কী তাকে গৃহহীন করা হবে?অনেকদিন ধরে ভাবছি জিজ্ঞেস করব।আজ তাই করেই বসলাম,দোস্ত আমাকে এত ভয় পাস কেন?
মানে?আমি তোকে ভয় পাব কেন?
আমি তালা লাগিয়ে ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,ঠিক করে বল ।আজহার চারপাশে তাকিয়ে রাতের শুন্যতা দেখে আরও ভয় পেয়ে,একটু সরে দাড়িয়ে বলল-ধুর দোস্ত,কি যে বলিস!লক্ষকরলাম,দোস্ত শব্দটা আগের মত প্রানহীন শোনাল না।বেচারাকে আর কষ্ট দিলাম না।ইশারা দিয়ে চলে যেতে বললাম।
গাধাটা ভয় পাবে কেন?আমি ভাগ্যের কাছে পরাজিত হওয়া সৈনিক,আসলে আমাকে সৈনিক বললেও ভুল হবে-আমি এমন একজন যে কখনো সৈনিক হবার ট্রেনিং না নিয়ে যুদ্ধের ময়দানে নেমে পড়েছিলাম আর এখন লুকিয়ে লুকিয়ে জীবনের সঙ্গে যুদ্ধ করছি।কলেজে পড়ার সময় বাবা মারা গেল।বড় বোন আছে,এখনও বিয়ে হয়নি।ইদানীং মা’র শরীর ভালো যাচ্ছে না।টাকা পয়সা রোজগারের সকল দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি।মাঝে মাঝে মনে হয়,যৌবনেই বৃদ্ধ হয়ে গেছি-বাইশ বছরের খোলসের ভেতর সত্তর বছরের বৃদ্ধের বসবাস।
বাসায় গিয়ে দরজা ধাক্কাতে হলো না,তার আগেই মা দরজা খুলে দিল।জানি না,মা কিভাবে টের পান,আমি আসছি।শব্দ করে হাটার অভ্যাস নেই,কোন জাদুবলে সেই শব্দই মা’র কাছে পৌছে যায়,কে জানে!
হাতমুখ ধুয়ে টেবিলে এসে দেখি মা বসে আছে।আয়োজন খুব সামান্য-ভাত,ডাল,সব্জি।মা’র সামনে বসে খেলে এই খাওয়াকে অমৃত মনে হয়।এই অনুভূতি গুলো সমাজের তথাকথিত ভদ্র শ্রেণিতে কতটুকু দেখা যায় আমার জানা নেই,শুধু জানি অর্থ দিয়ে সব হয় না।কিন্তু সেই অর্থের পেছনে ছুটতে হয়,অনুভূতির খেয়াল রাখা হয় না।
হাসান,আর কত?এবার একটা বিয়ে কর।ফাহিমার বাড়িতে প্রস্তাব পাঠাই।
প্রতিদিন খেতে বসলে এই একটি কথা ছাড়া যেন আর কোন কথা নেই।আজ মনে হলো রাজি হয়ে যাই।কিন্তু ফাহিমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব!আমি শব্দ করে হেসে উঠলাম।
বোকার মত হাসিস কেন?কথাটা বলেই,মা চুপ হয়ে গেলেন।আপার বিয়ের প্রসঙ্গ উঠলেই মা চুপ হয়ে যান।কারণ ধরতে পারি না।মেয়েকে হারানোর ভয়ে?
সুমনা বিয়ে করবে না,তুই করবি না।আমি যাব কই?
