আলেয়াপুর

কাউকেই না বলতে শেখেনি আলেয়া। তাই তার শরীর হয়েছে উদার সাম্যবাদ। তার শরীর চেনেন মসজিদের ইমাম সাহেব, রামখালি স্কুলের অংকের টিচার, পাড়ার মাতাল, উত্তর বাড়ির মাজুম শেখ কিংবা মাজুম শেখের যুবক পুত্র। রামখালির রাত মানেই আলেয়ার সন্ধানে ব্যস্ত কেউ। গ্রামের প্রতিটি পুকুরপাড়ের ঝোঁপঝাড়, মনুর মাঠ, শেখবাড়ির কলঘর, খোকনের দোকানের পেছন দিকটা, আরজ আলীর পুরাতন ভিটে যেখানে একটু নিরিবিলি সেখানেই ঘুমিয়েছে আলেয়া। হয়তো গতকাল সঙ্গী ছিল আলেক মুন্সি, আগামীকাল ল্যাংড়া কাদের।
রামখালি গ্রামের শেষ মাথায় মিয়ার বাজার। সেই বাজারে সন্ধ্যা নামলে মেয়েরা সস্তা প্রসাধনী মেখে ঘুরে বেড়ায়। চোখের ইশারায় কাছে ডাকে। হিন্দি সিনেমার গান গায়। আশপাশের চার গ্রামের ছেলেরা দলবেঁধে সেখানে আসে। নাসির বিড়ির লেজে আগুন ধরিয়ে মেয়েদের দিকে খবিশ দৃষ্টিতে তাকায়। তারপর বিশ-পঁচিশ টাকায় বনিবনা। ফেরার পথে যুবকরাও হিন্দি গান গায়। তারা সেই মুহূর্তে যেনো পৃথিবীর সুখী মানুষদের একজন।
রামখালির সবাই মিয়ার বাজারে সওদা সারে। কিন্তু সন্ধ্যার এই শরীর বাণিজ্যে তারা খুব একটা আসে না। গেলোবার পুলিশের বেশ্যা উচ্ছেদ অভিযানে চার গ্রামের আটাশ জন পুরুষকে ধরা হয়েছে। সেই আটাশ জনের তালিকায় রামখালির কেউ ছিল না। এই ধরপাকড়ের বিষয়টি নিয়ে বিরাট গল্প হয়েছে। জুম্মার খুতবায় ইমাম সাহেব রামখালির পুরুষদের প্রশংসা করে বলেছেন, এই গেরামে শুইয়া আছেন আল্লাহ্র পিয়ারা বান্দা বাবা দস্তগির আউলিয়া। আমাগো এহানে মহান আল্লাহ্র খাস রহমত উইড়্যা বেড়ায়। এই গেরামের কেউ আকাম-কুকামে যাইবো না। কিন্তুক আফসোস গেরামের নামটাই হিন্দুয়ানি। রামখালি না হইয়া এই গেরামের নাম হওন উচিত আছিল বাবা দস্তগির আউলিয়ার নামে। কি কন আপনেরা?
