অনাদিবাবু কোনো সওদাগরী আপিসের কনিষ্ঠ কেরানী নন। মুদি দোকানও নেই তাঁর। জমি বাড়ির দালালিও করেন না।
স্কুলমাস্টারিও না। বয়েস এখনও পঞ্চাশ হয় নি।
একবিংশ শতাব্দীতে পঁয়ত্রিশেরও কম বয়সী একজন তথ্যপ্রযুক্তি পেশাদারের নাম অভিষেক, শুভব্রত,তন্ময় বা নিদেনপক্ষে অর্জুন না হয়ে অনাদি হতে পারে কিনা বা হওয়া উচিৎ কিনা এই নিয়ে যথেষ্ট
বিতর্কের অবকাশ থাকলেও সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। কেননা অনাদিবাবুর নাম সত্যিই অনাদি। এবং তিনি একজন
তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ। সল্টলেকে অফিস। আর পাঁচজনের মতই সেক্টর ফাইভে। বছরে কয়েকবার বিদেশ যান। তখন সাহেবরা
তাঁকে ডাকে “অ্যান্ডি’ বলে। আজকাল কাউকে বাবু বলেসম্বোধন করা প্রায় উঠে গেলেও ঠাকুর্দার দেওয়া এই সেকেলে ধরনের নামের
কারণে স্কুল জীবন থেকে সবাই তাঁকে অনাদিবাবু বলেই ডাকে। বিগত কয়েকবছর যাবৎ তাঁর সুপ্ত অভিলাষ লোকজন তাঁকে “অ্যান্ডি’
বলেই ডাকুক।
কিন্তু “আজ থেকে আমাকে সবাই অ্যান্ডি বলেই ডেকো’ এরকম তো আর বলা যায় না। তাই একটা সেকেলে নাম, লোন নিয়ে
কেনা ফ্ল্যাট,আবার লোন নিয়ে কেনা মারুতি ৮০০, একজন বৌ আর একটি চার বছরের বাচ্চা নিয়ে অনাদিবাবু গড়িয়ার কাছে সুখে শান্তিতে বসবাস করেন।
অনাদিবাবুর জীবনে কিছু কিছু ব্যাপার তাঁর সামাজিক অবস্থানের সঙ্গে খাপ খায় না। যেমন, তিনি যে পাড়ায় থাকেন তার নাম “বৈশাখি’ বা “সাউথ সিটি’ বা”বোসপুকুর’ না হয়ে হয়েছে “ভোলানাথের খাটাল’। নাম শুনলেই বোঝা যায় তিনি যেখানে থাকেন সেখানে গবাদি পশুর
আধিক্য। অনাদিবাবু রোজ অফিসের পিকআপ ভ্যানে চড়ে কাজে যান। শনিবার নিজের গাড়ি চড়ে সপরিবারে কোনো শপিং মল বা
মাল্টিপ্লেক্সে যান। কখনো কখনো আত্মীয়স্বজন, কদাচিৎ বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সামাজিকতা করতে যান। আর রবিবার রিকশা চড়ে পাড়ার
মোড়ের স্পেন্সার্সের দোকানে সাপ্তাহিক বাজার করতে যান। বাজার করা হয়েগেলে অনাদিবাবু, তাঁর গিন্নি আর মেয়ে একটা করে যথাক্রমে ভ্যানিলা, ভ্যানিলা আর স্ট্রবেরি আইস্ক্রিম খেয়ে হোম ডেলিভারির জন্য বাড়ির ঠিকানা লিখে দিয়ে রিকশায় করে বাড়ি ফেরেন।
এই রবিবারের বাজার করার ব্যাপারটা অনাদিবাবু কখনোই পছন্দ করে উঠতে পারেন নি। একে তো বিল মেটানোর জন্য লাইনে দাঁড়াতে
তাঁর ভালো লাগে না। তার ওপর রিকশা স্ট্যান্ডে পৌঁছনোর পথে ভোলানাথের খাটালের পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে তাঁর ভালো লাগে না।
সুদূর বিহার থেকে আসা ভোলানাথ পঞ্চাশটি গরু মোষ রেখে প্রয়াত হবার পর তার বিধবা পত্নী শুধু খাটালের হালই ধরে নি,
গরুদের সংখ্যা ষাট আর মোষেদের সংখ্যা তিরিশে নিয়ে গেছে, সর্বোপরি এইএলাকাকে “ভোলানাথের খাটাল’- এই নতুন নামে পরিচিত করতে পেরেছে।
