ফুলি চললো ফিলিমে –পূর্ণেন্দু পত্রী

দেবু তার মেজোবৌদিকে সুমিতার ঘরে ঢুকে সটান মেঝেয় শুয়ে,হাত-পা ছাড়িয়ে গড়াতে গড়াতে বললে-
দারুন গুড নিউজ আছে তোমার।সিনিমার নামার চান্স এসে গেছে তো—
সুমিতা সদ্য স্নান করে এসে আয়নার সামনে দাড়িয়ে মুখে ঘাড়ে একটু পাউডারের পাফ বোলাচ্ছিল।সিনিমার কোথায় ঠোটে লিপস্টিক ঘসতে ঘসতেই ঠোঁট উল্টে বলে-থাক,সাত-সকালে তোমাকে আর সিনিমার কথা বলে রসিকতা করতে হেব না।যখন বসয় ছিল,তখন কতো জায়গা থেকে ডাক এল,রাজি হল না কেউ,না তোমার দিগ গজ দাদা,না তোমার বাবা মা,আর এখন তিন ছেলের মা।এখন সিনিমার চান্সের খবর শোনাচ্ছ আমাকে—
তোমার কথা বললুম কখন?কথা তো শেষ করিনি আমি।
-তবে?
-তোমার ফুলির।
-ফুলি।বেড়াল আবার সিনিমায় নামে নাকি?
-কেন নামবে না?সিনিমায় সকলেই নামে।হাতি মেরা সাথিতে হাতি নামেনি?বর্ন-ফ্রিতে সিংহ নামেনি?তামিল-তেলেগু ছবিতে দেখবে,ছাগল,কুকুরদের রোল নায়ক-নারিকাদের চেয়ে বড়ো।সিনিমা তো কার কেনা সম্পত্তি নয়!সকলেই স্বাধীন অধিকার আছে এখানে নামার।মশা মাছি টিকটিকে সকলেরই এমন কি কাঁকড়া বিছেরাও।সোনার কেল্লা দেখনি?
কি জানি বাবা,আমি অত জানিনে।বিড়াল নামল কি গরু নামম অত নজর দিয়ে দেখিনি কখনো।আমরা হিরো হিরোইন ভিলেন-টিলেন দেখি,তাদের কথা মনে থাকে।মিথ্যে কথা বোলো না বৌদি!গত বছর একটা বাংলা ছবি তার নায়ক ছিল বাঁদর,দেখে এসে গদগদ হয়ে প্রশাংসা করছিলে?আহা!সেখানে তো বাঁদর টাই হিরো।হিরোরা বাঁদর হয়,সে তো অন্য কথা।
তোমার ফুলি যদি অন্য কোন ছবির হিরোইন হয়,আপত্তি নেই তো?আমার আপত্তি কি আছে?যে করবে তার সঙ্গে কথা বলবে তো আগে।এ্যাই ফুলিই-ই-ই,ও ফুলিমনি-ই —খাটের তলা থেকে আলস্য মাখানো গলায় ফুলি সাড়া দেয় খুব সংক্ষেপে।
-তোরছোড়দা কি বলছে শোন।
ফুলি পায়ের তলা থেকে ধিরে পায়ে বেরিয়ে এসে দেবুর সামনে গাঁ-ঝাড়া দিয়ে গায়ের আড় ভাঙে।লম্বা একটা হাইতুলে চোখ থেকে ঘুম তাড়ায়!তারপর ল্যাজ দিয়ে মেঝের উপরে বসার জায়গাটা ঈষৎ ঝেটিয়ে নিয়ে আধশোয়ার মতো ভঙ্গীতে বসে।
-কি বলছিলে?
-সিনিমায় নামবি?
-না!
কেন?
-ফিলিম খুব খারাপ জায়গা।স্বাভাব-চরিত্র নষ্ট হয়ে জায়।
-তাই নাকি?কি করে জানলি?
-লোকে বলাবলি করে।
-লোকে তো বলে তুই খুব পেটুক।তা লোকের কথা শুনে তুই কি চুরি করে খাওয়া ছেড়েছিস?
-আবার সেই খাওয়ার খোটা,দেখেছ মা!
ফুলি ঘুরে তাকায় সুমিতার দিকে।সুমিতা তখন ছোট ছলের দুধ বানানোর জন্য আমুলের টিন,জনতা স্টোভ,গেলাস,কেটলি ছাঁকনি চামচে ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত।আমুলের টিন খোলা মাত্রই সোজা হয়ে বসল ফুলি।সঙ্গে সঙ্গে গলা দিয়ে ফুটে বেরোল বিচিত্র একটা শব্দ।এর অর্থ সুমিতা আর ফুলি ছাড়া আর কেউ জানে না।সুমিতা পাঁচআঙুলের চিমটেয় কৌটো থেকে খানিক টা আমুল গুড়ো তুলে নিয়ে মেঝেয় ছড়িয়ে দেয়।ফুলি একটু একটু চাটে।দেবু অর্ধের্য হয়ে প্রশ্ন করে।কি রে নামবি কিনা বল,নইলে আমাকে অন্য যায়গায় যটে হবে।
বাড়িতে তো আরও অনেক বিড়াল আছে,তাদের নাম বল-না।
ওদের বাঁদর,তাঁদের বলার থাকলে কি আর তোর কাছে আসতুম!যারা ছবিটা করছে আর যে ছবিটা করছে তাঁদের তোর মতই একটা বিড়াল দরকার।চিত্রনাট্যে লেখা আছে-বেড়ালটি হবে আর্কিটাই-প্যাল।অর্থ্যাৎ বেড়াল জাতির প্রতিভু।দেখিলেই দর্শক বুঝিয়ে যাইবে।ইনিই সেই বিড়াল,যিনি মাঘের মাসি।
কেউ জোর করছো ছোড়দা,আমার মতো গায়ের রং আরও পাবে।সত্যি কথা বলছি,ফিলিম-টিলিম আমার তেমন পছন্দ নয়।দেখ না টিভিতে যখন ফিলিম হয়,ঘরে থাকি না,বারাণ্ডায় গিয়ে ঘুমাই।এটা তো ফ্রাইয়েড রাইস।
-তার মানে?
তার মানে জান না?এত লেখাপড়া জানো যে আর ফিলিম যে মিকসড,ফ্রায়েড রাইস সেটাই জান না।এই তো কদিন আগে দিল্লির যিনি কলকাতায় এসে,কলকাতায় যে চলচ্চিত্র উৎসব হবে তার কথা বলতে গিয়ে মা যে,ফিলিম হলো এমন একটি আট
যেখানে আপনি সব পাবেন।যাত্রা থিয়েটার,প্প-টপ,নাচ গান আর মারপিট।খুব হয়েছে তোকে আর বিদ্যে বমি করতে হবে না।এরপর কবে বলবি থিয়েটার হোল চিকেন চাউমেন,যাত্রা হোল বড় কাবাব।তাহলে তোর গরজ নেই?রাজি হতে পারি,তবে একটা শর্তে
-কি বল,
-ফিলিম বেড়ালদের জে-রকম দেখান হয়,সে রকম দেখালে চলবে না।বেড়াল সিনিমায় নামলে,তাকে বেড়ালের,মতোই দেখতে না হয়ে হরিণের মতো না ক্যাঙ্গারুর মতো হবে?
তাই বলছিস।স্বভাব চরিত্র কথা বলছি।ফিলিমে খুব হ্যানস্তা করা হয় তোমাদের।যেন বিড়ালের জাত টা চুরি কের খাওয়া আর কিছু জানে না।অথচ আমরা গেস্তের কতো কাজে লাগি—
কেন হেনস্তা করেছ তোমাদের?কবে?অনেকবার।ডিটেকটিভ ছবি হলেই বিড়ালের রং হয়ে যাবে কালো।সে যেন যমের চেলা।তোমরা পথের পেঁচালি,পথের পাঁচালি করে অতো নাচাও,অথচ সেখানেও আমাদের উপর কি না তুচ্ছ-তাচ্ছিল!সত্যজিৎ বাবুর মতো অতো বড়ো একজন গনিমান্যি পরিচালক কি করে যে আমাদের এক নাবালক জাত ভাইয়ের ঘাড়ের উপর ইন্দির ঠাকুরুনের ঐ নোংরা পুঁতিলিটা ছুড়ে ফেলেন,সত্যি ভাবতে লজ্জা হয়।নিতান্ত্য আমাদের কোনো ইউনিয়ন নেই-টিউনিয়ম নেই।থাকলে তুলকালাম হয়ে যেতো।অথচ দেখ ফরাসি পরিচালক রা কতো ভাল।ক্রফো লোকটা তার ঐ ডে ফর নাইটে কি চমৎকার করে বিড়ালটিকে খাওয়ালো।ফরাসীরা ছাড়া ফিলিমে আর বিড়ালদের মর্ম বোঝে না কেউ!আহা! বোদলেয়ারের কি মধূমাখা কবিতা বেড়াল-সুন্দরীকে নিয়ে।ওঃ কথা শুনতে শুনতে মাথা ধরে গেল।তাহলে রাজি আসিস তো?ধরে নাও আছি।কত দেবে?লো বাজেট নিউ ওয়েল নয় তো?দেবু উত্তর দিয়ে যাবে,এই সময় সেজ কর্তা এসে দাঁড়াল দরজায় সামনে বিষন্ন,এবং ক্রুদ্ধ।
বৌমা,তোমার ঐ ফুলিটা কোথায় বল তো!ওকে গুলি করবো।দেবু ঘুরে তাকিয়ে দেখে,সেজ কর্ত্তার চটি জুতোর চটর-পটর শুনেই কোন ফাঁকে জানল না গলে চম্পট দিয়েছে ফুলি।সুমিতার বদলে দেবুই প্রশ্নকরে-কেন,কি হয়েছ সেজকাকা?
সর্বনাশ করেছ আমার।ছানা কাটাবার গুড়ো কেনার খরচটা বাঁচানোর জন্য আমি একটা এক্সপেরিমেন্ট করেছিলুম এক জার্মান সাহেবের লেখায় ইনসপায়াড হয়ে।বৌদি কাছ থেকে এক জাম-বাটি দুধ এনে আমার ঘরের মেঝেয় রেগে তার ভিতরে মন্ত্রেলেখা একটা কাগজ,তানপুরার বাজতে বাজতে ছিড়ে যাওয়া জোয়ারির তার ডুবিয়ে বাথরুমে গেছি স্নান করতে।ফিরে এসে দেখি জাম্বার্টি ফাঁকা।সেই সঙ্গে মন্ত্রপূত কাগজ আর তানপুরার তার।আমার এক বছরের সাধ্না,গবেষনা,সব এখন ওর পেটে।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!