একজন যুবক পেছন দিকে মিনমিনে স্বরে বলে, তার চাইতে আলেয়াপুর নাম হইলে বেজায় মানাতো। যুবকের রসিকতা কারো কানে পৌঁছায় না।
আলেয়া জানেনা তার উদারতায় বাবা দস্তগিরের প্রশংসা হয়। সে আছে তার মতো। গ্রামের একটি দরিদ্র পরিবারের মেয়ে সে। বাবা কবেই মারা গেছেন। মায়ের বিয়ে হয়েছে অন্যত্র। বৃদ্ধা নানী আর আলেয়া দু’জনের সংসার। আলেয়া সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায়। ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করে না। খিদে লাগলে যে কারো বাড়ির দরজায় দাঁড়ায়। গেরস্ত বাড়ির মেয়েরা কেউ একসময় ছিল আলেয়ার খেলার সই, কেউ পাশের বাড়ির বাসিন্দা। আলেয়াকে তারা চেনে। চেনা ভিুককে তারা ফিরে যেতে দেয় না। আলেয়ার খাবারের বন্দোবস্ত হয়ে যায়। অবশ্য বাড়ির পুরুষরা এই সময় বেশ বিরক্ত হন।
সেই পুরুষরাই আবার রাতের বেলা আলেয়াকে খুঁজেন। পকেটে দুই টাকা দামের লাল ফিতে কিংবা সস্তায় কেনা কাঁচের চুরি। আদরের সময় তারা আলেয়ার কাছে কতকিছুর প্রতিশ্র“তি দিয়ে আসেন। বুঝলি রে আলেয়া তবে একখান শাড়ি কিন্যা দিমু, টকটকা লাল রঙ। তরে একদিন শহরে নিয়া যামু। সেইখানে গিয়া দুইজনে মিইল্যা সিনেমা দেখুম। আলেয়া শুধু বলে, আইচ্ছা। আদর শেষ হলেই প্রতিশ্র“তির কথামালা ফুরিয়ে যায়। আলেয়াও সেটি নিয়ে মাথা ঘামায় না। এমন একটা দয়ালু শরীর পেয়ে গ্রামের মানুষেরা বড় বেশি প্রতিশ্র“তি খেলাপ করে!
শরীর-বিদ্যে ভালোই শিখেছে আলেয়া। সে জানে কেন কিংবা কখন মাথা ঘুরে উঠে, কেন বমি বমি পায়। এমন হলে সে চলে যেতো মুখলেস ডাক্তারের কাছে। মুখলেস ডাক্তারও চেম্বারের দরজায় খিল দিয়ে তাকে নিয়ে খেলে। বাইরে বিরক্ত হয় অন্য রোগীরা। ডাক্তারের চেম্বারের সহকারী রহিম মিয়া তখন রোগীদের শান্ত করে, বুঝলেন না, জটিল কেইস। একটু সময় যাইবো।
তখন আলেয়ার স্তনের বোটায় হাত দিয়ে ডাক্তার চুকচুক স্বরে বলে, তোর এটাতো রীতিমতো ভূগোলক হইয়া গেছে। সারা পৃথিবী তোর বুকের ভেতর সেন্ধে গেছে নাকি?
আলেয়া জানতে চায়, ভূগোলক কিগো ডাক্তার?
ডাক্তার বলেন, ভূ অর্থ পৃথিবী আর গোল অর্থ গোলাকার। মানে হইতাছে পৃথিবী গোলাকার। এই ধর তোর বুক যেমুন। মুখলেস ডাক্তার গ্রাম ছেড়ে গেছেন বেশ আগেই। যাবার সময় তিনি স্থায়ীভাবেই আলেয়ার ব্যবস্থা করে গেছেন। তাকে তাই আর ঘন ঘন ডাক্তারের কাছে ছুটে যেতে হয় না।
আলেয়াকে নিয়ে রামখালি বেশ ভালোই ছিলো। তারপর একদিন পাল্টে যায় সবকিছু। হঠাৎ করেই আলেয়া অসুস্থ হয়ে যায়। আলেয়া অসুস্থ হলে গ্রামের কারো কিছু যায় আসে না। যদি একজন কারো খানিকটা অসুবিধে হয় তিনি আলেয়ার নানী। বেচারির খাবার বন্ধ হয়ে যায়। বাধ্য হয়েই বৃদ্ধা আলেয়াকে নিয়ে হাসপাতালে যান। এবং সেই হাসপাতাল থেকেই আসে দুঃসংবাদটি। সেটি পুরো রামখালিকে বিরাট একটি ধাক্কা দিয়ে যায়। সেদিন সকালবেলা শহর থেকে দু’জন ভদ্রলোক আসেন। তারা আলেয়ার সন্ধান করেন। প্রথমে তাদের সাথে দেখা হয় ইমাম সাহেবের। তিনি বাজারে যাচ্ছিলেন। ওরা তার কাছ থেকেই আলেয়ার ঠিকানা জানতে চায়। পানের পিক্ ফেলে গম্ভীর মুখে ইমাম সাহেব বলেন, আমি মসজিদের ইমাম। নটি বেটির খবর রাখন আমার কাম না। দেহেন কোথায় পইর‌্যা আছে। এই মাইয়াডা সারা গেরামরে দোযখ বানাইছে।
সেই ভদ্রলোকের একজন ইমামের চাইতে আরো গম্ভীর স্বরে বলেন, সারা গ্রামের লোকেরাই কি আলেয়ার কাছে যেতো?