কোনো কোনো রবিবার অনাদিবাবু ও তাঁর পরিবার বাড়ির সামনেই রিকশা পয়ে যান। একটু দরদস্তুর করে উঠেও পড়েন। যেদিন তা হয় না সেদিন তাঁরা ভোলানাথের খাটালের পাশ দিয়ে হেঁটে যান রিক্শা স্ট্যান্ডে। গোবর আর খড়ের মিশ্র গন্ধে অনাদিবাবুর দম আটকে আসে।
স্বাস্থ্যবান মোষেদের শৃঙ্গসঞ্চালনে ঘাবড়ে গিয়ে অনাদিগিন্নি অনাদিবাবুর জামার হাতা খিমচে ধরেন। শুধু তাঁদেরমেয়ে আমোদ পেয়ে বলতে থাকে “বাবা, ঐ দ্যাখো হাম্বা’। বলে, আর খিলখিলকরে হাসতে থাকে। মোট কথা, ঐ রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করা অনাদিবাবুর মোটেই পছন্দ নয়। বিশেষ করে গরুমোষদের “হাম্বা’ ডাকটা তো রীতিমত অসহ্য লাগে তাঁর।
এই পর্যন্ত পড়ার পর প্রশ্ন উঠতে পারে অনাদিবাবুর গল্পের সঙ্গে তাঁর পাড়ার গরু মোষেদের গল্পের সম্পর্ক কোথায়? ভোলানাথের খাটালেরই বা প্রাসঙ্গিকতা কী? কিন্তু না, সম্পর্ক, প্রাসঙ্গিকতা সবই আছে। সেকথায় আসছি।
ঘটনার সূত্রপাত সপ্তাহ দুয়েক আগে গত রবিবারের আগের রবিবার। স্ত্রীকন্যা সহ অনাদিবাবু চলেছেন রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে।
হঠাৎ করে খাটালের একটাহৃষ্টপুষ্ট মোষ “ভ্রোঁ…ভ্রোঁ’ করে ডেকে উঠতেই অনাদিগিন্নি অভ্যাসবশত: বরের জামার হাতা চেপে ধরলেন,
অনাদিবাবুর মেয়ে হাততালি দিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগল আর অনাদিবাবুর মনে হল মোষটা যেন তাঁর নাম ধরে ডাকল। তারপর
দ্বিতীয় মোষটার ডাকের সঙ্গে তিনি নিজের নামের উচ্চারণের রীতিমত সাদৃশ্য লক্ষ্য করলেন। কিন্তু গিন্নির সেরকম কোনো প্রতিক্রিয় না
হওয়াতে বুঝলেন ওটা নিতান্তই মনের ভুল। ফিক করে একটু হেসেও ফেললেন।
এবার একটা নাদুস নুদুস গরু যখন “অনাদি’ বলে ডাকল, অনাদিবাবুর মেজাজটা যাকে বলে খিঁচড়ে গেল। গরুমোষদের আজকাল এত
তেল হয়েছে যে একজন ভদ্রলোককে নাম ধরে ডাকে?
দ্বিতীয় কালো গরুটার ডাকের পর তিনি সুনিশ্চিত যে গরুমোষেরা তাঁকেই ডাকছে, তাঁর সঙ্গে কথা বলছে। কালো গরুটা শুধু তাঁকে
ডাকলই না, রগুড়ে গলায় বলল “পেছনে হাত দিয়ে দ্যাখ!’
রিকশায় উঠতে গিয়ে পাদানিতে পা রেখে অনাদিবাবুর হাড় হিম হয়ে গেল।
গরুমোষেদের ভাষা শুনতে এবং বুঝতে পারার পর তাঁর মনে যে অনুভূতির সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক ছিল সেটা হল বিস্ময়।
তার বদলে যেটা হল সেটা হচ্ছে বিরক্তি। তার মানে গরুমোষেদের কথা বুঝতে পারাটা অনাদিবাবুর কাছে তেমন
অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়।
জন্তুগুলো অনাদিবাবুকে নাম ধরে ডাকল সেটা তিনি একা নিজেই বুঝতে পারলেন। গিন্নির কোনো হেলদোল হল না। তার মানে জন্তুরা
মানুষের ভাষায় কথা বলছে না, বরং অনাদিবাবুই জন্তুদের ভাষা বুঝতে পারছেন।
অনাদিবাবুর স্ত্রী বললেন “কি হল? রিকশায় ওঠো!’
