বাইরে তখন বৃষ্টি পড়ছিল। মা শেয়াল তার একপাল ছানাপোনা নিয়ে বসে আছে গুহার ভিতর। মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাঁট এসে ঢুকছিল গুহার ভিতর। কারণ গুহাটা খুব একটা বড় নয়। কোনো রকমে ঠেলেঠুলে ওরা ছয়টা প্রাণী আশ্রয় নিয়েছে। মা শেয়াল বসেছিল গুহার একেবারে মুখের কাছে, যাতে বৃষ্টির পানি ছানাদের গা ছুঁতে না পারে। ঝম ঝম বৃষ্টি। মা শেয়ালের খুব ইচ্ছে করছে ছানাদের একটা গল্প শোনায়। একেবারে খাঁটি আষাঢ়ে গল্প। কিন্তু আষাঢ়ে গল্প কী ছানারা তো আর সেটা জানে না। গল্প বলার জন্য শেয়ালের মনটা বেশ উসখুশ করছে। কোনো ছানাই তো বলছে না, মা একটা গল্প শোনাও। কী দিনকাল পড়েছে! শেয়ালের মনে আছে, যখন সে ওদের মতো ছোট্টটি ছিল, তখন গল্প শোনার জন্য প্রায়ই মায়ের কাছে আবদার করত। আর ওদের মা তখন গল্প শোনাত। রাজ্যের গল্প জানত ওর মা শেয়াল। পুরো বনের সব গল্পই যেন ওর মায়ের জানা ছিল। বনের আশপাশে যে লোকালয়, সে লোকালয়ের কিছু গল্পও জানত। ও অবশ্য লোকালয়ের কোনো গল্প জানে না।
ঝড়ো বাতাসে বৃষ্টির ছাঁট এসে আছড়ে পড়ল মা শেয়ালের হলদেটে চামড়ায়। যেন ঘোর ভাঙল মা শেয়ালের-এমনভাবে চমকে ওঠল। তারপর বলল, ছানারা আরেকটু গুটিসুটি মারতো দেখি। তোদের মা তো একেবারে ভিজে যাচ্ছে। আরেকটু ভিতরে ঢোক। তারপর একটা ছানার দিকে তাকিয়ে বলল, “এই তুই এত পা ছড়িয়ে আছিস কেন রে, গুটিসুটি মেরে থাক। লেজ দিয়ে শরীরটা ঢেকে নে। ঠাণ্ডা লাগবে না। বুঝেছি তোদের আলসেমি পেয়ে বসেছে। আচ্ছা ঠিক আছে আলসেমি কেমন করে ছাড়াতে হয় আমি জানি। ছাড়াবো?”
ছানাদের মধ্যে তেমন একটা উৎসাহ দেখা গেল না। কেবল একটু নড়েচড়ে বসল ছানারা।
মা শেয়াল বলল, “তাহলে তোদের একটা গল্পই শোনাই। বনের রাজাকে তো তোরা চিনিস। জানিস আমাদের বনের রাজা কে?”
ছানারা মাথা দুলিয়ে জানাল, ওরা জানে না।
মা শেয়াল জানাল, “নেকড়ে। নেকড়েকে চিনিস তো? ঠিক আছে তোদের একদিন চিনিয়ে দেবো। কিন্তু নেকড়ে কখনো রাজা হয় শুনেছিস? আমিও শুনিনি। এই বনের বরাতটাই খারাপ। এই বনে না আছে কোনো বাঘ, না আছে কোনো সিংহ। অবশ্য হাতি আছে। কিন্তু হাতিরা রাজা হতে চায় না। একবার একটা হাতি রাজা হয়ে চেয়েছিল। বনের সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান আর বড়প্রাণী হচ্ছে হাতি। সে রাজা হতেই পারে। হাতি যখন রাজা হতে চাইল, তখন কেউ তার বিরোধিতা করল না। তবে একটা প্রশ্ন থেকে গেল, হাতি কেন রাজা হবে?”
