১
সন্ধ্যার পরে রাতটা ঝুপ করে নামে, আর জাহানারার চোখ আর কান সজাগ হয়ে উঠে। মাটি থেকে মাথা তোলা ভেজা কুয়াশা তার শন হয়ে যাওয়া চুল কামড়ে ধরে, তার কণ্ঠ হয়ে যায় ঘর্ঘরে। প্রথম প্রথম হাজেরার কেমন গা কাটকাটা দিয়ে উঠতো, কিন্তু এখন সে নিশ্চিন্ত ঘুমায়।
এমন অসংখ্য পূর্নিমা, অমাবস্যা, শীত-গ্রীষ্ম রাত এই গাছটার কাছে দাঁড়িয়ে জাহানারার কথকতা ক্রমশ দুর্বোধ্য হয়ে উঠে।
গোরস্তানটাক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে, জাহানারার মনে হয়। জাহানারার আরো অনেক কিছু মনে হয়। তার জড়িয়ে যাওয়া স্মৃতিতে সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। সে বসে পড়ে। আলোর বিস্তার-প্রবণতা যেন শীতে শাসিত হল, পূর্নিমার হাওয়া হাওয়া চপলতা জমে বরফ হয়ে ফের চাঁদটাতেই আশ্রিত হল।
হাজেরার ছেলেটা হটাৎ চোখ খুলে মাকে জানালো “দাদী মারা যাচ্ছে”, সাত বছরের ছেলেটা কথা এমনিতেই কম বলে, তার কণ্ঠে এমন একটা নিশ্চিত ঘোষণা ছিল যে হাজেরা দ্রুত উঠে বসে।
২
জাহানারার জন্যই এই বাড়িটা বানানো। তার বাবা ছিলেন মোড়ল গোছের কেউ, জাহানারারা কয় ভাইবোন ছিলেন? জাহানারা নিজেও কি গুনে দেখেছিল, হয়তো গোনার বয়স হবার আগে বিশাল ছাতি দাড়িওয়ালা যুবক, কি মাঝবয়সী, কি বৃদ্ধ আব্দুর লতিফ(জাহানারার চোখ কখনো এই লোকের বয়স আন্দাজ করে উঠতে পারে নাই ) উদয় হয় তাদের বাড়ির আঙিনায়। জাহানারার বাপ কাসেম জব্বার তার হাঁটুর বয়সী লোকটাকে কি দারুণ সমীহে “বাপো হে” বলে বুকে জড়িয়ে নেন। এই লোকটা নাকি সংসার ত্যাগ করেছিল, কাসেম জব্বারের সাথে কোন এক চরে দেখা হয় আব্দুর লতিফের। সম্ভবত এই মোড়লকে জলডুবির হাত থেকে বাঁচিয়েছিল লতিফ। মোড়ল জব্বার ছেলেটার ভেতরে কিছু একটা দেখেছিলেন, অনেক কথার পর বলেছিলেন “বাপো, জ্ঞান-বুদ্ধিতে তোমার গোড়ত মুই ছাওয়ারও অধম, কিন্তু বাপের একটা অনুরোধ থোন, তোমার যদি মতি পাল্টায় মোর বাড়িত একটাবার আসিয়েন”। কাসেম জব্বারের বাকপটুতা ছিল কিংবদন্তী-তুল্য। এজন্য নয় যে সে খুব আলংকরিক কথা বলতে জানতো, বরং সে খুব ভালো করে জানতো কাকে কিভাবে বলতে হয়।
সেই আলাপচারীতার বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আব্দুর লতিফের আগমন ঘটে। কথার মাঝে আব্দুর লতিফের “মতি পাল্টানো” আন্দাজ করে, বলে “বাপো হে, তোমাক দিবার মত হামার আর কি আছে, তোমার যা নাগে তোমার এই বাপটাক একবার কয়া দ্যাখো”।
আব্দুর লতিফ জানায় সে তার যেকোন এক কন্যাকে বিয়ে করতে চান। কাসেম জব্বারের চাওয়াটাও এই ছিল, কিন্তু তার মুখে এক অভাবিত আনন্দের প্রকাশ ঘটে, সে তার সব থেকে আদরের মেয়েটাকে তার হাতে তুলে দেন।