ইমাম বলেন, শরমের কথা আর কী কমু। গেরামের বেইজ্জতি। বাবাও যায়। পোলাও যায়। দীর্ঘশ্বাস গোপন করেন ইমাম সাহেব, বুঝলেন কেয়ামত নজদিক।
হু। যা ভেবেছিলাম অবস্থা মনে হচ্ছে তার চাইতেও বেশি খারাপ।
কি ভাবছিলেন? আগ্রহী স্বরে জানতে চান ইমাম সাহেব।
আর কিছু না বলেই ভদ্রলোক দু’জন ফিরে যান।
সেদিন বিকেলেই সারা গ্রামে বিদ্যুতের বেগে ছড়িয়ে পড়ে সেই ভয়াবহ দুঃসংবাদটি। আলেয়ার এইডস্ হয়েছে। রামখালি জানে এইডস মানে ভয়াবহ অসুখ। টিভিতে নিয়মিত এ নিয়ে একটি বিজ্ঞাপন প্রচার হয়। সবুজ ছাতা কিনিকের ডাক্তার আপাও বলেন, আগেরকার দিনের কলেরার চাইতেও এইডস নাকি আরো বেশি জটিল রোগ। কারো একজনের এইডস হলে সে মারা যায়। যে তার সাথে এক বিছানায় ঘুমায় সেও এই রোগে বান্ধা পড়ে। কথাটি শোনার পর তাই রামখালিতে ভূত নেমে আসে। সবখানে বিরাজ করে অসুস্থ নীরবতা। কেউ কথা বলে না। মাগরিবের নামাজের শেষে মোনাজাতের সময় ইমাম সাহেব আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েন। হে দয়াময়! আমাগো তুমি সকল বালা মুসিবত থাইক্যা বাঁচাইয়া রাখো গো মাবুদ। হে মাবুদ, সব পাপের তুমি মা দাও। এদিন মসজিদে নামাজির সংখ্যা বেড়ে যায়। সবাই বুঝতে পারে কোন্ মুসিবতের কথা বলছেন ইমাম সাহেব। মসজিদের কান্না ছড়িয়ে পড়ে গোটা গ্রামে। কাঁদে রামখালি। এই রামখালির একটি মেয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর নিকটে বাস করছে। মেয়েটির জন্য কান্না নয়। নিজের জন্য কাঁদছে রামখালির তাবৎ পুরুষ!
রাতের বেলা রামখালির কোনো পুরুষের চোখে ঘুম আসে না। শেষ রাতে মাজুম শেখ কলঘরে গিয়ে পাগলের মতো গায়ে পানি ঢালতে শুরু করেন। কন্ঠে বিসমিল্লাহ্ বিসমিল্লাহ্ ধ্বনি। পানিতে ফুঁ দেন তিনি। যেনো পবিত্র পানিতে গোসল সারলেই শরীর পবিত্র হয়ে আসবে। মুছে যাবে আলেয়ার শরীরের জীবাণু। মাজুম শেখের স্ত্রী দৌড়ে আসেন কলঘরে, কি হইলো আপনের, এমুন করতেছেন ক্যান? মাজুম শেখের স্ত্রী তার যুবক পুত্রকে ডাক দেন, কই গেলিরে আজাদ, এইদিকে আইয়া দ্যাখ, তোর বাজানে কেমনু জানি করতাছে। আজাদ সবই জানে। তার গায়ে প্রচণ্ড জ্বর আসছে। এইডস হলে জ্বর আসে নাকি!
পরদিন পুরো রামখালির পুরুষরা জ্বরে ভুগেন। তারা ঘুমিয়ে থাকেন। গ্রামের মেয়েছেলেরা জানতে চান ঘটনার বৃত্তান্ত। আলেয়ার খবর শুনেন তারা। কেউ কেউ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করেন। কেন এমুন হবে জানতে চায় নসিমন, কওগো বুবু আমার কি যৈবন কম আছে, তয় কেন আলেয়া বান্দীর কাছে যান আবুর বাবা?
