স্বপ্ন

স্বপ্নকে আরবিতে হিলমুন, ফার্সিতে খাব এবং ইংরেজিতে ড্রিম বলে। সজাগ থেকে স্বপ্ন দেখা যায় না। আমরা ঘুমিয়ে যা দেখি তা স্বপ্ন নয়, বরং যা আমাদের ঘুমোতে দেয় না তাই স্বপ্ন। সবাই স্বপ্নপ্রেমি। সবাই স্বপ্ন দেখতে বড্ড ভালোবাসি। কেউ কেউ স্বপ্ন দেখাতে আবার বেশ ভালোবাসেন। স্বপ্নরাজ্য কারো পৈত্রিক সম্মতি নয়। এখানে কারো বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন চলে না। যে যার মত করে স্বপ্ন দেখবে তাতে কারো নাক গলানো জায়েয হবে না।
নির্জন-নিরিবিলি, জনমানবহীন একটি পরিবেশের নাম ‘স্বপ্নরাজ্য’। শব্দ নেই। নেই কোনো চেচামেচির আওয়াজ। পাখির গান নেই। নেই নদীর কলতান। বাঁধ ভাঙ্গার উল্লাস আর উচ্ছাসে মেতে উঠার জন্য মানানসই এক জায়গার নাম স্বপ্নরাজ্য। এখানে সবার পদচারনা উন্মোক্ত। সমানভাবে, সমান তালে, নেচে-গেয়ে, হেলে-ধুলে বেড়াবার জন্য এক মনমুগ্ধকর পরিবেশের নামই হচ্ছে স্বপ্নরাজ্য।
স্বপ্নরাজ্য ভ্রমন করতে লাগে না কোনো যান। ধরতে হয় না কোনো বান। সাথে রাখতে হয় না ভ্রমন টিকিট। স্টেশনে স্টোপিজেরও নেই কোনো ঝামেলা। দালালরাও নেই এখানে। রাস্তাঘাট নিরাপদ থাকায় যে যার মত করে ভ্রমন করে। স্বপ্নরাজ্য চায় সবাই হাফ ছেড়ে রাজ্যটা দেখুক। ইচ্ছেমতো প্রাণখুলে ভ্রমন করুক। অলটাইম ওপেন থাকে রাজ্যের সবক’টি ফটক। দারওয়ান নেই। নেই কোনো চেক পোস্ট। বাঁধা নেই সাথে কিছু নিতে, না নিলেও চলে।
সবার মতো আমার মা বাবারাও স্বপ্ন দেখেছিলেন আমাকে নিয়ে। স্বপ্নকে বাস্তবে রুপ দিতে যারপর নাই কষ্টও করেছেন। সকল ব্যান্তি ভুলে গিয়ে, সকল গ্লানি মুছে ফেলে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। সকল আরাম-আয়েশ ভুলে গিয়ে বিরতিহীন যাত্রা শুরু করেছিলেন স্বপ্ন রাজ্যে। স্বপ্ন রাজ্যের উর্বর জমিতে বীজ বপন করেছিলেন তারা। এর সঠিক পরিচর্যা করতে গাফলতি করেননি কখনো। হামেশা স্বপ্নকে আমার জন্য নিজের মতো করে আগলে রেখেছেন। আমি মা-বাবার স্বপ্নকে বাস্তবতার তুলি দিয়ে রং করতে থাকি। তাদের স্বপ্নকে নিজেরে স্বপ্ন ভেবে বুকে জড়িয়ে রাখি।
স্বপ্ন দেখেছিলেন আমি আলেম হবো। কুরআন-সুন্নাহর আলোয় নিজে আলোকিত হবো, দেশ ও জাতিকে আলোকিত করবো। সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল মা বাবা দুনিয়া থেকে বিদায় নিলে আমি জানাযা পড়াবো। যাইহোক স্বপ্ন রাজ্যে আমার ভ্রমণ শেষ হওয়ার আগেই বাবা বিদায় নিয়ে গেলেন পরপারে। তাঁর স্বপ্নটা আমি পূরণ করতে পেরে নিজেকে সামান্য হলেও খুশি করতে পেরেছি। তবে আমি যে খান্দানে জন্মেছি তাতে আলেম-হাফেজ, মুল্লা-মুন্সি বলতে কেউই নেই। সবাই সেকেলে মনোভাবের লোক। এখন একেলে হয়ে গেছেন সবাই। ফ্যামেলির সবাই মক্তবে গিয়ে কায়দা-সিপারা, নামায-রোযা শিখেছেন ঠিক কিন্তু এর যথাযথ চর্চা নেই। তাবলিগ জামাতের নবিওয়ালা কাজের ধারাবাহিকতার বদৌলতেই আমাকে নবীজির দ্বীনের বাগানে দিয়ে স্বপ্নরাজ্যে ভ্রমন শুরু করেন। কচিকাচার মতো হাটিহাটি পা-পা করে চলতে শুরু করার পর বাবা চলে গেলেন না ফেরার দেশে।৪৫৪৫ পড়ঢ়ু