তিনি তার এই জামাতাকে তার সাথে থাকার অনুরোধ করেন, সবথেকে উর্বর জমির ভোগ-দখলদারিত্ব প্রস্তাব করেন, কিন্তু মৃদুভাষী আব্দুর লতিফ তা মাথা নাড়িয়ে অস্বীকার করেন। আর মোড়লের নদী-সংলগ্ন বাড়ি থেকে তিনক্রোশ দূরে প্রায় জংলা এক তালুকে ঘর বাঁধার ইচ্ছে পোষণ করে।
এই জায়গাটা ছিল উঁচু, মাটি কিছুটা শক্ত, ঘরবসতি খুবই কম, আর কিছুদূরেই ছিল একটা কবরস্থান, যেখানে বেঁচে থাকা মানুষের বেঁচে থাকাটাই ঘটনাময় নিদর্শন, সেখানে মৃত্যুকে বিজ্ঞাপিত করার রীতি ছিলনা বলেই হয়তো কবরগুলো গ্রাম থেকে একটু দূরেই থাকতো।
তো ঐ জংলা তালুকে কামলাদের নিয়ে প্রায় দু-বছর বাসযোগ্য করার জন্য আব্দুর লতিফ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে দাঁড় করিয়ে ফেললো মাটির ঘর, আর আবাদের জমি, আর বিশাল পুকুর। মোড়লের কামলারা তার কাছে গিয়ে তার জামাতার অসীম-গুনগান করে, জাহানারা সামনে দিয়ে গেলে বলে “মায়ো হামার, জামাই পাইছে ভালো”। হয়তো আব্দুর লতিফ খেতে বসলে জাহানারাকে ঠেলে ঠুলে কেউ পাঠিয়ে দিত খাবার পরিবেশন করতে, জাহানারা আব্দুর লতিফকে ভাত তুলে দিত, লজ্জা-শরম ব্যাপারটা তখনও বুঝতে শেখে নাই সে, খুব টরটরে গলায় বলতো “দাড়িয়া, আর একনা ভাত নেন”।
আব্দুর লতিফ মৃদু হাসত, তার দাড়িভর্তি মুখে এই অভিব্যাক্তিটাই কেবল বোঝা যেত।
এই উঁচু জমিনেও আব্দুর লতিফ তার বাড়িটা বানান আরো উঁচু করে, বাঁশের বেড়া দিয়ে পুরোটা ঘিরে ফেলেন, জাহানারা এই বাড়িতে পা রেখে অভিভূত হন।
এই বাড়িটা কেবল জাহানারার জন্যই বানানো হয়েছিল, না হলে কি এইরকম হটাত খেয়ালে উধাও হয়ে যেত আব্দুর লতিফ? প্রায় একযুগ পর বুকে ক্ষয় রোগ, আর পায়ে পচন নিয়ে কেবল মরবার জন্য কেবল ফিরে এসেছিল।
হটাৎ বেয়াড়া হয়ে তিস্তা কাসেমজব্বারের গ্রামটাকে ঘুমন্ত চেটে নিল তার জিহ্বায়, তারপর আর একটু নড়চড় এদিক-উদিক করে জনবসতিগুলোকে আর একটু ঠেলে পাঠাল। জাহানারার বড় ছেলে ইদ্রিসের কেবল দেড় বছর, তিস্তা তার জিহ্ব সামলে নিলেও গোরস্থানটা গায়ে গতরে বাড়তে লাগলো, গ্রামের পর গ্রাম গোরস্তানের উদরে চলে যেতে লাগলো। দুর্ভিক্ষ, মড়ক। রাত হলে শেয়ালের চিৎকারে কানে তালা লেগে যেত। গোরস্তানের জীব শেয়ালগুলো রাতে বাড়ির আঙিনায় উঠে আসতো, চোখগুলো জ্বলে উঠত।
এমনই কোন একরাতে শেয়ালের দল জাহানারার উঠোনে রক্ত হিম করে ডেকে উঠলে আব্দুর লতিফ অস্থির হয়ে উঠেন, জাহানারার নিষেধ সত্বেও ঘর থেকে বেড়িয়ে আসেন, তার হাঁকডাকেও শেয়ালগুলো একটুও নড়েনা, যেন তার জীবন্ত অস্তিত্ব তারা মানবেই না, তার থেকে বিস্ময়কর ব্যাপার ঘটে মৃতজীবী এই প্রানিগুলোর একটা ছুটে আসে তার দিকে। আব্দুর লতিফ খুব ত্বরিত তার গায়ে জড়ানো খাদি আবরণটা পেতে শেয়ালটাকে ধরে সজোরে আছাড় মারে, তার কণ্ঠে খুনে উল্লাস জাগিয়ে দেয় গোটা জনবসতিকে, ঘর থেকে সেই রাতে বেড়িয়ে পরে মানুষ, লাঠিসোঠা নিয়ে। যেন জনপদটায় অস্তিত্বের লড়াইয়ের আর একটা মীমাংসা ঘটানোর দায় অনুভব করে, নিজেদের অভুক্ততার ক্রোধ প্রকাশিত হয়, শেয়ালের গর্তগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয়, মুহুর্তে মানুষের উল্লাসে আর শেয়ালের চিৎকারে জনপদটা কেঁপে উঠে, মানুষগুলো যেন বেঁচে থাকার একটা অবলম্বন পায়।