কেউ বিয়ে না করলেই ভালো।আর বিয়ে যে করব,টাকা কে দিবে?এ কথা বলার পর মা’র চোখের দৃষ্টি দেখে,বুকের ভেতর পর্যন্ত কেঁপে উঠল।শুন্য দৃষ্টি-যেন জীবনে আর চাওয়ার কিছু নেই।আমি জানি আমাকে নিয়ে বাবা-মা’র অনেক স্বপ্ন ছিলো।সেই স্বপ্নের কোনভাগেই ছিল না,ছেলে দোকানদারি করবে-হয়ত স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে গেলে ডাক্তার দোকানদার হয়ে যায়;তবু বাবা মা সেসব চিন্তা নিশ্চয় কখনো করেননি।আর এখন চোখের সামনে যখন টাকা পয়সার টানাটানিতে প্রিয় সন্তানকেই যখন হাল ধরতে হয়,তখন দৃষ্টি এমন শুন্য হয়ে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
তাড়াতাড়ি খেয়ে উঠে পড়লাম।মা’র সামনে এভাবে টাকা-পয়সার কথা তোলা ঠিক হয়নি।বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে আমাদের সংসারে ভালো কিছু ঘটেনি।জীবন ব্যস্ততার আড়ালে সব কিছু ঢেকে থাকে।কদাচিৎ,কষ্টগুলো যখন সামনে চলে আসে-হাজার চেষ্টা করেও এড়ানো যায় না,তখন আমরা নিজেরাই নিজেদের সাথে লুকোচুরি খেলি।ছোটবেলায় আনন্দ নিয়ে এ খেলায় দিন থেকে রাত পার হয়ে যেত,এখন অল্পতেই নাভিশ্বাস উঠে যায়।এমন সময়ে একা একা কেঁদে শৈশবের লুকোচুরি খেলার হারানো স্বাদ নিতে ইচ্ছে করে।আর আমি এমনি এক গাধা যে কাঁদতেও ভুলে গেছে!
আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে।আর আধ ঘন্টা বৃষ্টি হলে নর্দমার কালো পানি দোকানের ভেতর চলে আসবে।ভীত চোখে সেদিকে তাকিয়ে সিগারেট টানছি।এলাকার মুরুব্বিরা দেখলে মাইন্ড করতে পারে।কড়া ভাবে দু’একজন বলেও বসতে পারে-বাবা নাই দেখে ছেলেটা বখে গেছে।আজকাল পান থেকে চুন খসলেই এলাকায় হায় হায় রব ওঠে।আমাদের সংসার যখন চলে না,তখন কারও মাথাব্যথা নেই আর সিগারেটে দু’টো টান দিলেই সমাজের নৃত্য শুরু হয়ে যায়।এসব কথা মনে হতেই সিগারেটে টানটা আরও জোরে দিলাম।মেজাজ আরেকটি কারণে খারাপ।ছোট খালার মেয়ের বিয়ে।মা,আপাকে সহ গাজীপুর গেছেন।কী দরকার যাওয়ার,এটাই বুঝি না।কষ্টের সময় খবর নাই,এখন মানুষের আনন্দ দেখার জন্য যেতে হবে!যদি ক্ষমতা থাকত,সমাজের বারটা বাজায় দিতাম,এই ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ নেই।
দোকানের মোবাইল বেজে উঠল।পরিচিত মানুষজন কেউ ফোন করে না।হয়ত কোন কাস্টমারের ফোন আসে নয়ত রং নাম্বার।নাম্বার দেখে চেনা লাগলেও প্রথমে ঠিক চিনতে পারলাম না।।ধরার ঠিক আগ মুহূর্তে মনে পড়ল,আরে এই নাম্বারেই ফাহিমা ফোন করে।আমি ফোন ধরলাম।খুব ইচ্ছে সহকারে না,কৌতূহলের কাছে পরাজিত হয়ে ইয়েস বাটনে চাপ দিলাম।ফাহিমা এখন এই মানুষটার জন্য হাসে,সেই হাসি আমি দেখতে পাই-অন্ত্যত এজন্য আমি কৃতজ্ঞ মোবাইলের অপর প্রান্তে থাকা মানুষটির জন্য।
হ্যালো,হাসান ভাই বলছেন?