জইতরী বলেন, আমার ইনারে বুঝতাম আল্লাহ্র ওলী, ইনি ক্যান আকাম কুকামে যাইবেন?
রামখালির প্রতিটি নারীর বিশ্বাস ভেঙে যায়। মায়ের দৃষ্টিতে প্রগাঢ় অবিশ্বাস, স্ত্রীর দৃষ্টিতে, প্রেমিকার দৃষ্টিতে সবখানেই বাসা বাঁধে ভীষণ নিষ্ঠুর অবিশ্বাস। রামখালি হয়ে যায় অসুস্থতা এবং বিশ্বাসহীনতার একটি নিষ্ঠুর গ্রাম। রামখালি হয়ে যায় এইডস আক্রান্ত একটি গ্রাম। রামখালি হয়ে যায় আলেয়ার অভিশাপ। রামখালি হয়ে যায় বাবা দস্তগীর আউলিয়ার অভিশাপ!
অনেক সময় অনেক কিছু ঘটে যার জন্য প্রস্তুত থাকে না কেউ। রামখালি এই বিপর্যয়ের জন্যও তেমন প্রস্তুত ছিলো না। হঠাৎ বিপদে চোখে অন্ধকার দেখা রামখালির জন্য আরো একটি দুঃসংবাদ। সেই সংবাদটি আবিষ্কার করে কাস নাইন পাশ শেফালী। এ গ্রামের সে নতুন বাসিন্দা। জহির খাঁর শিতি বউ। গত ভাদ্রে তাদের বিয়ে হয়েছে। জহির খাঁ গতকাল থেকে জ্বরে ভুগছে। আলেয়ার জ্বর। শেফালী বিদ্যাবতী মেয়ে বলে জানে কোনো পুরুষ যদি এইডস্ ব্যারামের কারো সাথে সহবত করে তারপর স্ত্রীর সাথে সহবত করে তবে সেই স্ত্রীর ভাগ্যেও চরম সর্বনাশ। তারও এইডস্ হবে। বিষয়টি আবিষ্কার করে ডাক ছেড়ে কাঁদে শেফালী। শেফালীল এই কান্না পৌঁছে যায় পাশের বাড়ির আবুর মায়ের ঘরে। আবুর মাও কাঁদেন। দেখতে দেখতে কাঁদে রামখালির বিবাহিত নারীরা। স্বামীর নষ্টামির দায় নিয়ে কাঁদেন তারা।
কেবল কান্না নয় দেখতে দেখতে তাদের শরীরেরও তাপমাত্রা বাড়ে। প্রথমে জ্বর আসে শেফালীর। ঝড়ের মতো সেই জ্বর ছড়িয়ে পড়ে সবখানে, প্রতিটি ঘরে।
মহামারি দেখা দিয়েছে রামখালিতে। নিশ্চুপ মহামারি। কেউ কিছু বলছে না। পুরুষরা আশ্চর্য নীরব। নারীরা বিশ্বাসভঙ্গের যন্ত্রণায় কাতর।
রামখালি থেকে তিন মাইল দূরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। প্রথম দু’দিনে নীরবতা ভেঙে তৃতীয় দিন গ্রাম ভেঙে পুরুষরা হাজির হন সেই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সকাল থেকেই মানুষে গিজগিজ করে ছোট্ট এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ডাক্তার হঠাৎ আশ্চর্য সংখ্যক রোগী দেখে কেবল একটাই বাক্য বার বার আউড়ে যানÑ কী হয়েছে আপনাদের?
