হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর কুবায় উপস্থিতি
কুবা মদিনার বহিরাঞ্চলে বা উপকণ্ঠে অবস্থিত। সেখানে বনী আমর বিন আউফের লোকেরা তখন বসাবস করত। তাঁরা পূর্বেই মক্কায় যেয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর শুভাগমনের সংবাদ পেয়ে তারা প্রত্যেক দিন মক্কার পথে মরুপ্রান্তে প্রখর সূর্যের তাপে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতেন। দ্বিপ্রহর পর্যন্ত প্রচণ্ড রৌদ্রের তাপে মরুপ্রান্তের উত্তপ্ত বালুকা রাশিতে দণ্ডায়মান থেকে বাড়ী ফিরতেন। আজও তাঁরা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। এমন সময় জনৈক ইহুদী স্বীয় গৃহের ছাদ হতে হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আগমন পথে বহুদূরে তার দৃষ্টি সাদা পোশাক পরিহিত সে ক্ষুদ্র কফেলার উপর পড়ল। রাসূল (সাঃ)-এর পরনে তখন হযরত জোবায়ের কর্তৃক প্রদত্ত সাদা কপড়টি ছিল। তখন ইহুদী চিৎকার করে বলল, হে আরবগণ! যার অপেক্ষায় তোমরা দিন গুনছিলেন তিনি ঐ যে আসছেন।
তখন প্রচণ্ড রৌদ্রের তাপ, অগ্নিকণার ন্যায় অসংখ্য বালিকারাশি ভীষণ উত্তপ্ত। মানুষ, গরু, পশুপক্ষী এহেন অগ্নি তাপে বের হতে সাহস পাচ্ছেন না। এমন সময় ছরওয়ারে কায়েনাত মরু-সমুদ্রের মরীচিকা তরঙ্গ ভেদ করে অগ্রসর হচ্ছেন। আনছারগণের কর্ণে এ শব্দ পৌছা মাত্র তারা নতুন জীবন লাভ করল। মরু প্রান্তরের এক প্রান্তে একটি খেজুর বৃক্ষ ছিল। হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ঐ বৃক্ষের ছায়ায় অবতরণ করলেন। লোকজন ছুটে সেখানে উপস্থিত হল। আনন্দের ঢেউ সকলের অন্তরে প্রবাহিত হতে লাগল। সেখানে হযরত আবু বকর (রাঃ) মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন দেখে অনেকেই মনে করল তিনি রাসূল (সাঃ)। কিন্তু পরে বুঝতে পারল যে, রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয়জন। সেখান হতে বনী আমর বিন আউফের কবিলায় কুলছুম বিন হাদমের গৃহে উপস্থিত হলেন। লোকজনের ভীড় জমতে লাগল। সে গৃহটি ছোট ছিল। তাই পার্শ্ববর্তী ছায়াদ বিন হায়ছামার গৃহে লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ দেয়ার স্থান নিযুক্ত করা হল। সারা মদিনায় আনন্দের ঢেউ প্রবাহিত হতে লাগল।
হযরত আলী (রাঃ) মক্কার কোরাইশগণের আমানত মালিকের হাতে সোপর্দ করে তিনদিন পরে এখানে এসে রাসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে মিলিত হন। বনী আমের রাসূলে পাক (সাঃ) ১৪ দিন অবস্থান করেন। এখানে কুলছুম বিন হাদমের খেজুর শুকাবার স্থানে তার অনুমতিতে ইসলামের প্রথম মসজিদ স্থাপন করা হয়। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নিজেই পাথর উঠিয়ে তার ভিত্তি স্থাপন ও নির্মাণ কার্য সমাধান করেন। এ মসজিদেই শুক্রবারে জুমার হুকুম নাজিল হয় এবং তা প্রথম জুমা। কেউ কেউ বলেন, এ মসজিদটিই মসজিদে কুবা নামে পরিচিত এবং এখানেই কিবলার পরিবর্তন হয়েছিল এবং তাকেই মসজিদে কিবলাতাইন বলা হয়।
