- গ্রীষ্মের সেই দুপুরটা। ময়মনসিংহের কাশর। ২০০৭ সালের ১১ জুলাই। এই তারিখটা আজও এলাকার প্রতিটি মানুষের বুকে একটা শীতল পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। সেদিন প্রকৃতিও যেন আতঙ্কিত ছিল, আকাশে ছিল তীব্র রোদ কিন্তু বাতাস ছিল একদম নিথর, যেন শ্বাস বন্ধ করে সব দেখছিল। এই অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা আসলে ছিল এক ভয়ঙ্কর তাণ্ডবের পূর্বাভাস।
আমি তখন সাংবাদিকতার ছাত্র। হাতে ক্যামেরা আর নোটবুক। প্র্যাকটিক্যাল রিপোর্টিংয়ের অজুহাতে আমি গিয়েছিলাম ঘটনাস্থলে। আমি প্রস্তুত ছিলাম একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনার রিপোর্ট করার জন্য কিন্তু যা দেখেছিলাম, তা স্রেফ একটি দুর্ঘটনা ছিল না। এটি ছিল এক পরিকল্পিত, ধর্মীয় বিভ্রমের ভয়ানক ফল, যা আজও আমার ঘুম কেড়ে নেয়।
রেললাইনের ঠিক পাশে ইটখোলার সেই জায়গাটা। দূর থেকে শান্ত কিন্তু কাছে গেলে মনে হতো মাটির নিচ দিয়ে কোনো চাপা ভারী শব্দ উঠে আসছে।
স্থানীয়রা জড়ো হয়েছিল, কিন্তু কেউ লাইনের কাছে যাচ্ছিল না। তারা কেবল দূর থেকে দেখছিল এক পরিবার, একেবারে নয়জন সদস্য, ধীর পায়ে রেল পাটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
প্রত্যক্ষদর্শী একজন বৃদ্ধ আমাকে পরে বলেছিলেন, “ওরা হাঁটছিল না, যেন ভেসে যাচ্ছিল। কেউ কথা বলছিল না হাত ধরছিল না, এমনকি একটা শিশুও কাঁদছিল না। সবার চোখ সামনের দিকে, একটা নির্দিষ্ট অদৃশ্য নির্দেশ মানছে যেন।”
এর চেয়েও ভয়ঙ্কর ছিল তাদের মুখের অভিব্যক্তি। একজন বয়স্ক লোক, যার চোখে তখনো সেই দিনের দৃশ্য তিনি ডুকরে কেঁদে উঠে বললেন, “চোখে একটা অদ্ভুত শান্তি দেখছিলাম দাদা। ভয় নয় কোনো দ্বিধা নয় কেমন যেন ঈশ্বরের কাছে আত্মসমর্পণের শান্তি। মানুষ কি মৃত্যুর আগে এমন শান্তি দেখায়?”
ট্রেনের হুইসেল তখন দূর থেকে ভেসে আসছিল। শুরুতে ক্ষীণ তারপর ক্রমশ জোরালো। লাইন কাঁপতে শুরু করল। নয়জন মানুষ একটা নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে লাইনের ওপর নীরবে বসে ছিলো । তাদের স্থিরতা দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন প্রাচীন কোনো মন্দিরের মূর্তি।
ড্রাইভার পাগলের মতো হুইসেল বাজাচ্ছিল। দ্রুত, দ্রুততর। কিন্তু ওই নয়টি মূর্তি নড়ল না। কেউ হাত নাড়েনি কেউ বাঁচার সামান্যতম চেষ্টাও করেনি। কেবল এক দীর্ঘ অসহনীয় নীরবতা। আর সামনের দিকে তাকিয়ে থাকা নয় জোড়া চোখ। তারা যেন ট্রেনের আলোয় নিজেদের মুক্তি দেখছিল।
তারপর,
এক আকাশ-ফাটানো গর্জন। এক ঝলক লাল ছিটে। এক ঝাঁক মানুষের বিভ্রান্ত চিৎকার।
এবং এক সেকেন্ডের মধ্যে নেমে আসা মৃত্যুর চূড়ান্ত নীরবতা।
নয়টি জীবনের গল্প শেষ হলো। কিন্তু তাদের মৃত্যুর কারণ খুঁজতে গিয়ে আমি এক এমন গহ্বরে প্রবেশ করেছিলাম, যার অন্ধকার আজও পিছু ছাড়েনি।
ঘটনার পর পুলিশ আমাকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বাড়িতে ঢুকল। ইটখোলার কাছেই টিনের ছাউনি দেওয়া ছোট বাড়ি। ভেতরে যেন গ্রীষ্মের বাতাসও স্থির হয়ে জমে আছে। ঢুকেই একটা চাপা পচা গন্ধ। যেন বহুদিন ধরে সেখানে কোনো আচারে রক্ত ঝরেছে।