কারো মুখে কথা নেই। তমিজ মুন্সি মুখ ঢাকেন। মুখ আড়াল করে একটু দূরেই বসে আছে তার যুবক সন্তান। মুখ ঢাকেন মাজুম শেখ। একই কারণ। একই বৃত্তান্ত। তাই নিজেকে অন্যজনের কাছ থেকে প্রাণপণে আড়াল করার চেষ্টা করেন একেকজন। কিন্তু সবাই ধরা পড়ে যান একজন অন্যজনের কাছে। লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে ইমাম সাহেব বলেন, কাল কেয়ামতের ময়দানে লজ্জা-শরম রাখতে নেই। ডাক্তার সাবগো আমাদের ‘বেলাড’ নিয়া দেখেন আমাগো রক্তে কেমুন পাপ জমা হইছে। আমাগো বাঁচান গো ডাক্তার। অন্তত তওবা করনের মওকা দেন। জ্বরে শরীর পুইড়্যা যায়।
এক সময় ডাক্তারের পুরোটা কাহিনী জানা হয়ে যায়। এই ডাক্তারের এক কথা বার বার বলার বদঅভ্যেস আছে হয়তো। এখন তিনি কেবল বলছেন, কী আশ্চর্য, কী আশ্চর্য, আলেয়া মেয়েটি দেখতে কেমন! কী আশ্চর্য!
তারপর আরেকটি আশ্চর্য কথা বলেন তিনি, মানুষের নষ্টামী মেপে দেখতে তার ইচ্ছে করছে না।
বিফল হয়ে গ্রামে ফিরে আসেন তাবৎ পুরুষেরা। তারা দেখেন নদীর ঘাটে অনেক নৌকা লেগে আছে। এখন নাইওরে যাওয়ার সময় নয়। গাঙের পানিতে নেই কোনো উত্তাল। থৈ থৈ বর্ষা আসতে আরো মেলা বাকি। তবুও মেয়েকে নিয়ে যেতে বাবা এসেছেন, বোনকে ফিরিয়ে নিতে এসেছেন ভাই। বিশ্বাস শব্দটা রামখালি থেকে বিদায় নিয়েছে। অবিশ্বাসের সঙ্গে সংসার করতে যারা রাজি নন, তারা চলে যাচ্ছেন। আলেয়ার অভিশাপে সংসারে, সংসারে লেগেছে আগুন। প্রতিবাদী পুরুষরা, কথায় কথায় যে পুরুষ স্ত্রীর গায়ে হাত তুলে ভরা মজলিসে উচ্চকণ্ঠে সেটি জানিয়ে দিয়েছে, সেই পুরুষরা আজ আশ্চর্য নীরব। রামখালিতে এই প্রথমবার কোনো নারী স্বামীর অনুমতির তোয়াক্কা না করে বাপের বাড়িতে যাবার বন্দোবস্ত করে। এই প্রথমবার নারীরা অনুভব করে স্বাধীনতা বলেও একটা ব্যাপার আছে, তারা বুঝতে পারে, স্বাধীনতা তখনই নিশ্চিত হয়, যখন শাসক ভয়াবহ রকমের অন্যায় করে।
রামখালির কিছু কিছু বাড়ি খালি হয়ে যায়। খাঁ খাঁ করে ঘর। ঘরগুলো শূন্য হয়। মানুষ যখন একটি ঘর হারিয়ে ফেলে তখন অন্য একটি ঘরের জন্য তারা ব্যকুল হয়। রামখালির পুরুষরা নতুন ঘরের সন্ধান লাভ করেন। একে একে ভিড় বাড়তে থাকে মসজিদে। নামাজে দাঁড়িয়ে পুরুষেরা আকুল কান্নায় ভেঙে পড়েন। কাঁদেন ইমাম সাহেব, কাঁদেন চেয়ারম্যান, কাঁদেন কানা বক্কর। কান্নায়ও সমতা চলে আসেছে। কানা বক্কর এলাকার হতদরিদ্র ব্যক্তি। সবার সঙ্গে থাকতে তার বড় ভালো লাগে। এমনকি সবার মতো আলেয়ার কাছে যাওয়ার শখ তারও ছিল। যেতে পারেনি। যদি আলেয়া দু’ দশ টাকা চেয়ে বসে, সেই ভয়ে। এখন সবার দেখাদেখি সেও মসজিদে আসে। অন্যের সাথে কাঁদে কানা বক্কর। কেঁদে কেঁদে সবাই মহান স্রষ্টার কৃপা প্রার্থনা করেন। কিন্তু মনে শান্তি আসে না। আরো নানাভাবে তাই শান্তির সন্ধান করেন।