কথাটা বলেই ফেলল একটা গিরগিটি। রাজা বানানোর অনুষ্ঠানে সে জানাল, “হাতি তো কোনো প্রাণী ধরে ধরে খায় না। কাজেই রাজা হওয়ার যোগ্যতা তার নেই। দ্যাখো না রাজা হয় বাঘ নয়ত সিংহ। কারণ ওরা বনের পশু খেতে পারে। রাজা যদি বনের প্রজা ধরে খেতে না-ই পারে, তাহলে সে কিসের রাজা? তার দাপট আর থাকল কই?”
খাবারের কথা বলায় এবার গল্পটায় বেশ উৎসাহ পেল ছানাগুলো। ওরা এতক্ষণ খোঁচাখুচি করছিল। এখন চুপচাপ হয়ে গেল। মনোযোগ দিয়ে শুনতে লাগল গল্প।
একটা ছানা বলল, “তাহলে একটা শেয়ালকেই রাজা করে দিত। শেয়াল তো বনের প্রজা খায়।”
মা শেয়াল বলল, “তা যা বলেছিস বাছা। শেয়াল তো খায় মুরগি। বনের প্রজা হলে কী হবে, মুরগি তো কোনো পশু নয়। ওটা হচ্ছে পাখি।”
আরেকটা ছানা বলল, “আমরা কতদিন মুরগির হাড় চিবোই না। কবে চিবোবো মা? এই বৃষ্টিতে মুরগির হাড় চিবোতে চিবোতে গল্প শুনতে যা দারুণ লাগত!”
মা শেয়াল বলল, “অতো দুঃখ করিস না বাছা আমার। তোদের তো বলেছি কয়েকটা দিন সবুর কর। বার্ডফ্লু চলছে। এখন মুরগির হাড় চিবোনো মানে একেবারে শেষ। এখন মুরগির হাড় চিবোনো মানে শেয়ালদের অসুখ। এই অসুখে দেখা যাবে একসময় দুনিয়া থেকে শেয়ালরা হারিয়ে গেছে চিরতরে। তখন বনের গল্পগুলোর কী হবে একবার ভেবে দেখেছিস? শেয়াল ছাড়া বনের গল্প আর কার কাছ থেকে পাওয়া যাবে? তারপর কী হলো বলছি শোন।”
আবার গল্প বলতে শুরু করল মা শেয়াল।
গিরগিটির কথা শুনে কুমির বলল, “তা তো ঠিকই। বনের রাজা একটু পেটুক হওয়াই ভালো। তাহলে তো আমাকেই রাজা বানাতে হয়। আমি কিন্তু মহা পেটুক। সুযোগ পেলে বাঘ-সিংহকেও খেয়ে ফেলতে পারি।”
বলদ বলল, “না। সেটা কোনোভাবেই হয় না। রাজা হবে এই বনের প্রাণী। জলের কোনো প্রাণী রাজা হতে পারবে না।”
কুমির জানতে চাইল, “কেন? নদী কি বনের কোনো অংশ নয়? বনের প্রাণীরা নদীর পানি পান করে না?”
বলদ বলল, “তা করে। কিন্তু ডাঙার প্রাণী ছাড়া বনের রাজা মানায় না।”
সব প্রাণী বলদের কথায় সায় দিল। ঠিক ঠিক। রাজা হওয়ার সুযোগটা নষ্ট হলো কুমিরের। রাগে ক্ষোভে দুঃখে লেজটাকে আছড়াতে ইচ্ছে করছিল ওর তখন। কিন্তু ডাঙায় সত্যি সত্যি লেজ আছড়ানো অসম্ভব। তবে বেশ মন দিয়ে ও বলদটাকে দেখল। আর মনে মনে ভাবল, যদি কখনো সুযোগ পায়, তাহলে বলদটাকে খেয়ে ফেলবে। প্রায় বলদটাকে খাল পাড়ি দিতে দেখেছে ও। দরকার হলে নদী ছেড়ে খালে এসে আশ্রয় নেবে ও।
নাহ্! একটা রাজা ওদের দরকার। এবার ওরা বুঝতে পারছে বাঘ আর সিংহ না থাকলে কী অসুবিধে হয়। সবাই তখন চুপ করে ভাবছিল কী করা যায়?