ভোর পর্যন্ত মানুষের এই অভিযান চলে। আর আব্দুর লতিফ যখন ঘরে ফেরে, জাহানারাকে স্পর্শ করে, জাহানারার শরীরে নারীত্বের রোশনাই জ্বলে উঠে, তার সমর্পন ঘটে শরীর মনে। তারপর জাহানারা তার মন বারান্দার সব কটা জানালা খুলে দিতে না দিতে আব্দুর লতিফ নিরুদ্দেশ হয়ে যায়, সে গ্রামের আরো দুইজনকে নিয়ে চলে যায়, যাবার আগে বলে “জাহান, ঐযে মাটির নিচে বছর খানেকের খোরাক আছে, আত্নাক কষ্ট দিও না, দিন ফিরবে আবার”।
তার সাথে যে দুইজন গিয়েছিল তারা ছয় মাসের মধ্যে ফিরে আসে, তারা বলে “ভাইয়ো ভালো আছে বইন, তোমরা না চিন্তা করেন”। জাহানারা বিধবার চিহ্ন নিতে চাইলে, তারা বাঁধা দেয়, এই দুইজন এর একজন তার বাপের বাড়ির লোক, তাকে মরা কাসেম জব্বারের দিব্যি দিলে সে বলে গোরা পুলিশেরা লতিফকে খুঁজছে, জাহানারার ছোট ছেলে আনিস তখনো পেটে। আর জাহানারার তখন থেকেই দাঁড়িয়ে আমগাছটার সাথে বোঝাপড়া চলে।
জাহানারার প্রথম যৌবন আব্দুর লতিফের এই চলে যাওয়াটাকে নিজের ব্যর্থতা হিসেবে নেয়, মনে হয়। যার কারনে তার বড় সন্তান ইদ্রিস অনেক পরে যখন হাজেরাকে বিয়ে করে আনে, আর সারা দিন রাত তাতে মজে থাকে, তখন সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কথ্য অকথ্য অনেক অভিশাপ দেয়।
আনিস বেড়ে উঠে তার পিতার আদলে, আনিসের প্রতি জাহানারার মুগ্ধতা ভালবাসা একাকার হয়ে থাকে। আনিস আব্দুর লতিফের মত সংযত মৃদুভাষী সাবলীল এক বালকবেলা ধারণ করে।
একযুগ পর যখন আনিসের পাগুলো ধানের মধ্যবয়সী সবুজ ছোঁয়া জীবনের মত আপাত ভঙ্গুর অথচ ছন্দময় দোলায় প্রান-সঞ্চারন করে রুক্ষ মাটিতে, খুব মৃদু গলায় সে মাকে জানায় বাবার জন্য প্রস্তুত হতে, একযুগের প্রতীক্ষা যখন অভ্যাস হয়ে যায় জাহানারার, তখন কিশোর ছেলের কথায় অবিশ্বাস কিংবা বিশ্বাস করার কোন ফারাক থাকেনা।
আর সত্যি সত্যি আব্দুর লতিফ তার সাদা-পাকা দাড়ি নিয়ে উঠোনে এসে দাঁড়ায়। পায়ে পচন আর বুকে ক্ষয় রোগ, অথচ তেমনই মৃদু হাসি, যেটা তার একমাত্র ব্যক্ত অভিব্যক্তি।
আনিস আব্দুর লতিফের পাশে বসে থাকে, আর আব্দুর লতিফ যেন একটু একটু করে নিজে ছেলের ভেতরে ঢুকে যেতে থাকে। বাপ-বেটা অনেক গল্প করে। বড় ছেলে বাপের পাশে ঘেষেনা, এই ছেলের লঘু স্বভাব আব্দুর লতিফকে টানেনা, সে আনিসের ভেতরেই হস্তান্তরিত হয়, আর মাঝে মাঝে জাহানারার দিকে তাকিয়ে সেই মৃদু হাসিটা হাসে।