গেলো হাটবারে খোকনের চায়ের দোকানে বিচার সভা বসার কথা ছিল। আলেক মুন্সি ও তার ভাতিজাদের মধ্যে জমিজমা নিয়ে পুরাতন বিরোধ। অনেকবার সভা বসেছে। খোকনের চায়ের দোকানের পসার বেড়েছে। বিরোধ কমেনি। আলেক মুন্সির ভাতিজারা ঘোষণা করেছে, তারা আলেক মুন্সিকে দেখে নেবে। এ নিয়ে কত উত্তেজনা! আলেক মুন্সিও কম যায়নি। সে তার ভাতিজাদের নামে থানায় চুরির মামলা করেছে। হাটবারের বিচারসভায় এইসব নিয়ে কথা হতো। দু’টি প তৈরি হতো। কথা কাটাকাটি হতো। দেখতে দেখতে হয়তো বেরিয়ে আসতে দা-বল্লম। কিন্তু বিচারসভা বসেনি। আলেক মুন্সি বিচারের একদিন আগে পিছুটান দিয়েছেন। যে জমি নিয়ে এত বিরোধ, যার ইঞ্চি পরিমাণ জায়গা ধরে রাখার জন্যে যুদ্ধের প্রস্তুতি, সেই জমির ওপর থেকে নিজের অধিকার ফিরিয়ে নিয়েছেন আলেক মুন্সি। যেনো আলেক মুন্সি নয়, কথা বলছেন কোনো মহান বুজুর্গ। তিনি বলেন, জায়গা-জমিনে কিছুই যায় আসে না, মরবার কালে সেইতো সাড়ে তিন হাতের কারবার। যারা জমি চায়, তারা নিয়া যাক, আমারে কেবল সাজায়া দাও, আমি আল্লার কাছে যামু।
আল্লাহ্র কাছে পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার জন্যে জুম্মন শেখও তার সকল লেনাদেনা শোধবোধ করছে। বহু আগে মাজুম শেখের কাছ থেকে সাতশ’ টাকা ধার নিয়েছিল সে। সেই টাকাও ফেরত দেওয়া হয়েছে। টাকা ফেরত দিতে গিয়ে জুম্মন শেখ মাজুম শেখের কাছে বলেছে, চাইলে আপনের টেকায় আমি সুদ দিবার পারতাম, তয় মসজিদের ইমাম কইছেন, সুদ দেওন হারাম।
রামখালিতে অনেক বিরোধ ছিল। রামখালি গ্রামে ছিল দলাদলি, ছিল চুলোচুলি, ছিল গালাগালি, ছিল একের সাথে অন্যের পুরাতন গোষ্ঠী-দ্বন্দ্ব। এখন পাল্টে যাচ্ছে রামখালি। এখন গলাগলি, এখন হাত ধরে পথচলা। বিস্ময়কর রকমভাবে গ্রামে শুদ্ধ মানুষের সংখ্যা বাড়ে।
শুদ্ধ হচ্ছে রামখালি। পুণ্যের পথে হাঁটছে রামখালি। পাপ তাদের পূর্ণতার কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। তবে কি পুণ্য করতে হলে পাপের পথ পেরুতে হয়? তবে কি পাপের হাত ধরেই আসে পূণ্যতা? প্রশ্নটি কেউ করে না। পাপ-পূুণ্য নিয়ে প্রশ্ন করতে নেই। কিন্তু পাপ যদি না থাকতো তবে কি পূণ্যের ইচ্ছা জাগতো রামখালিতে?
কানা বক্কর এই প্রশ্নটি তুলে। এক জুম্মাবারে ইমাম সাহেবকে চমকে দিয়ে সে জানতে চায়, পাপ-পুন্যির ব্যবধান কী হয় কন দেহি?
