বাঁশ দর্শন (Misk Al Maruf)

  1. বিয়ের সুসজ্জিত মঞ্চ। চারদিকে ঝলমলে আলো, ফুলের গন্ধে ম-ম করছে পরিবেশ। আমি মারুফ, আমার হবু স্ত্রী, মায়াবী চোখের অধিকারিণী মিমি-কে নিয়ে বসে আছি। মিমির মেহেদি রাঙা হাত লজ্জার প্রলেপ। আমাদের দুজনেরই মুখে একফালি হাসি চোখে নতুন জীবনের স্বপ্ন। নিচে উপচে পড়া ভিড়, আমন্ত্রিত অতিথিরা সবার দৃষ্টি আমাদের দিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে, যখন কাজি সাহেব পবিত্র শব্দ উচ্চারণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তখনই ঘটে গেল সেই অনাকাঙ্ক্ষিত চরম হাসির এবং আপাতদৃষ্টিতে বিপর্যয়কর ঘটনাটি!

​হলভর্তি মানুষকে স্তম্ভিত করে দিয়ে ভিড় ঠেলে ঝড়ের বেগে মঞ্চে উঠে এলো এক কালো বোরখা পরিহিতা নারী। তার সর্বাঙ্গ কালো কাপড়ে আবৃত, চোখে নেকাব হাতে কালো গ্লাভস। মঞ্চে উঠেই সে বিদ্যুতের বেগে আমাকে জাপটে ধরলো। তার এই আকস্মিক ও নাটকীয় কাণ্ডে শুধু আমি কেন, আশেপাশে বসা মিমি ও প্রধান অতিথিরাও যেন শ্বাস নিতে ভুলে গেলেন।

​”একি! ক… কে আপনি? আপনি এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করছেন কেনো?” আমি হকচকিয়ে গিয়ে তাকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললাম। আমার গলা দিয়ে শুধু কাঁপা কাঁপা আওয়াজ বেরোচ্ছিল।

​বোরখা ওয়ালী আরও শক্ত করে আমাকে জাপটে ধরলো। তার কান্নার তীব্রতা এমন ছিল যে মনে হচ্ছিল যেন পৃথিবী দু’টুকরো হয়ে যাচ্ছে। সে এক নিখুঁত করুণ ও মেয়েলি কণ্ঠে বললো, “তুমি… তুমি আমাকে ছাড়া কীভাবে অন্য মেয়েকে বিয়ে করতে পারলে, মারুফ! আমাদের পাঁচবছরের… পাঁচবছরের সম্পর্ক! তুমি এত সহজে ভুলে গেলে? আমার ভালোবাসা কি তোমার কাছে এতই ঠুনকো? সামান্য একটু ঝগড়াই তো হয়েছিলো আমাদের! তাই বলে রাগ করে তুমি অন্য মেয়েকে বিয়ে করবে?”

​আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম! জীবনে প্রেম তো দূরের কথা, কোনো মেয়ের সাথে ভালোভাবে কথা বলতেও আমি ইতস্তত করি। আর এই অচেনা ‘মহিলা’ কিনা বলছে তার সাথে আমার পাঁচ বছরের সম্পর্ক! পাঁচ বছর! আমার জীবনে পাঁচ বছর আগে যা ঘটেছিল, তা হলো এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতি!

​নিচে উপস্থিত অতিথিরা ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে, গলার আওয়াজ নিচু করেও বেশ উত্তেজনা নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। স্টেজের সামনে মানুষের জটলা। সবাই যেন হলিউডি সিনেমার দৃশ্যের চেয়েও বেশি মনোযোগ দিয়ে এই “লাইভ অ্যাকশন ড্রামা” দেখছে।

​পাশ ফিরে তাকালাম মিমির দিকে। কিছুক্ষণ আগের সেই লাজুক নববধূ যেন জাদুস্পর্শে ভোল পাল্টে ফেলেছে। তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে, বিস্ফারিত দৃষ্টিতে সে একবার আমাকে দেখছে একবার বোরখাওয়ালীকে। মিমির মেকআপ করা মুখটা এখন ফ্যাকাশে। আমার মনে হলো মিমির চোখে প্রশ্ন, অবিশ্বাস আর অভিমানের এক ভয়ংকর ককটেল তৈরি হয়েছে।