হাজারো শুকরিয়া সেই সে প্রভুর যিনি আমাকে নিজ মা বাবার স্বপ্ন পুরণের মতো একটি কাজ করার চেষ্ঠার সুযোগ করে দিয়েছেন। বাবার নামাযে জানাযা সেই স্বপ্নরাজ্যে ভ্রমনকারী ছেলে পড়াতে পেরেছে। তাঁর ইন্তেকালের বছর তিনেক পর ছেলেটি মাদরাসার সর্ব্বোচ্চ ক্লাস কৃতিত্বের সাথে পাশ করেছে। মাথায় পাগড়ি পড়েছে। জাতিকে সুষ্টভাবে পরিচালনার যিম্মাদারী, নবিওয়ালা কাজের গুরু ভার কাঁধে অর্পিত হয়েছে তার।
কিন্তু বাবার আসল স্বপ্ন, স্বপ্নই রয়ে গেল। আত্মিয়তার আত্মঘাতিতে আর স্বজনপ্রীতির রাহুগ্রাসে চুরমার হয়ে গেল সেই স্বপ্ন। মা বাবর বংশীয় সিলসিলায় কেউ আলেম-উলামা না থাকায় স্বপ্নরাজ্যের সিঁড়ি বেয়ে পৌছা গেল সম্ভব হলোনা মাকসুদে মানযিলে। বাবার স্বপ্নকে বাস্তবতার তুলি দিয়ে রং করা শেষ হবার আগেই ফুরিয়ে গেল কালি। তুলির আগায় মুছড়ানো সবগুলি কেশ এলোমেলো হয়ে করে দিল সব শেষ।স্বপ্নরাজ্যে ভ্রমনটা আরামের হয়নি। হয়নি আমার মনমতো। চাহিদা মাফিক ঘুরতে পারিনি আমি। তাতে একটুও দুঃখ নেই মনে। তবে মাঝে মধ্যে জীবন পাতার গায়ে চোখের জল যে ভাসে। কেউ দেখার আগে মুছে ফেলি দু’নয়ন। বুক ফেটে যায় স্বপ্নরাজ্যে বপন করা বীজ গুলোর জন্য। আজ হয়ত সেগুলো বড় হয়ে সবুজ পাতাওয়ালা হয়ে যেতো। আসলে সবার জন্য সব স্বপ্ন দেখা জায়েয নয়। আকাশ-কুসুম স্বপ্ন দেখার আগে ভেবে নেয়া উচিত যে এটা কি আমার জন্য দেখা ঠিক হবে। এই স্বপ্নকি বাস্তব হয়ে আমাকে ধরা দেবে। স্বপ্নের অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ নিয়ে ফিকির করা উচিত।
স্বপ্ন তুমি কার? আসলেই কি তুমি সবার। নাকি অনেকের ক্ষেত্রে মুখ ফিরিয়ে নেয়া তোমার অভ্যাস। স্বপ্নরাজ্য! ক্ষমা করো আমায়। দীর্ঘ দিন তোমার রাজ্যে আমি হতভাগা বিচরন করেছি। চলার পথে ভুল-ক্রটি হতে পারে। তাই ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ জানাই। পরিশেষে বাবাকে বলি তুমি যে স্বপ্ন দেখে ছিলে আমায় নিয়ে। আমিও হেটে ছিলাম স্বপ্নরাজ্যে তোমার কথা ভেবে। নিয়তির এ নির্মম পরিহাস। তোমার দেখা স্বপ্ন আর আমার চলা স্বপ্ন ভুমিতে সফলতা ধরা দেয়নি আমাকে। ক্ষমা করো নিজ গুণে। যা হবার তা হতে পারিনি বলে। তবে কলমের কালি দিয়ে স্বপ্নরাজ্যে ভ্রমনের কথা লিখতে পেরেছি। এটাই বোধহয় স্বপ্নরাজ্যে ভ্রমনের নির্যাস। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমার বাবার আত্মা আমার জন্য দোয়া করবে যাতে আমি লিখনী ময়দানে নির্ভীক সৈনিকের মতো ঝাপিয়ে পড়তে পারি।
–লেখকঃ সম্পাদক, লালসবুজ সাহিত্য সাময়িকী

দুঃখিত!