জিএক্স ব্লকের প্রেতছায়া (Misk Al Maruf)

সেদিনের কথা এখনো মনে হলে হাতের তালু ঘেমে ওঠে। ঢাকার বাতাসে এমন রাত খুব কম আসে যখন মনে হয় শহরটা নীরব হয়ে শুধু তোমার নিঃশ্বাস শুনছে। সেই রাতটা ছিল ঠিক সেরকমই।

​আমি তখন সদ্য বসুন্ধরা জিএক্স ব্লক এ শিফট করেছি রোড ১ক এর পাশে একদম নতুন ফ্ল্যাট। দিনের বেলায় জায়গাটা স্বাভাবিক মানুষজন, দোকান, গাড়ি সবকিছুই অন্য এলাকার মতোই প্রাণবন্ত। কিন্তু রাত নামলে পুরো এলাকা এমন নীরব হয়ে যেত, মনে হত যেন কেউ ইচ্ছে করে চারপাশের শব্দগুলো চুষে নিয়েছে। এমন নৈঃশব্দ্য যেন জিএক্স ব্লকের এক নীরব অভিশাপ।

​শিফট করার পর প্রথম কয়েক দিন আমি প্রতিদিনই ছাদে যেতাম। কারণ জিএক্স ব্লকের বেরসিক বাতাসটা খুব অদ্ভুত কখনো টেনে নেয়, কখনো ধাক্কা দেয় আবার কখনো মনে হয় কারো মোচড়ানো ফিসফিসানি বহন করে আনে। সেই বাতাস যেন সব কথা জানে কিন্তু বলবে না।

​সেদিন রাত ২টার দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। মোবাইলের স্ক্রিনে ২:০৭। কী যেন অস্বাভাবিক একটা চাপা শব্দ হচ্ছিল মনে হলো ঠিক পাশের রাস্তায় কেউ ধীরে ধীরে পা টিপে হাঁটছে। জিক্স ব্লকে রাত ১১টার পর রাস্তায় কাউকে দেখা যায় না। গার্ডরাও সাধারণত গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে গল্প করে। তাই শব্দটা আমাকে বিরক্ত করছিল। একটা অচেনা কৌতূহল আমাকে তাড়া করল।

​আমি ভাবলাম ছাদে গিয়ে দেখি। বাস্তবে, মনে হচ্ছিল কিছু একটা ডাকছে পাশের বাড়িটার দিকে… যে বাড়িটা নিয়ে ভাড়াটিয়াদের মধ্যে ইতিমধ্যে এক অদ্ভুত কথা শুনেছি।

​আমাদের বাড়ির ঠিক বিপরীতে একটা পাঁচতলা বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু শুধু দাঁড়িয়ে আছে মনে হয় যেন নির্মাণ-শ্রমিকেরা সবকিছু ফেলে হঠাৎ করে পালিয়ে গেছে। জানালাগুলোতে কাঁচ নেই শুধু ফাঁকা কালো গর্ত। তার মধ্যে রাতের বাতাস ঢুকে কখনো শোঁ শোঁ শব্দ করে, কখনো ভিতরের অন্ধকার যেন ভারী হয়ে বাইরে ছড়িয়ে পড়ে। এক কথায় পরিত্যক্ত।

​শিফট করার দ্বিতীয় দিন গার্ডের কাছে শুনেছিলাম,​“ওই বাড়িটার ৪র্থ তলায় রাতে একটা ছায়া দেখা যায়। মেয়ে বলে মনে হয়। সাদা পোশাক।”

​আমি হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। লোকেরা এধরনের জায়গায় এসে সবসময় ভূত প্রেতের গল্প বানায় এটাই স্বাভাবিক। আমি ছিলাম যুক্তিবাদী।

​কিন্তু সেদিন রাত ২টার পরে আমার ঘুম ভাঙা, ওই ধীর পায়ের শব্দ আর হঠাৎ করে অজানা টান… সব মিলিয়ে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। মনে হচ্ছিল যুক্তির বাঁধ ভেঙে কিছু একটা আমাকে টানছে।

​আমি ছাদের দরজা ধীরে খুললাম। বাতাস কেমন জানি ঠান্ডা। ঢাকার এপ্রিলে এমন ঠান্ডা হওয়া অস্বাভাবিক, যেন শীতকালের হিম এসে জমে আছে শুধু এই ছাদে।

