কাকতাড়ুয়াদের আকাশ

অদ্ভুত এক বিকেলে ঝন্টুর সাথে পরিচয়।

ঝাঁকড়া চুল, পাগলাটে দৃষ্টি আর বড় বড় চোখে একরাশ চকমকি পাথরের দ্যুতি নিয়ে ক্যাম্পাসে হেঁটে বেড়াতো ও। ইকোনমিক্স নিয়ে পড়া ছেলেরা হয় খুব বুকিশ নয় কাঠখোট্টা। কিন্তু ঝন্টু ছিলো অন্যরকম। ঝন্টুর ভালো নামটা খুব সুন্দর ছিলো— ‘নন্দিত রহমান’। কিন্তু ক্যাম্পাসে আমরা কেউ ওকে ওর ভালো নামে ডাকতাম না। কোন এক দুর্বল মুহূর্তে আমরা জেনে গিয়েছিলাম ওর ডাকনামটি। হলের কিছু নির্দয় ছেলে ওকে ঝন্টু থেকে জন্তু ডাকা শুরু করলো। নাম নিয়ে বাড়াবাড়ি বাঙালির পুরানো স্বভাব, যা ঝন্টুর মধ্যে ছিলো না। তাই শত ক্যাচাল করলেও ঝন্টু আমাদের বেয়াহাপনা পাত্তা দিতো না, বরং বসে বসে হাসতো আর মজা নিতো। হলে ওর সারা ঘরময় ছাড়ানো থাকতো গল্প, উপন্যাস, কবিতার বই, স্কেচ আঁকার ক্যানভাস, রঙ-তুলি, টু বি-ফোর বি কাঠ পেন্সিল, ভাঙ্গা কাঁচ, দেশ বিদেশের মিউজিকের সিডি, রাজ্যের সিনেমার ডিভিডি, পোস্টারসহ কত কি! দেয়ালে দেয়ালে থাকতো সত্যজিৎ রায়, অগোছালো চেহারায় চে, লেনিন, জিম মরিসন, পিঙ্ক ফ্লয়েড, মহীনের ঘোড়াগুলি, জন ডেনভার, স্করপিয়ন্স, হটার্স, সোলস, এরিক ক্ল্যাপটন, ডোরস, আর নির্ভানার পোস্টার।

‘একটা সিনেমা বানাবো আর সেটা অস্কার পাবে’— কিংবা একদিন এমন একটা গান লিখবো যে সারা পৃথিবীর সব দেশে সেই গান গাওয়া হবে। সেই গান শুনে সারা পৃথিবীর মানুষ একই সাথে হাসবে আর কাঁদবে। ডান হাতে তুড়ি বাজিয়ে প্রায়ই এমন বলতো ও। এসব কথা শুনে আমার বলতে ইচ্ছে করতো যে গান শুনে সবাই কাঁদবে আবার হাসবে সহজ অর্থে বলা যায় সেই গান পাগলের গান। সুস্থ, স্বাভাবিক শ্রোতারা কোনোদিন কোনো গান শুনে এমন করবে না। কিন্তু আমি বলতাম না, আমি তখন একটা টিউশনি বাদে আর কিছুই করি না। ঝন্টুর সাথে থাকলে খাবারের বিল দিতে হয় না, ক্যান্টিনে ওর নামে বিল তুলে খাওয়া যায়। চা, সিগারেটের দাম নিয়ে অন্যান্য সব ছেলেদের মতো ঝাড়ি খেতে হয় না বলে যেন কারণে অকারণে ওর কাছে একটু বেশিই আসি। ঝন্টুর ঘরে যখন তখন এসে ঘুমিয়ে থাকা যায়। শীতকালে হুট করে ঘুমিয়ে গেলে ঝন্টু গায়ে ভালো করে কম্বল মুড়ে দিয়ে যায়, সেই সাথে মাঝে মাঝে কম্পিউটারে অজানা কিছু ইন্সট্রুমেন্টাল প্লে করে। আমার মনে হয় আমি যেন বেহেস্তে আছি।

ঘরের উত্তর কোণে দীর্ঘদিন ধরে ঝন্টু একটা গোবদা সাইজের মাকড়শা পালে। একই অবস্থা বারান্দায়ও। হাজার বলেও পরিষ্কার করাতে পারি নি। কিছু বললেই বলে— ‘আরে বাদ দে, ব্যাটা আমার রুমমেট।’ বিয়ের সামিয়ানার মতো বিশাল এক জাল বিছিয়ে এক নির্বোধ মাকড়শার সাথে বসবাস ওর।

– চেইন রি-এ্যকশান বুঝলি? চেইনরি-এ্যকশান! যেমন মাকড়শাদের কথাই ধর, পুরুষেরা সংখ্যায় বেশি এদের, নারী খুব কম। আর রানী মাকড়শারা মিলনের পরপরই পুরুষ মাকড়শাকে মেরে ফেলতে চায়। ব্ল্যাক উইডো প্রজাতির মেয়ে মাকড়শা এমন করে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এরপর কী হয়, অন্যান্য পোকামাকড়ের মতো মাকড়শাও ডিম পাড়ে আর কোনো কারণে যাতে ওগুলো নষ্ট হয়ে না যায় সেজন্য ডিমগুলো সবসময় বহন করে মা মাকড়শা। প্রকৃতির নিয়মে একদিন ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়। এত বাচ্চার খাবার যোগাড় করা মাকড়শা মায়ের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। ক্ষুধার যন্ত্রণায় বাচ্চা মাকড়শাগুলো জন্মদাত্রী মাকেই খাওয়া শুরু করে দেয়। সময় যায়, মৃত মা পড়ে থাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে, মা-কে খেয়ে বেঁচে থাকা মাকড়শার দল আবার পায় মাতৃত্বের স্বাদ! কি অদ্ভুত তাই না?!