অনাদিবাবু কোমরের পেশীতে টান ধরার অজুহাত দিলেন ও তাঁর স্ত্রী রিকশায় যেতে যেতে বাবা রামদেব ও প্রাণায়াম সম্পর্কে এক
নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিলেন। কেনাকাটা করতেকরতে অনাদিবাবুর হাত নিজের পেছনে দিয়ে দেখার জন্য বারবার নিশপিশ করলেও তিনি
আত্মসংবরণ করলেন।বাড়ি ফিরে প্রথম যে কাজটা করলেন,সেটা হল বাথরুমে ঢুকে নিজের পেছনে হাত দিয়ে একটা লম্বা নমনীয়
জিনিসকেঅনুভব করা। ডগায় একটুখানি লোমশ ভাব রয়েছে।
লেজ?
সে রাতটায় অনাদিবাবুর ঘুম এল অনেক দেরীতে। ছোটবেলার একটা ঘটনা বারবার দু:স্বপ্ন ঘুরে ফিরে এল। বালক বয়সে তিনি থাকতেন এক মফ:স্বলশহরে। অনাদিবাবুর বাবা শখ করে বাড়িতে তরিতরকারীর বাগান করেছিলেন।মাঝে মাঝে গেট খোলা পেয়ে গরুছাগল ঢুকে আসত। ছোট অনাদিবাবু আর তাঁর ভাই লিকলিকে কঞ্চি দিয়ে পিটিয়ে তাদের তাড়াতেন। আজ অনাদিবাবু স্বপ্নদেখলেন একটা বাছুর
সেরকমই একটা কঞ্চি দিয়ে তাঁকে পেটাচ্ছে আর বলছে”খুব মজা,না? পেছনে হাত দিয়ে দেখ!’
পরদিন অনাদিবাবু একটু উচাটন মন নিয়ে অফিস গেলেন। অফিসের ব্যস্ততায় আগের দিনের কথা ভুলেও গেলেন।
ভুলেই থাকতেন যদি না…
যদি না অফিস থেকে ফিরে বাড়ি ঢোকার মুখে একটা নেড়ি কুকুর তাঁকেজিজ্ঞাসা করত “আজ দাঁত মেজেছিলি?’
বাড়ি ঢুকে অনাদিবাবু আয়নায় দেখলেন তাঁর দাঁতগুলো শুধু হলদেটেই নয়,ওপর আর নিচের পাটির এক জোড়া করে দাঁত একটু
বেশিরকমের লম্বা আর ছুঁচলো&#২৪০৪;
ছোটবেলায় একটা কুকুরছানার গায়ে গরম জল ঢেলে দিয়েছিলেন। প্রাণীটার গায়ের সব লোম ঝরে যায়। শেষ পর্যন্ত কুকুরছানাটা তাঁদের
বাড়ির বাইরের রাস্তায় মারা যায়। জমাদার একটা কোদালে করে ছোট মৃতদেহটা নিয়ে চলে যায়।
বিছনায় শুয়ে শুয়ে অনাদিবাবু সেদিন অনেক রাত পর্যন্ত দূর থেকে ভেসে আসা একটা কুকুরের কেঁউ কেঁউ ডাক শুনতে পাচ্ছিলেন।
পরবর্তী কয়েকদিন অনাদিবাবুর আচরণে এমন কিছু পরিবর্তন দেখা গিয়েছিলযা ঠিক অস্বাভাবিক না হলেও তাঁর চরিত্রের পক্ষে বেমানান। যেমন, যে অনাদিবাবু মাছ খেতে পছন্দ করেন না সেই তিনিই গিন্নির ভুক্তাবশেষ মাছের কাঁটাচেয়ে চেয়ে খেয়ে গিন্নিকে অবাক করে
দিলেন। খাবার পর ঢেঁকুরটা “হেউ’ করেনা তুলে “মিয়াঁও’ করে তুললেন। এইরকম সব।
পরের রবিবার। অনাদিবাবু সপরিবারে দোকান থেকে ফিরে বাড়ি ঢুকবেন। পাশের বাড়ি থেকে কিছু মাংসের হাড় আর পাঁউরুটির কালো
অংশ উড়ে এসে রাস্তায় পড়ল। অনাদিবাবু স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে গজগজ করে উঠতে গিয়েও উঠলেন না, কিরকম উদভ্রান্তভাবে তাকিয়ে
রইলেন।
কোথা থেকে চারটে রাস্তার নেড়ি কুকুর(এদের মধ্যে সেই কালোটাও ছিল,যে আগের দিন অনাদিবাবুকে দাঁত মাজা নিয়ে কটাক্ষ করেছিল)
কেঁউ কেঁউ করে ছুটে এল।
স্ত্রী এবং কন্যার বিস্ফারিত চোখের সামনে লুব্ধ ভঙ্গিতে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে গেলেন অনাদিবাবু।