​আমি কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না। এই মুহূর্তে কোনো কথা আমার মস্তিস্কে ঢুকছিল না। কোনোমতে তাকে ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করে ভয় মাখা কণ্ঠে বললাম, “প্লিজ! এই মুহূর্তে কোনো ঝামেলা বাধাবেন না। আমার কস্মিনকালেও কোনো প্রেমিকা ছিলো না! আপনি কোত্থেকে উদয় হলেন? বলুন তো!”

​সে আমাকে ছাড়ার কোনো নামই নিল না উল্টো আরও শক্ত করে চেপে ধরলো। তার কণ্ঠের সেই করুণ সুর এবার অনুরোধে রূপ নিল: “প্লিজ, মারুফ, তুমি এখন মিথ্যা বলবা না! আমি তোমার কাছে পায়ে ধরে ক্ষমা চাচ্ছি। আর কখনো তোমার সাথে ঝগড়া করব না! তুমি যা বলবে তাই করব। তবুও তুমি এই বিয়ে করবে না! তুমি আমাকে বিয়ে করো মারুফ!”

​এই বলেই সে ধপাস করে আমাকে ছেড়ে মাটিতে বসে পড়লো এবং আমার পা দুটো জড়িয়ে ধরলো। আমি চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে পড়লাম! “আরে করছেন কি! পা ছাড়ুন! প্লিজ, এসব নাটক বন্ধ করেন!”

​সে আমার পা তো ছাড়লোই না, উল্টো এক চরম আর্তচিৎকার দিয়ে সিনেমাটিক ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “তুমি… তুমি যদি আমাকে বিয়ে না করে এই… এই মেয়েকে বিয়ে করো, তাহলে আমি এই বিয়ের স্টেজেই বি… বিঁষ খাবো!”

​এই বলেই সে বোরখার ভেতর থেকে একটি কাঁচের ছোট বোতল বের করলো! বোতলটা দেখে আমার আত্মা খাঁচাছাড়া হওয়ার জোগাড়। ভয়টা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। এটা সত্যি হলে তো আজ আমার বিয়ে নয়, আমার শেষ দিন! পাশ ফিরে দেখি মিমি তার সুন্দর মেহেদি রাঙা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলেছে। এই লজ্জার মুহূর্তে কান্নার দৃশ্য সম্ভবত সে কাউকে দেখাতে চাইছে না।

​হঠাৎই স্টেজের সামনের ভিড় ঠেলে আমার বাবা, আব্দুল মতিন সাহেব দৌড়ে এলেন। তিনি হাঁপাচ্ছেন, কপালের ঘাম মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলেন, “কি ব্যাপার! কি হয়েছে এখানে? এত হট্টগোল কিসের? আর এই মেয়েই বা কে? এখানে এসে সিনক্রিয়েট করছে কেন?”

​আমি বাবাকে কিছু বলতে যাব তার আগেই আগন্তুক আমাকে ছেড়ে বাবার পা দুটো জাপটে ধরলো! এইবার দৃশ্যটা আরও করুণ আরও হাস্যকর হয়ে উঠলো। বাবার পায়ের কাছে মুখ গুঁজে সে কান্নামিশ্রিত স্বরে বললো, “আঙ্কেল! প্লিজ, আপনি এই মেয়ের সাথে মারুফকে বিয়ে দিবেন না! ওর সাথে আমার পাঁচ বছরের সম্পর্ক! সামান্য রাগ করে আজ আপনাদের পছন্দে বিয়ে করছে। আজ যদি এই বিয়ে হয়, তাহলে আমি এখানেই বিষ খেয়ে সুইসাইড করব! আর তার দায়… দায় দিয়ে যাবো আপনাদের ওপর!”