হাসান ভাই!তারমানে,ফাহিমা ছেলেটিকে আমার সম্পর্কে বলেছে।কী বলতে পারে?আমি এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললাম,জ্বী বলেন।আরও অনেক কিছু বলতে পারতাম।বলতে পারতাম,আরে আপনি আমার নাম জানেন?কিন্তু আমি নিজের মনের ভাব এক্ষেত্রে লুকিয়ে রাখাটাই শ্রেয়তর মনে করলাম।
অপর প্রান্ত থেকে উত্তর এল,আমি নীরব,আপনি আমাকে চিনবেন না।
ও তাহলে ছেলের নাম নীরব।আমরা ভালো আছি,আপনি ভালো আছি এডের নীরব নাকি আবার?নাহ,অন্য কেউ হবে,মডেল মানুষকে ফাহিমা কই পাবে?
আমি গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললাম,চিনি না।কথা বলব কেন?
এ ধরনের সরাসরি কথা বেচারা আশা করেনি।বলল-না মানে,আমি ফাহিমার ফ্রেন্ড।
আহা যেন ভাজা মাছ উল্টে খেতে জানে না।অথচ,প্রথমে জাল ফেলে মাছ ধরে নিজেই ভেজেছে,আর এখন বলছে মাছের নাম কী?আমাকে নাটক করার নেশায় পেয়ে বসল।ভেজা বেড়াল সেজে বসলাম,ফাহিমার ফ্রেন্ড আমার কাছে কী চান?ফাহিমাকেও আমি ঠিক চিনতে পারছি না।
ফাহিমাকে চিনতে পারছেন না?
বিনয়ের সঙ্গে বললাম,আপনার সাথে নাটক করে আমার কী লাভ?এক কথা বারবার কেন জিজ্ঞেস করছেন?
আসলেই চিনেন না?
আমার মন অজানা খুশিতে নাচতে থাকে।ছাগলটাকে ধাঁধায় ফেলা গেছে।আমি এখন রাগ দেখাতে শুরু করলাম।ওই মিয়া,আননোন নাম্বারে ফোন কইরা কন মিথ্যা কইতাছি!আমিতো মেয়ে না যে আমারে ডিস্টার্ব করবেন!উত্তেজিত হলে আমি এ ধরনের ভাষায় কথা বলি।এখন উত্তেজিত না হয়েই বলছি।নিজের অভিনয় প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে আত্নপ্রশংসায় যখন বুঁদ তখন ছেলেটা বলল,আপনি যদি হাসান হয়ে থাকেন,তাহলে অবশ্যই ফাহিমাকে চিনেন।ফাহিমা নিজের মোবাইল নিছে,তাই আপনার দোকানে আসে না।কিন্তু,ওর নাম্বার আমিও জানি না!এ জন্যই আপনার কাছে ফোন দিলাম।শুনেছিলাম,আপনি মানুষ ভালো।
শুনুন,বলতে গিয়েও বললাম না-শুধু শুধু নাটক করার জন্য আফসোস হচ্ছে।ওপাশে কিছুক্ষণ নীরবতার পর,লাইন কেটে যাওয়ার শব্দ পেলাম।ফাহিমা আমার প্রশংসা করেছে আবার তার মোবাইল কেনার খবর আমার মাঝে বিষাদ আর আনন্দের সাম্যবস্থার সৃষ্টি করল।
বৃষ্টি থামছে।বড় বড় ফোটাগুলো এখন কুয়াশার মত ঝরে পড়ছে।এ যাত্রা দোকান পরিষ্কার করার হাত থেকে বেঁচে গেলাম।মানুষের হাতে হাতে মোবাইল,ফোন করার কাস্টমার কমে গেছে।আগে কার্ড বিক্রী হত আর এখন লোড।এমন বৃষ্টি ভেজা দুপুরে প্রেমিকার সাথে কথা বলার মজাই আলাদা।অথচ,এলাকার সব গাধাগুলো কী ঘরে বসে ঝিমোচ্ছে নাকি?ঘন্টা পার হয়ে গেল,দোকানে আমি আর মাছি ছাড়া কেউ নেই।ফাহিমা কেবল সাময়িক উত্তেজনার তৈরী করেছিল।