রাসূল (সাঃ)-এর শুভাগমন দেখতে পেয়ে মহিলা ও বালক বালিকার দল আনন্দে উৎফুল্লাহ হয়ে তাঁর এক নজর দেখার জন্য ছাদের উপর উঠে গেলেন। বন্যার স্রোতের ন্যায় মানুষ চতুর্দিক হতে ছুটে আসল। যখন বালক বালিকাগণ নূর নবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জ্যোতির্ময় চেহারা দর্শন করল তখন তারা আনন্দে আত্মহারা হয়ে আরবী কাছীদা পাঠ করতঃ তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে লাগল। হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-মসজিদে বনী ছালেমার মধ্যে শুক্রবার জুমার নামাজ আদায় করার পর মতান্তরে মসজিদে কুবার মধ্যে জুমা পড়ে উটনীতে ছওয়ার হলেন। তাঁর উটনী ডানে বামে নজর করতে লাগল। প্রত্যেক কবিলা তাদের প্রাণে রাসূলকে অতিথিরূপে গ্রহণ করার আবেদন জানালেন। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোথায় অবতরণ করবেন? আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বললেন, যেখানে আমার উট থেমে যাবে সেখানেই অবতরণ করব। তাঁর উট হযরত আবু আইয়ুব আনসারীর গৃহে যেয়ে বসে পড়ল এবং তিনি সেখানে অবতরণ করলেন।
রাসূল (সাঃ) কোসওয়া হতে অবতরণের পর হাওদা নামাতে আদেশ দিলেন। হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) হাওদা নামিয়ে নিজ বাসভবনে রেখে বললেন, এ গৃহে আপনার হাওদা। রাসূল (সাঃ)-এর নিকট আনসারগণ সকলে স্ব স্ব অবস্থান ও আতিথ্য গ্রহণের আবেদন জানালেন, এমন কি পরস্পর কলহের সৃষ্টি হল। তিনি আনসারগণকে স্বভাব সূলভ মধুর ভাষায় সন্তোষজনক উত্তর দানে বিদায় দিলেন।
হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ)-এর গৃহ দ্বিতল ছিল। তিনি রাসূল (সাঃ)-কে বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সাঃ)! আপনি দ্বিতলে থাকেন। আমাদের যাতায়াতের সময় ধুলি উড়ে আপনার উপর পড়তে পারে, আপনার নিকট জিব্রাইল (আঃ) আবির্ভূত হন এবং ওহী অবতীর্ণ হয়। এ অনুরোধ সত্ত্বেও সাক্ষাৎ প্রার্থীদের সুবিধার্থে তিনি নিচ তলায় থাকাই পছন্দ করলেন। গৃহস্বামী রাসূল (সাঃ)-এর সম্মুখে খাদ্য উপস্থিত করতেন এবং দম্পতিদ্বয় বরকত লাভের আশায় পমরানন্দে ভূক্ত বিশিষ্ট গ্রহণ করতেন। পাত্রের সে দিক হতে তিনি আহার্য গ্রহণ করতেন। তারাও সেদিক হতে আহার শুরু করতেন। এক রাত্রি যথারীতি আহার্য প্রেরিত হল। তাতে কাঁচা রসুন কিংবা পিঁয়াজ দেয়া হয়েছিল।
রাসূল (সাঃ) তা ফেরত দিলেন। হযরত আবু আইয়ুব আনসারী (রাঃ) তাতে হস্ত চিহ্ন দেখতে না পেয়ে ব্যাকুলভাবে ছুটে এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (সাঃ)! আমার মাতা-পিতা আপনার জন্য কুরবান হউক; আপনি আহার্য ফেরত দিয়েছেন, তাতে আপনার মুবারক হস্তের কোন নিশানা নেই। তিনি বললেন, তাতে মসলার অরুচিকর গন্ধ অনুভব করেছি। ঐরূপ খাদ্য গ্রহণ করা আমার পক্ষে শোভনীয় নহে। তাই আমি খাই নি। কেননা আল্লাহর সাথে সর্বক্ষণ আমার কালাম বিনিময় হতে থাকে; তবে তোমরা তা খাও। তাঁরা তা খেলেন। সে হতে রাসূল (সাঃ)-এর আহার্যে কখনও রসুন বা পিঁয়াজ দেয়া হত না।