​ছাদের গ্রিল টপকে বিপরীত দিকের বাড়িটা স্পষ্ট দেখা যায়। চাঁদ ছিল অর্ধেক কিন্তু জিক্স ব্লকের উজ্জ্বল স্ট্রিট লাইটগুলো থাকার কারণে পুরো বিল্ডিংটা আধা উজ্জ্বলতায় ভেসে উঠেছিল। দরজাহীন ফ্লোরগুলো একেকটা অন্ধকার কুঁড়েঘরের মতো লাগছিল।

​আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম হঠাৎ ঠিক ৪র্থ তলার মাঝের জানালায় একটা লম্বা স্লিম ছায়া দেখা গেল।

​প্রথমে মনে হলো শ্রমিকদের ফেলে যাওয়া কোনো কাপড় বাতাসে দুলছে। কিন্তু পরের মুহূর্তেই অনুভব করলাম ওটা কাপড় না। ওটা নড়ছে, কিন্তু বাতাসের মতো এলোমেলোভাবে না। মানুষ যেমন ভাবে নড়ে ঠিক সেইভাবে স্থির নড়াচড়া।

​আমি স্থির হয়ে গেলাম।

​ছায়াটা জানালায় দাঁড়িয়ে যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

​তারপর… ধীরে ধীরে মাথাটা একটু কাত করল। ঠিক যেমন করে কেউ দেখে, “এই লোকটা আমার দিকে কেন তাকাচ্ছে?” ঠিক তেমন বাঁকা, স্থির দৃষ্টি।

​আমার বুকের ভেতরের রক্ত যেন আটকে গেল। হৃৎপিণ্ড ততক্ষণে দ্রুত ড্রামের মতো বাজতে শুরু করেছে।

​আমি চোখ মুছে আবার তাকালাম ছায়াটা তখনো দাঁড়িয়ে, একই জায়গায়। তার সাদা পোশাকের মতো কিছু একটা আছে… তবে পোশাক না বরং আলোছায়ার ভুল মনে হয়, কিন্তু মানবদেহের আকৃতি এতো স্পষ্ট এটা চোখের ভুল হতে পারে না। ওটা স্থির অথচ জীবন্ত।

​কেন জানি নামনে হচ্ছিল আমাকে কিছু একটা টেনে নিচে নেমে রাস্তার দিকে যেতে বলছে। যেন ছায়াটা জানালায় দাঁড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে তার কাছে যেতেই হবে এমন একটা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করলাম।

​আমি সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনতে পেলাম, পায়ের শব্দটা এখন আরও পরিষ্কার ঠিক কারো স্যান্ডেল টেনে হাঁটার মতো শব্দ। কিন্তু রাস্তায় তো কেউ নেই! বাড়ির সব ফ্ল্যাটের জানালা অন্ধকার।

​নীচে নেমে গেট খুলতেই কেমন ঠান্ডা বাতাস এসে লাগল গালে। সেই অস্বাভাবিক হিমেল বাতাস, যা শুধু জি এক্স ব্লকের এই কোণে পাওয়া যায়।

​রাস্তা থেকে বিপরীত বাড়িটা আরও স্পষ্ট দেখা যায়। ৪র্থ তলার মাঝের ঘরটা এখন পুরো অন্ধকার… কিন্তু জানালার ফাঁক দিয়ে দুইটা হলদে চোখের মতো আলো ভেসে উঠছিল। বাতি? মোবাইলের লাইট? আশেপাশে কোথাও কিছুই তো নেই, তবে আলোটা আসছে কোথা থেকে?

​আমি একটু এগিয়ে গেলাম। আমার কৌতূহল তখন ভয়কে ছাপিয়ে গেছে।

​ হঠাৎ…

​একটা ‘টং টং’ ধাতব শব্দ হলো ভিতর থেকে যেন লোহার রড পড়ে গেল।

​তারপর একটা শ্বাসকষ্টের মতো শব্দ,

​”হুহ্… হুহ্…”

​আমি জমে গেলাম। শব্দটা মানুষ না পশুও না মনে হচ্ছিল খুব ভারী কিছু শ্বাস নিচ্ছে।

​ঠিক তখন ৪র্থ তলার ছায়াটা আবার দেখা গেল। এবার আরও স্পষ্ট। জানালায় দাঁড়িয়ে আছে হাত দুটো দুপাশে ঝুলে মাথা সামান্য নিচের দিকে, চুলগুলো অদ্ভুতভাবে কাঁধ ছাপিয়ে নেমে গেছে। তার অবয়ব এতটাই পরিষ্কার যেন দেয়ালের ওপাশে নয়, এই দিকেই দাঁড়িয়ে আছে।

​আর সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয়টা কী জানো?