ইমাম পাপ ও পূণ্য সম্পর্কে দীর্ঘ কথা বলেন। তার কথায় হাদীস কোরআন আসে। দোজখের কঠিন বর্ণনায় গ্রামের মানুষের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে।
কানা বক্কর হাসে। সে বলে, ইমা সাব পাপ-পুন্যির ব্যবধান হইতাছে আলেয়া। আলেয়াই পাপ, আলেয়াই পুন্যি। আলেয়া নাইতো পুন্যিও নাই।
খেপে উঠেন ইমাম সাহেব। কও কী মিয়া? তওবা করো। আলেয়া ক্যামনে পাপ আর পুন্যি হয়?
কানা বক্কর আবার হাসে। হেসে হেসে বলে, আলেয়াই মুর্শিদ হয় গো, আলেয়াই হয় ইবলিশ।
কানা বক্করের দুঃসাহস মেনে নেওয়া যায় না। ইমাম সাহেব বলেন, বক্কর যা কইতাছে তাতে আল্লাহ্র আরশ কাঁইপা আসে। আলেয়া ক্যামনে মুর্শিদ হয়। আমাগো এইহানে বাবা দস্তগীর আউলিয়া শুইয়া আছেন, তিনিই তো পথ দেহান। আমরা যারা ভুল করছিলাম, তিনিই তো আমাগোরে আবার সত্য পথের সন্ধান দিলেন। ইমাম সাহেব রাগী স্বরে বলেন, আলেয়ারে যে কয় মুরশিদ হের ইমান-আমল নাই।
মসজিদের সবাই একযোগে মাথা নাড়ে। ইমাম সাহেবের কথায় তাদের কারো আপত্তি নেই। ইমাম বলেন, কানা বক্কর কাফের হইয়া গেছে।
কানা বক্কর মাথা নিচু করে বসে আছে। সে কেবল একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে চেয়েছিলো, পাপ কারে কয়?
ইমাম সাহেব আরো অনেক কথা বলেন। কিছুই সে বুঝতে পারে না। ধর্মের জটিলতা বুঝার সাধ্যও তার নেই। হঠাৎ সে শুনতে পায় ইমাম সাহেব বলেন, ধর্ম লইয়া অধর্ম যে করে তার বউ তালাক হইয়া যায়। কানা বক্করের বউ তালাক হইয়া গেছে।
চমকে উঠে কানা বক্কর। বউরে সে বড়ই পেয়ার করে। এইটা কী কন ইমাম সাব! একখান চোখ নাই, বউ হইতাছে হেই চোখ। এহন বউ গেলে ক্যামনে বাঁচি?
ইমাম সাহেব বলেন, চুপ কর। শাস্তি দেওনের মালিক আমি না। সবই তিনার বাতলে দেওয়া। কথা শেষে মসজিদের ছাদের দিকে তাকান তিনি। যেনো ঐশী যোগে বাণী পৌঁছে যাচ্ছে তার কাছে। তারপর বলেন, যে পুলায় কাফের হইয়া যায়, বাপ-দাদার ভূমি থাইকা তার স্বত্বও উইঠা যায়। কানা বক্কর ত্যাজ্য হইছে। বক্কর তার বাপের কোনো সম্পত্তি পাইবো না।
আবারো চমকে উঠে বক্কর। বাপের সম্পত্তি বলতে একটিমাত্র ভিটে-বাড়ি। এই বাড়ি যদি চলে যায়, তবে কোথায় যাবে সে?
ভাবনাটা বড়ই জটিল। কিন্তু কানা বক্কর সেটি নিয়ে ভাবতে রাজি হয় না। সে তার পুনরায় ভাবনায় আবার ফিরে যায়, পাপ কারে কয়? পূণ্য কারে কয়? অকস্মাৎ শুনতে পায় একটি নারী কলকল করে হাসছে। তবে কি আলেয়া হাসে। আলেয়া হাসবে কীভাবে? মেয়েটি সেই যে হাসপাতালে গিয়েছিল আর গ্রামে ফিরে আসেনি। চলে গেছে অন্য কোথাও। সে কি বেঁচে আছে?
কানা বক্কর ভাবে, আলেয়া বেঁচে থাকুক। আলেয়া থাকে বলে পাপও থাকে, পুণ্যও থাকে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!