এমন এক দিনে বাবার মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলাম।কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম কিনতে যাচ্ছিলাম।মেঘ ছিল,বৃষ্টি ছিল,রিকশা ছিল না।বাবা অফিসে চলে গিয়েছিলেন সকালে।পাশের বাসার কাজের ছেলে মজিদ দৌড়াতে দৌড়াতে এসে বলল,ভাই………….।ততক্ষণে বৃষ্টি থেমে গেছে,মেঘ চলে যাচ্ছে,দু’একটা রিকশা দেখা যাচ্ছে;যে বাবা সমস্ত স্বত্তায় মিশে ছিল,সেই মানুষটাকেই নিমিষে হারিয়ে ফেললাম!আমি কাঁদি না,শুধু বেঁচে থাকার শক্তি অর্জন করি।
আমি আবারও মজিদকে দৌড়ে আসতে দেখি।দৃষ্টি বিভ্রম নাকি বাস্তব বুঝতে কিছুটা দেরি হয়।কিছুক্ষণের ভেতর বুঝতে পারলাম,মজিদ সত্যিই আসছে।ওর কথাই ভাবছিলাম,আর ও এসে হাজির।আমিতো বাবার কথাও ভাবছিলাম,ভাবছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফর্ম তুলতে যাওয়ার কথা।কই বাবাকেতো দেখছি না!!আর মজিদ এসে হাজির!মনে হল,সে আজরাঈল এর রূপ ধরে আমার কাছে এসেছে!প্রথমে ভেবেছিলাম,দূর্ঘটনা।নাহ,তেমন কিছু হয়নি।আসলে মনে হয়,হলেই ভালো হত।
আমার আপা সুমনার অনেক স্বপ্ন ছিল,আমার মতোই।বাবা মারা যাওয়ার পর যখন আমাকে কাজে নেমে পড়তে হল,তখন সে স্বপ্নগুলো নিজ হাতে দাফন করে ফেলল।আমি নিজেকে অনেক শক্ত বলেই জানি।সুমনার ছিল তার বিপরীত,অল্পতেই ভেঙে পড়ত শুকনো ডালের মত।বাবার মৃত্যু ছিল বিশাল বিপর্যয়।বেঁচে থাকতে কখনো বুঝিনি।আর এখন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারি,নিঃশ্বাস নিলে বুঝতে পারি কিছু একটা নেই!আমি ভেঙে পড়েছিলাম।ঘুরে দাঁড়িয়েছি,আপা পারেনি!আজ আমার আবার ঘুরে দাঁড়ানোর পালা।মা’র চোখের দিকে তাকাতে পারছি না,আপার সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছি না।পুলিশ এসে দু’তিনবার জিজ্ঞেস করে গেছে,আপনারা কাউকে সন্দেহ করেন?আমি নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম।কী বলব?
আমার চুপচাপ আপাটা যে নিজের সাথেই ঝামেলাই যেত না,বাবার মৃত্যুর পর নিজেকে হারিয়ে রেখেছে ইচ্ছে করেই তার এত বড় শত্রু কে থাকতে পারে?মেডিকেলের স্টুডেন্টদের ভীড় দেখা যাচ্ছে।একজন ডাক্তার তাদের বলছিল,বার্ন এর কেস।২০পারসেন্ট বার্ন,ভিটিরোলেজের শিকার।আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম।কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।বুঝতে পারার কথাও না।শুধু অবাক হয়ে দেখছিলাম,একেকজন কি আগ্রহ নিয়ে দেখছে!কিছুক্ষণ পর ক্লাস শেষ হয়ে গেল।যাওয়ার সময় একটা মেয়েকে বলতে শুনলাম,ভিটিরোলেজ কি ভয়াবহ!মনে হল,এসিড ছুঁড়ে মারার ঘটনাকে ভিটিরোলেজ বলে।আমার ডাক দিয়ে বলতে ইচ্ছে হল,আপনি যতই ভয়াবহ মনে করেন,পুলিশ অপরাধীদের ধরে ফাঁসি দেখ-আমার বোনের মুখের হাসি কি আর ফিরে আসবে?যে হাসি হারিয়ে গেছে অনেকদিন হল,সেই হাসিকে আজ একেবারে কবর দেয়া হয়ে গেল।আমি কিছু না বলে,চুপচাপ তাদের চলে যাওয়া দেখি।