​ওটা ধীরে ধীরে এগোতে শুরু করল। জানালার দেয়াল ভেদ করে সামনে… বাইরের দিকে… আমার দিকেই।

​এটা অসম্ভব মানুষ তো দেয়াল ভেদ করে বের হতে পারে না। কিন্তু ছায়াটা যেন মাধ্যাকর্ষণ মানছে না। ধীরে ধীরে সহ্যের বাইরে ধীরে জানালার সিমেন্টের ফ্রেম পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসছে।

​আমার পা অবশ। চিৎকার করতে গিয়েও শব্দ বের হলো না। আমি স্থির পাথরের মতো গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

​ আমি দৌড় দিতে শুরু করলাম

​হঠাৎই ভেতরে একটা টাইমারের মতো সুইচ অন হলো আমি দৌড় দিলাম নিজের গেটের দিকে। পেছন থেকে শুনলাম,

​“টিক… টিক… টিক…”

​যেন ভাঙা হিল দিয়ে কেউ রাস্তার ওপর হাঁটছে। সেই স্যান্ডেল টেনে হাঁটার শব্দ এখন দ্রুত যেন আমাকে ধরার জন্য ছুটে আসছে।

​আমি গেটে ঢুকে ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করলাম। উপরে উঠে ছাদের দিকে গেলাম।

​দূর থেকে দেখলাম ছায়াটা এখনো জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে আর অনুসরণ করছে না।

​তবে ওর “মাথা” এবার সোজা আমার দিকে ঘুরে আছে। সেই হলদে আলোকরশ্মি দুটি চোখের মতো, এবার স্থিরভাবে আমাকে দেখছে। একটা হিমশীতল শূন্যতা যেন আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে।

​সকালে উঠে আমি গার্ডকে জিজ্ঞেস করলাম, ​“দাদা, ওই বাড়িটায় কেউ থাকে?”

​সে মাথা নেড়ে বলল,

​“না ভাই, ওখানটা তিন বছর ধরে খালি। ৪র্থ তলায় এক মেয়ের আত্মহত্যার পর কেউ ওঠেনি।”

​আমি হাসলাম যেন কিছুই হয়নি। কিন্তু ভিতরে তখনো রাতের ঠান্ডা বাতাস জমে আছে আর হৃৎপিণ্ডের সেই দ্রুত ড্রামের শব্দ। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,

​“আত্মহত্যা? কেন?”

​গার্ড একটু থেমে বলল,

​“মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছিল, কিন্তু ছেলেটা নাকি পিছনে অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘুরত। বিয়ের তিন দিন আগে মেয়েটা ৪র্থ তলায় গিয়ে… দেখছিল লোকটা নিচে দাঁড়িয়ে অন্য মেয়ের হাত ধরে আছে। ওই জানালায় দাঁড়িয়েই নাকি লাফ দেয়।”

​আমার শরীর কাঁপতে লাগল। গার্ড যোগ করল,

​“মজার ব্যাপার কী জানেন? যেদিন মারা যায়, মেয়েটা সাদা পোশাক পরেছিল।”

সেদিন রাত থেকে আজ যত রাত পেরিয়েছে

​আমি আর কখনো ছাদে যাইনি। জানালাও পুরোপুরি পর্দা দিয়ে ঢেকে রেখেছি যেন এক টুকরো অন্ধকারও না ঢুকতে পারে।

​তবু কখনো কখনো মনে হয় রাত ২টার দিকে, লাইট অফ করার পর আমার ঘরের বিপরীতে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ দুটো হলুদ হয়ে তাকিয়ে থাকে।

​মাঝে মাঝে আবার মনে হয় কেউ যেন দেয়ালের ওপাশে দাঁড়িয়ে চুলের গোছা নামিয়ে ধীরে ধীরে মাথা কাত করছে।

​যেন বলতে চাইছে,

​”আমি এখনো এখানে আছি। তুমি আবার কেন তাকালে?”

“রাত ২টার ছায়া তোমার দিকে তাকাচ্ছে… সাহস আছে কি দেখার? বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করো! “

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!