প্রথমেই যা চোখে পড়ল তা হিম করে দেওয়ার মতো। উঠানে মাটির গর্ত খোঁড়া একেবারে নয়টি, ঠিক যেন কবরের আকার। পাশে কাঠের স্তূপ আর আধা বানানো কয়েকটি কফিনের কাঠামো।
বুঝতে বাকি রইল না তারা শুধু মরতে যায়নি। তারা মৃত্যুকে স্বাগত জানানোর আয়োজন করে গিয়েছিল। মৃত্যু তাদের কাছে গন্তব্য ছিল না ছিল একটি পবিত্র উৎসব।
ঘরের দেয়ালজুড়ে আঁকা অদ্ভুত সব প্রতীক। কুণ্ডলী পাকানো রেখা ত্রিভুজ এবং কালো সূর্যের মতো চিত্র। আর একটা বড় কালো মার্কারের লেখা:
”আদম ধর্ম: পবিত্র সত্যের শেষ পথ”
মাঝখানে টাঙানো তাদের বাবা আনোয়ার দরবেশের (যিনি বছরখানেক আগে মারা গেছেন) একটি তেলরঙের ছবি। তার নিচে লেখা:
”প্রথম আদম আমাদের পথপ্রদর্শক, আমাদের মুক্তিদাতা”
ডায়েরি খুলতেই সেই পুরনো কাগজের গন্ধ নাকে এলো। কিন্তু ভেতরের লেখাগুলো পড়তেই মনে হলো, এগুলো কোনো সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। এ যেন এক সম্মিলিত বিভ্রমের ভাষা এক নতুন, ভয়ঙ্কর ধর্মের ম্যানিফেস্টো।
তারা লিখেছিল,
”মানুষ ভুলের সন্তান। এই পৃথিবী পাপে পূর্ণ। পবিত্র হতে হলে রক্ত দিয়ে শুদ্ধি দরকার। আমরা পবিত্র হতে চাই, নিজেদের রক্ত দিয়ে। আমাদের আত্মা আদমের কাছে ফিরবে। ধর্ম মিথ্যা, পৃথিবী মিথ্যা আদমই একমাত্র সত্য।”
এর চেয়েও ভয়াবহ ছিল পরবর্তী পাতাগুলো মৃত্যুর দিনক্ষণ লেখা।
”১১ জুলাই, ফিরে যাওয়ার দিন। আদম আমাদের ডাকছে। তিনি প্রথম আদম, আমরা দ্বিতীয় আদম। আমরা তার রক্ত বহন করছি।”
”ট্রেন আমাদের পথ। আগমনের মাধ্যম। মুক্তি কেবল একটি হুইসেল শব্দ দূরে।”
আমার বুক ভয়ে কেঁপে উঠল। ট্রেন মুক্তির পথ? তাদের কাছে কি আত্মহত্যা একটি সাধারণ মৃত্যু ছিল, নাকি ‘আদম ধর্ম’-এর চূড়ান্ত ধর্মীয় আচার? এই প্রশ্নটির কোনো উত্তর মনোবিদদের কাছে ছিল না।
পাশের বাড়ির মহিলারা জড়ো হয়ে ফিসফিস করে কথা বলছিলেন। একজন বললেন, “ওরা বাইরের কারও সাথে মিশত না। নিজেদের ‘পবিত্র পরিবার’ বলত। আনোয়ার দরবেশ মারা যাওয়ার পর থেকেই তার ছেলে-বউরা বেশি বাড়াবাড়ি শুরু করে। দরজা সবসময় বন্ধ, বাচ্চারা পর্যন্ত খেলার জন্য বের হতো না। বলত ‘বাইরের বাতাস অপবিত্র’।”
আরেকজন মহিলা একটি ভয়ঙ্কর তথ্য দিলেন। তিনি জানালেন, “না, এটা ওদের প্রথম চেষ্টা ছিল না। ৪ দিন আগে, ৭ জুলাই রাতেও তারা বিষ খেয়ে মরতে চেয়েছিল, কিন্তু প্রতিবেশীরা জানতে পারায় সেবার বেঁচে যায়। এরপরেই হয়তো তারা আরও ভয়ঙ্কর রাস্তা বেছে নেয়।”
আর ১০ জুলাই তারা পালন করেছিল “ব্ল্যাক ডে” তাদের ‘প্রথম আদম’, অর্থাৎ বাবার মৃত্যুবার্ষিকী। ঠিক তার পরের দিন তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়।
১১ জুলাই সকালে তারা যখন বাড়ি থেকে বেরোয়, তখন দরজায় একটা বড় তালা ঝুলিয়ে দেয়। ডায়েরিতে শেষবার লেখা ছিল:
”কেউ যেন আমাদের দেহ স্পর্শ না করে। আমাদের দরকার নেই। আমরা ফিরব। রাতের হাওয়ায়, আত্মায়, কাশরের বাতাসে। আমাদের ভুলে যেও না।”
এই শেষ বাক্যটা পড়ে মেরুদণ্ড দিয়ে একটা শীতল স্রোত নেমে গেল। ‘আমাদের ভুলে যেও না।’ এ যেন মুক্তি নয়, এক অভিশাপ!