কিছুদিন পরেই ক্যাম্পাসের নাট্যদলের সাথে মিলে নাটক বানায় ঝন্টু। হুট করে একদিন জানতে পারি শর্ট ফ্লিম ফেস্টিভ্যালের কোন প্রতিযোগিতায় যেন সেকেন্ড হয়েছে ও, পুরস্কার পেয়েছে পঞ্চাশ হাজার টাকা। ভেতরে ভেতরে ঈর্ষায় পুড়তে থাকি আমরা অনেকেই। এই ঈর্ষা অক্ষমতার, এই ঈর্ষা আমাদের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কুড়ে কুড়ে খেতে থাকে আমাদের। আমি ঝন্টুর ঘরে যাওয়া কমিয়ে দিতে চাই, কিন্তু মাস শেষে হাত খালি হয়ে গেলে আবার পায়ে পায়ে চলে যাই সেদিকেই। মনে মনে ভাবি— ‘শালা, কুত্তার বাচ্চা একটা, নিজের ভালো নামের মতই চারিদিকে নন্দিত হইয়া যাইতেসে।’

একদিন মধ্যরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়, অপ্রকৃতস্থের মতো চোখ খুলে কোনোক্রমে ধাতস্থ হয়ে দেখি অন্ধকার ঘর, জানালা দিয়ে জোৎস্নার আলো ঠিকরে এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। আর ঝাঁকড়া চুলের ঝন্টু নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে জানালা ধরে। যেন বা ও অন্যকোনো জগতের প্রাণী। আমি ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বলি— পানি খাবো। ঝন্টু চমকে জানালা থেকে মুখ ফেরায়। পানির বোতল এগিয়ে দেয়, তারপর কিছুটা অপ্রস্তুত স্বরে বলে, সিগারেট খাবি?

আমি অন্ধকারে বসেই সিগারেট ধরাই। ঝন্টু হাতে গিটার নিতে নিতে বলে— জীবনটা অনেক ছোট না রে? মাঝে মাঝে খুব আফসোস লাগে, একদিন এই পৃথিবী থেকে চলে যেতে হবে। আমি ছোট্ট করে উত্তর দেই— হু।

শুনশান জোৎস্না ভরা রাতে ঝন্টু গান ধরে ‘তুমি আসবে আবার অন্যরূপে’…

ক্যাম্পাস বন্ধ হলে সেবার বেশ অনেক দিনের জন্য বাড়ি যাই। বাড়িতে আমার মা দু বেলা নিয়ম করে মুখে তুলে ভাত খাওয়ায় দেয়, ছোটবোনটা গোসলের আগে চুলে তেল মালিশ করে দেয়। মাঝে মাঝে বাবার হতাশাভরা মুখটা শুধু খুব পোড়ায়, বাদবাকি সময়টা দুর্দান্ত কাটে। সন্ধ্যা গাঢ় হয়ে রাত নামে। গভীর জ্যোৎস্না হয় আকাশে। বানের পানির মতো সে জ্যোৎস্না গড়িয়ে পড়ে বাড়ির উঠোনে। সে উঠোনে আমি চেয়ার পেতে বসে থাকি। বেনামী সব কষ্টে আক্রান্ত হই আর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শুনতে শুনতে ভাবি পৃথিবী এক অচিন গ্রহ। সেই গ্রহের আমি কেউ নই।

ঢাকা ফিরে এসে টের পাই এই ক’দিনে মাকড়শার জালের মতো এক রানী ঝন্টুকে ঘিরে ফেলেছে। সেই রানীর মায়াজালে ঝন্টুর ঘর তালাবন্ধ থাকে দীর্ঘ সময়। টঙের দোকানে উপস্থিতি কমে আসে ওর। রানীকে সন্তুষ্ট করার লোভে আমরা ওর অচেনা হয়ে যাই। আমি হরদম খবরের কাগজে ‘পড়াইতে চাই’, ‘গৃহ শিক্ষক চাই’— বিজ্ঞপ্তি মুখস্থ করতে থাকি। আমাদের মাঝে কেউ কেউ আবার তাদের জীবনের রানী খুঁজতে যায়। মরীচিকার মতো কেউ রানী খুঁজে পায়, কেউ বা পায় না। বন্ধুত্বের জাল ছেড়ে আমরা প্রত্যেকে কোনো না কোনো এক জালে আটকে যাই। আমরা, পরিবারের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেগুলো জীবনকে নিয়ত তাড়া করে বেড়াই।

২০৮ নাম্বার রুম থেকে মধ্যরাতে অনেক দিন হলো আর গানের সুর বেজে ওঠে না। ক্যাম্পাসের নন্দিত মুখটি এখন কেবল বিশেষ কারো কাছেই নন্দিত।

আমরা বাকিরা বেশ ভালোই আছি। অনেক রাতে ঘুম না এলে হেঁটে হেঁটে মাঠে চলে যাই। ঘাসের উপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুধু ভাবি— আমি কে? আমরা কে? আমরা কোথায়? কী যেন স্বপ্ন ছিলো আমাদের? ইশ্‌স্‌ বহুদিনের কুয়াশা কিংবা মাকড়শার জাল পরিষ্কার করে যদি জীবনটাকে স্বচ্ছভাবে দেখতে পারতাম। পৃথিবীর সব রহস্য সরিয়ে রেখে যদি খুব সরলভাবে একটা জীবন বাঁচতে পারতাম। যে জীবনে কোন শঙ্কা নেই, অনিশ্চয়তা নেই, হারানোর বেদনা নেই। জীবন মানে যেখানে শুধুই একটা জীবন। মায়ার জীবন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!