আব্দুর লতিফ আর বছর দেড়েক বাঁচে, শেষ দিকে জাহানারার কাছে অনুযোগ করে, সে আর তাকে “দাড়িয়া” বলে না কেন।
এবং ঐ দেড় বছর যেন সে বেঁচেছিল কেবল পুরোটাই আনিসে সংক্রমিত হবার জন্য, বাবার মৃত্যুর পর সেই মৃদু হাসিটা আনিসের ঠোঁটে ভর করে।
৩
ইদ্রিস খুব চপলমনা, যাত্রার দলের পেছনে ঘোরে, রংবেরঙের পিরান পরে, পানের পিকে ঠোঁট লাল করে রাখে। সে যখন হাজেরাকে বিয়ে করে আনে হাজেরা তখন প্রায় ষোড়শী। হাজেরাকে নিয়ে কিছুদিন ইদ্রিসের মাতামাতি জাহানারাকে এমন এক হীনমন্যতায় ঠেলে দেয়, তার মনে হতে থাকে তার নারীত্বের কোন ঘাটতির কারনেই আব্দুর লতিফ থিতু হতে পারেনি। ইদ্রিসের এই আগ্রহ শেষ হয়ে যায় একসময়, আবার যাত্রার দলের পেছনে যায়, রক্তে পাপী অসুখ নিয়ে ফিরে খুব কোঁকায়, আবার একটু সুস্থ্য হলে ফের রঙিনকে ধাওয়া করে।
হাজেরা একদিন গুটিগুটি পায়ে আনিসের সামনে দাঁড়ায়, এর আগে হাজেরার আসার পর দেড় বছর আনিসের সাথে তার কোনরকম বাক্যবিনিময় হয়নি, কোন সম্বোধন না করেই সে তার স্বামীর অনুজকে জানায় তার বাপের বাড়িতে একটা খবর নিতে, তারা কেমন আছে, কি করছে। সেই থেকে তাদের কথা হত। বরং বলা যায় হাজেরার চোখ অনুসরণ করতো আনিসকে, আবার গোরস্তান নড়াচড়া দেবার আগে ব্যাপারটা যে আনিস অনুভব করতো তা বোঝা যায়না।
দুর্ভিক্ষ আর মড়ক নামলে শেয়ালের উৎসব শুরু হয়, মৃতজীবিদের চিৎকারে কানে তালা লাগে, আর আনিস হাতে মশাল জ্বালিয়ে শেয়ালদের আস্তানায় আগুন লাগিয়ে দেয়, গোটা জনপদ তাড়িয়ে দেয় শেয়ালগুলোকে।
আর ভোরে যখন হাজেরার দরজা বাহির থেকে মৃদু পদক্ষেপে খুলে যায়, যেহেতু সেটা খোলাই ছিল, প্রতীক্ষার মত।
আনিস আর হাজেরা মিলে যায়।
এবং হাজেরার সমস্ত জানালা উন্মুক্ত হবার আগেই আনিস নিরুদ্দেশ হয়।
আনিসের এই প্রস্থানের পর, হাজেরার দিকে জাহানারা সহানুভূতিতে আদ্র কণ্ঠে জানায় “তুইও পারলু না মা”।
ইদ্রিস ফিরে ফিরে আসে, অসুখ সহনীয় হয়ে উঠলে আবার ফিরে যায়, কিন্তু আনিস ফেরেনা, জাহানারা সান্ত্বনা দেয়, কিংবা জাহানারার আত্নবিশ্বাস এতো প্রবল হয় যে জাহানারা বিশ্বাস করতে থাকে, আব্দুর লতিফ যেমন আনিসে সংক্রমিত হতে ফিরে আসে, আনিসও তাই হতে ফিরে আসবে।
হাজেরাকে যখন তার সন্ত্বান দাদীর আশু মৃত্যুর ঘোষণা দেয়, সে তার ছেলের হাত ধরে আমগাছের তলায় যায়, চাঁদটা তখন তার বরফ হয়ে যাওয়া পূর্নিমাকে আরো নিবির ভাবে গুটিয়ে নিয়েছে, আর আকাশটা কিছুটা আবীর মেখেছে ।
মৃত জাহানারার দেহের পাশে বসে, ছেলেটা আর তার মা প্রতীক্ষা করে। ছেলের প্রসারিত আঙ্গুল অনুসরণ করে হাজেরা দেখতে পায় ক্রমশ একটা চেনা, বহুপ্রত্যাশিত ছায়ামূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠছে।