গল্প হলেও সত্যি। খুব ভয়ংকর ! ঘটনাটা যে কেউ শুনলে ভয় পাবে। আমি তাদের প্রায় দেখি। আমার বাসা থেকে সামনের দুই টা বিল্ডিং পর একটা দুতলা বাসা। বাসার সামনে খুব সুন্দর রঙের ল্যাভেন্ডার আর লিলি ফুলের সমন্বয়ে বাগান। জাপানিরা ফুল ভালবাসে। বাগান করা সম্পর্কে তাদের খুব সুন্দর জ্ঞান থাকে। ল্যাভেন্ডার ফুল এর বিচিত্রতা আর লিলি ফুলের নেশা করা ঘ্রান। আমি আমার বাসার বারান্দা থেকে কফি খেতে খেতে দেখি। ভদ্রলোক তার স্ত্রীকে অত্যন্ত যত্ন সহকারে লাল রঙের গাড়িতে তুলে। গাড়িটা মোড় নেওয়ার সময় আমার বাসার সামনে দিয়ে যায়। তাদের মনোযোগ ও আমার দিকে আসে। আসলে ব্যাপারটা না চাইলেও ঘটে। তারা একটু সৌজন্য হাঁসি দেয়। এই ব্যাপার গুলো ঠিক প্রথম দিকের ঘটনা। কয়েক মাস তার সাথের মহিলা কে দেখি না। ভদ্রলোক একা একা গাড়ি নিয়ে বের হয়। আবার কিছুদিন হয় আবার আগের দৃশ্য। সেই ভদ্রলোক তার স্ত্রীর সাথে গাড়ি নিয়ে কোথায় যেন যায়। যাওয়ার সময় আমাকে সৌজন্য হাঁসি দিয়ে যায়। কয়েক মাস আবার একই ঘটনা। এরই মধ্যে একদিন। আমার বাসার সামনে ডিনার বেল নামের চব্বিশ ঘণ্টা খোলা একটি বড় দোকান আছে। যেখানে সব সময় প্রয়োজনীয় সব কিছু পাওয়া যায়। সেখানেই ভদ্রলোক এর সাথে আচমকা কথা হল। সে একজন গবেষক এবং চিকিৎসক। সে ভাল ইংরেজি জানে। এখানে নতুন সবার জন্য জাপানিজ ভাষা কঠিন।আর জাপানিজরা ইংরেজি বলতে চায়না। কিন্তু সে খুব সুন্দর ইংরেজিতেই শুরু করল। তার বাবা বাংলাদেশি আর মা জাপানিজ ছিল। সে আমার বাড়িওয়ালার কাছ থেকে জেনেছে যে আমি বাংলাদেশি। তাই আমাকে সে দূর থেকেই আপন মনে করে। কথাটা শুনে আমার খুব ভাল লাগলো। আমরা আন্তরিক হলাম। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,তোমার সাথে যে সে কে ?
সে জানাল,আমার ওয়াইফ। সে চাইনিজ উইগুর জাতির মুসলিম।
আমি জানালাম আমিও মুসলিম।
সে হাসল। আমি জানতে চাইলাম তোমার বাচ্চা নেই। সে একটু অন্য মনস্ক হয়ে গেল।তারপর দীর্ঘশ্বাস দিয়ে জানাল,ছিল দুইজন। কিন্তু তারা বেঁচে নেই। আমি আর কথা বাড়ালাম না। তার স্ত্রীর সাথেও আমার বেশ আন্তরিক সম্পর্ক তৈরি হল। তার অল্প কিছুদিন যেতেই বুঝলাম কেমন যেন অদ্ভুত তার আচরন। হয়তো একটু খিঁচুনি রোগ আছে। সে ভাল শিক্ষিত। খুব সুন্দর কথা বলে। আর কেমন করে যেন গভীর ভাবে তাকায়। আর কিছুক্ষণ পর পর দাঁত কিট মিট করে খিঁচুনি দিয়ে উঠে। আমি মনে মনে একটু ভয় পাই। সেই ভদ্র মহিলার আচরন আমাকে ভাবাল। একদিন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,তোমাকে মাঝে মাঝে দেখিনা কেন?
সে হাঁসতে হাঁসতে বলল, আমি হারিয়ে যাই।
আমি কপাল কুঁচকালে,সে বলে আসলে আমি হাঁসপাতালে অনেকদিন সময় নিয়ে চিকিৎসা নিতে যাই।
আমি আর তাকে কিছু জিজ্ঞেস করিনা। মাঝে মাঝে বিকেলে এক সাথে হাঁটা হাঁটি করা,কফি খাওয়া। ভালই চলছিল। তখন রোজার মাস। জাপান এ সেহেরি শুরু হয় মধ্য রাতে। আমি সেহেরি তৈরি করছি।হঠাৎ কলিং বেল। আমার স্বামী দরজা খুলল। সেই ভদ্র মহিলা। আমাকে আমার স্বামী ডেকে জানাল তোমার বান্ধবী। আমি মনে মনে অবাক। কিন্তু কিছু বলতে পারলাম না। সে জানাল সে এখন হাঁটতে বের হয়েছে। আমি যেন তার সাথে যাই। আমি কি করব ঠিক বুঝতে পারলাম না। অনেকটা ভদ্রতার খাতিরেই তার সাথে বের হলাম। আর সাথে তার জন্য ইফতার নিলাম। জাপান খুব নিরাপদ। একটা ভরসা আছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম,তোমার স্বামী কোথায় ? সে জানাল ল্যাব এ গিয়েছে। তার একা একা লাগছে তাই সে আমার কাছে এসেছে। আমি তাকে সান্ত্বনা দিলাম। গবেষকদের জীবন এমনই। দিন রাত নেই। কোন নির্দিষ্ট ছুটি নেই। সে পথেই আমার দেওয়া ইফতারি খাওয়া শুরু করল। আমি বললাম বাসায় নিয়ে দুজনে খেয়ো। এমন অনেক কথা বলতে বলতে কখন যে ইসিকারি নদী পার হয়ে গেছি আমার জানা নেই। আমার বুকটা কেঁপে উঠল। জানিনা কেন জানি একটু ভয় ভয় লাগছিল। আমি বললাম আর যেতে হবে না। সেহেরির সময় শেষ হয়ে যাবে। আমার স্বামী রাগ করবে। সে কথাটা এড়িয়ে বলল। বাসার কাছেই আমরা। তোমার গলার লকেটটা কি বাংলাদেশি ?
আমার কিছু ভাল লাগছিল না। আমি বললাম হ্যাঁ,এবার চল। আমরা অনেকদূর চলে এসেছি।আমি জানি এটা ইসিকারি নদী। হঠাৎ সে আমার গলা টিপে ধরল। হয়তো মেরে ফেলার জন্য। খুব জোরে।আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। আমার হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেল। আমার রক্ত প্রবাহ থেমে গেল। আমি জানি না কতক্ষণ তার সাথে জীবন নিয়ে যুদ্ধ করেছি। তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে আমি শুধু দৌড়।হাঁপাতে হাঁপাতে বাসায় ফিরলাম। কোন শব্দ মুখ দিয়ে বের হলনা। নিজের কানে শুধু আমি আমার আতংকিত হৃৎস্পন্দন শুনলাম। কি ভয়াবহ ! কিছুক্ষণ পর মোবাইলে আজান শুনলাম। দুই তিন দিন পর। সে বাসা থেকে ভদ্রলোক একাই বের হচ্ছে। আমি সাহস করে নিচে নেমে জিজ্ঞেস করলাম,সে কোথায়। সে শান্ত ভাবে জানাল,হাসপাতালে। তার স্ত্রী আসলে মানসিক রোগী। তার দুই বাচ্চা কে সে নিজের হাতে মেরে ফেলেছে। কিংবা কোথাও ফেলে রেখে এসেছে। তার জানা নেই। আমার ভিতরের ভয়াবহ আতংক আরও বেড়ে গেল।আমি আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। কারন বিপদজনক মানুষ আর ঘটনা যত জানব ততো বেশি নিজের চেনা জগত বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে।মানুষের মতো হলেও সবাই মানুষ না। অদ্ভুত ভয়ংকর কিছু। খুব ভয়ংকর!
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।