​বাবার মুখটা মুহূর্তেই থমথমে হয়ে গেল। তিনি আমার দিকে এমন কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেন মনে হলো এখনি তার চোখ থেকে লেজার রশ্মি বের হয়ে আমাকে ছাই করে দেবে।

​ঠিক তখনি পাশ থেকে মিমির বড় ভাই যিনি একজন আইনজীবী, রাগান্বিত দৃষ্টিতে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বিয়ে ঠিক করার আগে তো নিজের ছেলের সম্বন্ধে বেশ সুনাম করেছিলেন! আপনার ছেলের মতো নাকি ছেলেই হয় না! আর এখন এসব কী দেখছি? হুহ! আমাদের কি অপমান করার জন্য এত আয়োজন করলেন নাকি? আজ যদি আমার বোনের সাথে আপনার ছেলের বিয়ে না হয়, তাহলে আমরা আপনাদের নামে মানহানির মামলা করব!”

​বাবার মুখটা একদম চুপসে গেল। তার অসহায়ত্ব যেন চোখে স্পষ্ট। তিনি শান্ত হওয়ার চেষ্টা করে বললেন, “শান্ত হও বাবা! আমি দেখছি বিষয়টা।”

​এরপর তিনি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, “আচ্ছা, সবকিছুই বুঝলাম যে তোমাদের মাঝে প্রেম ছিল… কিন্তু এর কোনো প্রমাণ তুমি দিতে পারবে?”

​বোরখাওয়ালী তখন সেই বিষের বোতলটা হাতে নিয়ে দেখালো এবং তার কণ্ঠস্বর আরও করুণ হয়ে উঠলো, “কোনো মেয়ে রিলেশন না থাকলে শুধু শুধু কি একটা ছেলের জন্য বিষ খেতে চাইবে? আপনিই বলুন! আপনার যদি একান্তই প্রমাণ লাগে, তাহলে আমি এই বিষ খেয়ে এখনই প্রমাণ দিচ্ছি!”

​এই বলেই সে যখন বোতলের ছিপি খুলতে গেল, বাবা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন, “না না! বুঝতে পেরেছি আমি! তোমার বিষ খাওয়ার দরকার নেই!”

​আমি অসহায় দৃষ্টিতে বাবাকে বললাম, “তুমি বিশ্বাস করো, বাবা! ওনাকে আমি চিনিই না! হয়তো কোনো ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করছে আমার এই বিয়ে ভাঙার জন্য! তুমি এর কথা একটুও বিশ্বাস করো না!”

​বাবা আমাকে ধমক দিয়ে বললেন, “তুই চুপ থাক! এই মেয়ের সাথে সম্পর্ক না থাকলে ইনি কি হুদাই তোর জন্য বিষ খাবে? আমি কি কিছু বুঝি না? আমাকে বোকা পেয়েছিস? আমার মানসম্মান সব শেষ করে দিলি আজ!”

​এই কথোপকথন চলতেই থাকলো, আর আমি যেন এক জীবন্ত নাটকের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে।

​পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি মিমি কাঁদছে। কাঁদারই কথা কারণ এমন খুশির মুহূর্তে যদি এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে, তাহলে আর কান্না ছাড়া কিই বা করার আছে? ইতোমধ্যে আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সবাই স্টেজের সামনে ভিড় জমিয়েছে।

​হঠাৎই আমার মাথায় সুবুদ্ধির উদয় হলো। আমি ভালোভাবে আগন্তুককে খেয়াল করলাম। তার পুরো শরীর কালো বোরকায় আবৃত এমনকি চোখ দুটোও নেকাব দিয়ে লাগানো হাতে কালো মোজা।

​আমি কৌতূহলী মনে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আচ্ছা, আপনার চেহারাটা একটু দেখান তো! দেখি, আপনি আসলেই আমার প্রেমিকা নাকি অন্য কেউ?”

​সে এবার চিকন মেয়েলি কণ্ঠস্বরে বললো, “এসব তুমি কী বলছো, মারুফ! তুমি জানো না আমি কতটা পর্দা করি? আর সেখানে কিনা এত মানুষের সামনে আমাকে মুখ দেখাতে বলছো?”