হাতি আবারও বলে ওঠল, “দ্যাখো, আমাকেই রাজা বানাও তোমরা। আসলে প্রজাখেকো রাজা দেখে দেখে অভ্যাস খারাপ হয়ে গিয়েছে তোমাদের। এবার একজন নিরামিষভোজীকে রাজা বানিয়ে দ্যাখো।”
রাজা হওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় ছিল নেকড়ে। সুযোগ বুঝে বলল, “কী এমন যোগ্যতা আছে তোমার রাজা হওয়ার?”
হাতি বলল, “চল দুজন মিলে লড়াই করি। সবাই দেখুক। কার যোগ্যতা বেশি। তোমার না আমার?”
এবার দমে গেল নেকড়ে। কিন্তু বনের পশুদের ভাবনার মধ্যে ফেলে দিল ওর কথাটা। দু একজন বলেই ফেলল, “সত্যিই তোমাকে রাজা হওয়ার মতো যোগ্যতা দেখাতে হবে।”
হাতি বলল, “কী যোগ্যতা দেখতে চাও? ওই যে বিশাল বড় বটগাছ দেখতে পাচ্ছ, ওটাকেও শুইয়ে দিতে পারি আমি। পারবে তোমরা কেউ?”
কিন্তু ওখানে যেসব পশু আর পাখি ছিল, ওরা আসলে অন্য কিছু দেখতে চাইছিল। দেখতে চাইছিল ওদের রাজার এমন একটা বিশেষ গুণ থাকবে, যা নিয়ে ওরা অন্য বনের প্রাণীদের সাথে রাজা নিয়ে গর্ব করতে পারে।
একটা বনমোরগ ছিল ওখানে। বনমোরগ বলল, “তুমি যদি ডিম পাড়তে পারো, তবেই বুঝব তোমার কেমন যোগ্যতা আছে রাজা হওয়ার।”
মনে হল বিশেষ একটা গুণের হদিস পাওয়া গেছে। উপসি’ত সবাই হইহই করে ওঠল বন মোরগের কথা শুনে। এবং সবাই বলল, “ঠিক ঠিক। তোমাকে ডিম পেড়ে দেখাতে হবে।”
অবাক হলো হাতি।
অবাক হলো শেয়ালছানারা। যারা মুগ্ধ হয়ে গল্প শুনছিল। বৃষ্টিটা ততক্ষণে ধরে এসেছে। কিন’ ওদের সেদিকে নজর নেই।
একটু দম নিয়ে মা শেয়াল বলল, “হাতি অবাক হয়ে তখন বলল, হাতিকে ডিম পাড়তে কেউ কোনোদিন দ্যাখেনি। কাজেই হাতি কেন ডিম পাড়বে?”
বনের পশুরা তখন রাজা নিয়ে বেশ মজায় মেতে উঠেছে। ওদের কাছে রাজা বানানোটা তখন দারুণ এক মজার খেলা। ওরা হইহই করে বলল, “তা হবে না। ডিম পাড়তে না পারলে রাজা হওয়া যাবে না।”
হাতি বলল, “ঠিক আছে। আমাকে সময় দিতে হবে।”
বনমোরগ জানতে চাইল, “ক’দিন?”
হাতি জানাল, “সাতদিন।”
এরপর ঠিক হলো সাতদিন পরে যদি হাতি ওদের ডিম পেড়ে দেখাতে পারে, তাহলে ওকেই সবাই রাজা বলে মেনে নেবে। কারো মধ্যে রাজা না হওয়ার কষ্ট আর থাকবে না।
সভা শেষ হওয়ার ঠিক আগে হাতি জানাল, “সবার কথা মতো ডিম পাড়বো আমি ঠিকই, কিন্তু ডিম পাড়ার পর আবার ডিম থেকে হাতির ছানা ফোটানোর কথা বলবে না তো কেউ? কারণ ডিমে তা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
সবাই জানাল, “না, না। ডিম পাড়তে পারলেই হবে।”
এটুকু বলার পর আবার থামল মা শেয়াল। জানতে চাইল ছানাদের কাছে, “গল্প শুনতে কেমন লাগছে তোদের?”