যে স্থানীয়রা সেই দৃশ্য দেখেছিল তারা আজও চোখ বন্ধ করলে সেই শব্দ শুনে। সেই দৃশ্য দেখে তাদের মনের গভীরে যে ক্ষত তৈরি হয়েছে, তা কোনোদিন সারবে না।
এক যুবক তার চোখ মুছতে মুছতে বলছিল, “ট্রেন থামল, কিন্তু লাইন তো থামল না। পুরো এলাকা লাল হয়ে গিয়েছিল। একটা মায়ের ছিন্নভিন্ন দেহ দেখলাম সে তখনো তার ছেলেকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিল। দুজনেরই চোখ খোলা! তারা বাঁচতে চায়নি। আমি চিৎকার করতে চাইলাম, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরোলো না। আমার হাত-পা জমে গিয়েছিল।”
মনোবিদরা এটাকে পরে আখ্যা দিয়েছিলেন, ‘সমষ্টিগত বিভ্রম’। যেখানে একজন নেতার (আনোয়ার দরবেশ) বিশ্বাস তার অনুগামীরা অন্ধভাবে গ্রহণ করে। কিন্তু ডায়েরির শেষ পাতা আর প্রতিবেশীর দেওয়া তথ্য এগুলো কেবল বিভ্রম ছিল না। এর পেছনে ছিল অন্ধ আনুগত্য এবং মৃত্যুর প্রতি এক অস্বাভাবিক আকর্ষণ।
সবকিছু শেষ হয়ে যাওয়ার পর, ময়নাতদন্ত এবং দাফন সম্পন্ন হলো। সে রাতে আমি আবার তাদের বাড়ির সামনে গিয়েছিলাম। সাংবাদিকতার কৌতূহল ছিল না ছিল এক অনিবার্য আকর্ষণ।
রাস্তা জনশূন্য। পরিবেশ অন্ধকার। বাড়ির প্রধান দরজা তখনও ভাঙা, আর ভেতরের গাঢ় অন্ধকার জানালা দিয়ে বাইরের দিকে উঁকি দিচ্ছে।
আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঠিক তখনই, একটা শব্দ যেন বাড়ির ভেতর থেকে কেউ ফিসফিস করে ডাকছে:
”আদম… পবিত্র… আদম…”
আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। হাওয়া আচমকা একটা দীর্ঘ টান দিয়ে আমার পাশ কাটিয়ে গেল। মনে হলো, বাড়ির ছায়াটা যেন নড়ে উঠল।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে রেললাইনের দিক থেকে ভেসে এল ট্রেনের হুইসেল। দীর্ঘ তীক্ষ্ণ এবং ভারী।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আমি জানি সেদিন রাত ১২টার পর এই লাইন দিয়ে আর কোনো ট্রেন যাওয়ার কথা ছিল না।
তবুও শব্দটা ক্রমশ কাছে আসছিল। মনে হচ্ছিল কোনো অদৃশ্য, ভূতুড়ে ট্রেন যেন বাতাস চিরে দৌড়াচ্ছে। এর শব্দে কেবল লোহা আর পাথরের ঘষা লাগার আওয়াজ ছিল না, ছিল নয়টি আত্মার আর্তনাদ।
আমি আতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে সরে গেলাম। পিছনে তাকিয়ে দেখি,
বাড়ির অন্ধকার জানালায় নয়টি ছায়া দাঁড়িয়ে।
স্পষ্ট কোনো চোখ বা মুখ ছিল না, কেবল মানুষের আকৃতির নয়টি কালো ছায়া।
আর এক মুহূর্ত পর শব্দ থেমে গেল, ছায়াগুলোও মিলিয়ে গেল।
ময়মনসিংহের কাশর এলাকাটি আজও শান্ত। রেললাইনেও নীরবতা। কিন্তু স্থানীয়রা বলে,
”১১ জুলাইয়ের রাতে কে না দেখছে, কে না শুনছে সেই নয়টি আত্মা এখনো ফেরার পথে আছে।”
মাঝে মাঝে গভীর রাতে, বিশেষ করে বর্ষার ভেজা রাতে, বাতাসে কেউ ফিসফিস করে:
”আমি আদম… আমরা আসব… আমাদেরকে ভুলে যেও না…”
বিশ্বাস যদি ভুল পথে যায় মানুষ নিজের হাতে নিজের শেষ লিখে ফেলতে পারে। আর সেই শেষটা যদি হয় এক ধর্মীয় আচারের অংশ, তবে সেই মৃত্যু কেবল একটি জীবন কেড়ে নেয় না বরং এক চিরস্থায়ী অভিশাপ রেখে যায়।
আজও কাশরের সেই রেললাইনে দাঁড়ালে মনে হয় সময়ের নিচে নয়টি চিরস্থায়ী পদচিহ্ন চাপা পড়ে আছে। আর সেই চাপা পড়া মাটি থেকে সবসময় একটি প্রশ্ন উঠে আসে: সত্যিই কি তারা মুক্তি পেয়েছে, নাকি কেবল তাদের ‘প্রথম আদমের’ কাছে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে?
গল্প না – ঘটনা।
শেয়ার করে রাখো।
কারণ সত্যি জিনিসই ভয় দেখায় বেশি।
(সত্য ঘটনা অবলম্বনে)
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।