​তার কথা শুনে আমি পুনরায় চমকে উঠলাম। এই চরম নাটকীয়তার মধ্যেও তার পর্দা করার প্রতি এমন ভক্তি দেখে আমার সন্দেহটা আরও বাড়লো। ঠিক তখনি আমার চোখ গেল তার পায়ের দিকে।

​পায়ের মধ্যে বুট জুতা!

​সে মেয়েলি সাজে, মেয়েলি কণ্ঠে কথা বলছে অথচ তার পায়ে মেয়েদের স্যান্ডেল বা জুতার বদলে কালো রঙের চামড়ার বুট জুতা! এইবার আমার সন্দেহ আর সন্দেহের সীমায় রইল না। মনের মধ্যে বেশ সাহস জুগিয়ে আর দেরি করলাম না।

​শক্ত হাতে নেকাবটা ধরে এক টানে সরিয়ে দিলাম!

​আরে বাবা! এ কী!

​আগন্তুক নারীর চেহারাটি সবার সামনে উন্মুক্ত হলো। তার চেহারা দেখে আমার থেকেও আশপাশের উৎসুক অতিথিগণ অবাক হওয়ার চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলেন। এতক্ষণ যাবৎ এত সুমধুর কণ্ঠস্বরের অধিকারী বোরখা পরিহিত নারীর মুখমণ্ডলে দাড়ি আর গোঁফে ভরপুর!

​আর সে আর কেউ নয়! সে হলো আমার সেই বন্ধু, যাকে আমি ছোটবেলা থেকেই চিনতাম আমার ছোটবেলার বন্ধু নাটকের মাস্টার আক্কাস!

​ছোটবেলা থেকেই তার মেয়েদের কণ্ঠস্বর হুবহু নকল করার এক অদ্ভুত দক্ষতা ছিলো, আর পাশাপাশি অভিনয়ে ছিলো সমান পারদর্শী। স্টেজে নাটক করতে নেমে তার অভিনয় দেখে দর্শকেরা হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে যেত। সে তার এই প্রতিভা দিয়েই আজ আমার বিয়ের মঞ্চে এক চরম ‘বাঁশ’ দিয়ে গেল।

​শালার বন্ধু আক্কাস এক অট্টহাসি দিয়ে বলে উঠলো, “কী ব্যাপার, বন্ধু! অভিনয়টা কেমন দিলাম? তুই তো খুব করে চাইছিলি তোর বিয়েতে যেন আমি একটু অভিনয় করে দেখাই! তাই জায়গামতো নিজের প্রতিভাকে প্রদর্শন করলাম! আর প্ল্যানটা তো আমাদেরই ছিল, মনে আছে? তুই-ই না বলেছিলি, ‘আক্কাস, আমার বিয়েতে একটা কিছু করিস, যাতে সারা জীবন মনে থাকে!'”

​আক্কাসের এই কথা শুনে আমার মুখ থেকে দুনিয়ার সব গালি যেন বের হয়ে আসতে চাইছে। তবুও বিয়ের স্টেজে নিজের সম্মানের কথা চিন্তা করে নিজেকে দমিয়ে রাখলাম। একটি গালিও বের করলাম না মুখ থেকে। তার এই প্রতিভা দেখে হাসি আটকানো অসম্ভব ছিল।

​পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি আমার হবু বউ মিমি, চোখের জল মুছে মিটিমিটি হাসছে। হয়তো এতক্ষণে সে বুঝতে পেরেছে,তার হবু স্বামী অন্তত চরিত্রহীন নয় বরং এক চরম কৌতুক অভিনেতার বন্ধু। মিমির হাসিতে যেন স্বস্তির এক ঝলক।

​বাঁশ যে কতভাবে দেওয়া যায় তা আজ এই বন্ধু আক্কাসের অভিনয় না দেখলে আমি বুঝতে পারতাম না। অস্কার কমিটির ব্যর্থতা যে তারা এখনো ওকে অস্কার দিতে পারেনি! তবে আমি সময়মতো ওকে ঠিকই অস্কার দিয়ে দিব তাও আবার বাঁশ দিয়ে!

“এই গল্পটা যদি তোমার দিনটা ভালো করে দেয়, তাহলে শেয়ার করে আরেকজনের দিনটাও ভালো করে দাও।”

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!