ছানারা বলল, “খুব ভালো। তারপর কী হল? হাতিটা ডিম পেড়েছিল?”
মা শেয়াল বলল, “তারপর সাতদিন পর হাতিটা সবাইকে ডেকে নিয়ে গেল একটা খোলা মাঠে। ওই মাঠে তখন হরিণরা ঘাস চিবোচ্ছিল। বনের অনেক পশু আর পাখি হাতির ডিম দেখতে হাজির। সবাইকে ওই মাঠে অপেক্ষা করতে বলে হাতি কোথায় যেন চলে গেল। একটু পর দেখা গেল ইয়া বড় একটা ডিম ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এসেছে হাতিটা। ডিম দেখে তো সবাই অবাক। অনেকে বিশ্বাসই করতে চাইল না। সবাইকে ডিম ধরে ধরে দেখতে বলল হাতি। তা না হয় দেখবে, কিন্তু হাতি ডিম পেড়েছে এমন ঘটনা কে কবে শুনেছে, কে কবে দেখেছে?”
হাতি সত্যি সত্যি ডিম পেড়েছে শুনে শেয়ালছানারাও অবাক। একটা ছানা বলল, “হাতি কি সবার সামনে ডিম পেড়েছে?”
মা শেয়াল বলল, “সবার সামনে ডিম পাড়বে কেন? কোনো পাখি কি কারো সামনে ডিম পাড়ে? পাড়ে না। ওরা আড়ালেই ডিম পাড়ে। কিন্তু ওই ডিমটা যে ওই পাখির সেটা তো আর অবিশ্বাস করা যায় না। যায়?”
মায়ের কথা শুনে মাথা নাড়ল ছানারা, “না।”
মা শেয়াল বলল, “হাতির ডিম নিয়েও কারো সন্দেহ ছিল না। তবে ডিমটা ছিল বেশ ভারি। এত ভারি ডিম কেমন করে পাড়ল হাতি কে জানে? এত ভারি আর এত বড় ডিম হাতি ছাড়া আর কারো পক্ষে পাড়াও সম্ভব নয়।”
ছানারা আবার জানতে চাইল, “তাহলে হাতিটাই হয়েছিল বনের রাজা?”
মা শেয়াল বলল, “না। হাতি যদি বনের রাজা হতো, তাহলে নেকড়ে রাজা হলো কেমন করে? একটা বনে তো আর দু’টো রাজা থাকতে পারে না। পারে?”
ছানার জানতে চাইল, “কিন্তু সেটা কেমন করে হলো? সবাই তো বলল, ডিম পাড়লেই হাতি হবে রাজা।”
মা শেয়াল বলল, “বলেছিল। সবাই হাতিকে রাজা হিসেবে ঘোষণা করবে, তার আগেই নেকড়ে বলল, বনের রাজা হবে কোনো পশু। কোনো পাখি নয়। ডিম পেড়ে হাতি প্রমাণ করে দিয়েছে সে একটা পাখি। একটা পাখি কোনোভাবেই রাজা হতে পারে না।
ব্যস। লেগে গেল হইচই। সবাই বলল, ঠিক, ঠিক। রাজা হতে না পেরে হাতিটার অবশ্য মন খারাপ হয়েছিল একটু। কিন্তু ডিম পাড়ার আনন্দও পেয়েছিল ও। ডিম পেড়ে যে আনন্দ ও পেয়েছিল, রাজা হয়েও এত আনন্দ পেত না। এরপর রাজা হয়ে গেল নেকড়ে।”
গল্প শেষ। বৃষ্টি থেমে রোদ উঠে গেছে। আর গুহায় গুটিসুটি মেরে বসে থাকা যায় না। ছানাদের নিয়ে গুহা থেকে বেরিয়ে গেল মা শেয়াল। তাকাল আকাশের দিকে। একটু মেঘও নেই। আষাঢ়ে আকাশ। এই রোদ এই বৃষ্টি। কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আষাঢ়ে গল্পের যেমন কোনো ঠিকঠিকানা নেই।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।