মা এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল,হাসান অরে এখন বিয়া কেমনে দিব?আমি এই অবস্থাতেও বেশ শব্দ করে হেসে ফেললাম।মা আমার দিকে পাথর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ছলে গেলেন।
আমি মা’র কথা শুনে হাসিনি,হেসেছি আমাদের ভাগ্যের উপর।নিম্ন মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ঘানি টানতে টানতে মা কতটা ক্লান্ত আমি বুঝতে পারি।হয়ত ভাবতেন,মেয়ের বিয়ে হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।আজ তাই এই নিষ্ঠুর অবস্থাতেও মা’র মাথায় বিয়ের চিন্তাটাই আগে এসেছে।আমার আপাটা শুয়ে আছে,চোখ বন্ধ।গালের ডানপাশটা পুড়ে গেছে,দেখা যাচ্ছে।কিন্তু হৃদয়ের কতটুকু পুড়েছে সেই খবর আমার পক্ষে জানা সম্ভব না।কোন ডাক্তারকে ডেকে এনে জিজ্ঞেস করব?
৩।।
আমি এখন মাঝে মাঝে একা একা হেঁটে বেড়াই।বাড়ি ফিরতে ফিরতে কখনো কখনো রাত হয়ে যায়,গভীর রাত।এখন আর আমি পৌছাবার আগে দরজা খুলে যায় না।আর সবার মতোই দরজায় নক করতে হয়।তারপর এসে মা খুলে দেয়।খেতে বসলে,একাই খাই।মা আমাকে বলে না,এবার একটা বিয়ে কর।অথচ,আমার ভেতরে সেই কথাগুলো শোনার সুতীব্র ইচ্ছে প্রতিনিয়ত আত্মহত্যা করে যায়।মন যখন মরে যায়,মনের ডাক কি করে শুনবে মা?
আপা আমার সামনে খুব কম আসে।আসলেও মুখে কাপড় লাগানো থাকে,শুধু চোখ দু’টো দেখা যায়।যে মায়াময় হাসি দেখে আমার বেড়ে ওঠা,আমি তা আর কখনোই দেখব না।
একদিন রাতে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে যখন সার্কিট হাউজ মাঠের পাশে এসে দাঁড়িয়েছি,দেখি এক উগ্র নারী সাজগোজে উজ্জ্বল,আমার দিকে অনেক আগ্রহ ভরে তাকিয়ে আছে।আমি সেই দৃষ্টি এড়িয়ে খুব সহজেই বাড়ীর দিকে পা বাড়াই।হয়ত নারীটির আজ ইনকাম হয়নি,আমাকেই ভেবেছিল তার শেষ আশা!সে আশা খুব নির্মমভাবে পাড়িয়ে যেতে আমার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগেনি।আমি পড়াশোনা করতে পারিনি,কিন্তু বাবার পাঠশালায় অনেক কিছুই শিখেছি।শিখেছি জীবনের কোন অবস্থাতেই,কারও অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে নেই।আমার সাধারণ বাবা আমাকে সাধারণ হতে শিখিয়েছিলেন।সেই শিক্ষার ভেতর ছিল না,কিভাবে স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় বাইতে হয়।হয়ত শেখাতেন,সেই সুযোগ পেলেন না।
পাড়ার যে ছেলেটা আপার মুখে এসিড ছুঁড়ে মারল,প্রায়ই তাকে দোকানের সামনে দেখি,অন্য আরেক সুমনার পেছনে তার সদ্য কেনা মোটরবাইকে।আমি কাপুরুষের মতো হিসাব মেলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।দোকানের হিসাব সহজেই মিলে যায়,আমার জীবনের হিসাব বড় এলোমেলো।বাবা আমাকে জীবনের অংক মেলাবার কোন সুত্র শিখিয়ে যাননি।

দুঃখিত!