ধড়মড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে বসলো নিশা। একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখেছে ও একটু আগে। ভয়ে-আতঙ্কে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডটা দাপাদাপি করছে পাগলের মতো। যেন বুকের খাঁচা ভেঙে পালিয়ে বাঁচতে চাইছে এই দুঃস্বপ্নের জগৎ থেকে।
পাশেই শুয়ে আছে হাসান। ঘুমে একেবারে বেহুঁশ। ওকে ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিলো নিশা। বেডসুইচ টিপে বাতিটা জ্বালিয়ে নীচে নামলো জল খেতে।
এভাবে ঘুম থেকে জেগে ওঠায় যুগপৎ বিরক্ত এবং কৌতুহলী হয়ে উঠেছে হাসান। তবে নিশার মুখে ওর দুঃস্বপ্নের আদ্যোপানত্দ শুনে বিরক্তির ভাবটা উড়ে গেল। ও খুব ভালো করেই জানে নিশার ভীতু স্বভাবের কথা। খুব সহজেই ভয় পেয়ে যায় নিশা। বিশেষতঃ ভূতুড়ে বিষয়ে অতিমাত্রায় স্পর্শকাতর। তাই এরকম একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন দেখে যে ভয় পাবে তা অস্বাভাবিক কিছু না।
নিশাকে অভয়বাণী দিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করছে হাসান। চাইছে বিষয়টা ভুলিয়ে দিতে। কিন্তু নিশার চোখের সামনে বারবার শুধুই ভেসে উঠছে স্বপ্নের সেই ভয়াল মূর্তি।
বাকি রাতটুকু জেগেই কাটলো ওদের। সকালের দিকে খণ্ড খণ্ডভাবে ঘুমালো নিশা। আর হাসান প্রস্তুতি নিতে থাকলো শু্যটিংয়ে যাবার।
আগের কথা
মাস তিনেক হলো বিয়ে হয়েছে হাসান ও নিশার।
হাসান শখের লেখক। আর পেশায় একটা মাসিক ম্যাগাজিনের স্টাফ রিপোর্টার। ভবিষ্যতে লেখালেখিটাকেই পেশা হিসেবে নেয়ার ইচ্ছে আছে ওর।
তরুণ লেখক হলেও বেশ জনপ্রিয়তা আছে হাসানের। বিশেষতঃ ওর লেখা হরর সিরিয়াল ও গল্পগুলি অনেক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। রীতিমতো বেস্ট সেলার। ইদানিং একটা হরর সিরিয়াল বানাবার কন্ট্রাক্ট পেয়েছে ও। স্ক্রিপ্ট লেখা শেষ। শু্যটিংও শুরু হয়ে গেছে। পরিচালক, প্রযোজক সবার মন্তব্য, নাটকটা সুপারহিট হবেই হবে।
মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে নিশা। খুব সুন্দরী না হলেও একটা আলাদা লালিত্য আছে চেহারায়। বি.কম. পর্যন্ত পড়ার পরই বিয়ে হয়ে গেল। ওর অবশ্য আরও উচ্চতর পর্যায় পর্যন্ত পড়ার ইচ্ছে ছিল। অবশ্য হাসান বলেছে, ইচ্ছে করলে আরও উচ্চতর শিক্ষাকোর্সে ভর্তি হতে পারে নিশা।
বিয়ের পরপরই মালিবাগের এই নতুন ফ্ল্যাটে উঠেছে ওরা। জয়েন্ট ফ্যামিলিতে বাস করতে রাজি না নিশা। ও বক্তব্য, জয়েন্ট ফ্যামিলিতে প্রাইভেসী বলে কিছু থাকে না। তাই নিশার অবিশ্রান্ত পীড়াপীড়ি সহ্য করতে না পেরে বিয়ের দুই মাসের মধ্যেই বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে এই ফ্ল্যাটে উঠেছে হাসান।
এক ঠিকে-ঝি আছে। দুপুরে এসে ঘর-দোর মুছে, কাপড় কেঁচে, নিশাকে রান্নার কাজে সাহায্য করে দিয়ে যায়। আর বাকিটা সময় নিশাকে সঙ্গ দেয় টিভি-ভিসিডি এসব।
সকাল দশটা থেকে রাত আটটা-নয়টা পর্যন্ত বাড়ির বাইরেই কাটায় হাসান। এতে অবশ্য কোন অভিযোগ নেই নিশার। ও বোঝে, উপার্জন করতে হলে এখনই যা করার করতে হবে। নইলে পরে আর কিছু করা যাবে না। আর দশটা মেয়ের মতো নিশাও চায় সমাজের ঐ উপরতলায় একটা আবাস গড়তে। আর তাই এই একাকীত্ব মোটেও কষ্ট দেয় না, বরং স্বপ্ন দেখতে উৎসাহ জোগায়।
তারপর
হাসান চলে যাবার পর থেকেই নিশা সম্মুখীন হলো এক অস্বস্তিকর অবস্থার। সারাক্ষণ মনে হচ্ছে কে যেন ওর ওপর নজর রাখছে সারাক্ষণ। ও কি করছে না করছে সবকিছু দেখছে অদৃশ্য চোখে। অপেক্ষা করছে ঝাঁপিয়ে পড়ার।
সারা ফ্ল্যাটের সবকটা আলো জ্বেলে ড্রয়িং রুমের সোফায় গুটিসুটি মেরে বসে বসে টিভি দেখছে নিশা।
হঠাৎ বেজে ওঠা কলিংবেলের সুরেলা মিষ্টি শব্দও কানে বজ্রবর্ষণ করলো নিশার। মনে হচ্ছে, নিদারুণ আতঙ্কে অজ্ঞান হয়ে যাবে ও। বারবার মনে হচ্ছে বাইরে কোন অশরীরী প্রেত বেল বাজাচ্ছে। বের হলেই ঘাড়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
ভয়ে আরও কুঁকড়ে গেল নিশা।
কিন্তু নাঃ! বেল তো থামছে না। বেজেই চলেছে। আরে, কে যেন ডাকছে_ “নিশাবু, নিশাবু”। গলাটা চেনা চেনা লাগছে।
আরে এ তো ওদের ঠিকে ঝি আকাশী বেগম! ধড়ে প্রাণ ফিরে পেল নিশা। পরিচিত মানুষের গলা শুনেই বাস্তবজ্ঞান ফিরে আসছে।
“ছি ছি! লোকে শুনলে কি ভাববে? এতো বগ মেয়ে কিনা ভূতের ভয়ে এভাবে কাবু হয়ে আছে!”
তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুলে দিল।
“কি হইছে, বুবু? তুমি এমন ঘামতেছ ক্যান? দরজা খুলতে এতো দেরি করলা ক্যান? শরীর খারাপ করে নাই তো?” ঢুকেই একরাশ প্রশ্ন আকাশী বেগমের।
আসলে নিশাকে খুবই ভালোবাসেন এই বৃদ্ধা। নিজের মেয়ের মতোই স্নেহ করেন। তাইতো দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্য বাড়িতে কাজ না করে নিশাদের বাসাতেই থাকেন, নিশাকে সঙ্গ দেন। আজ নিশার এরকম উত্তেজিত আর আতঙ্কিত চেহারা দেখে সত্যিই খুব চিন্তায় পড়েছেন তিনি।
আকাশী বেগমকে সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে জানালো নিশা। সব শুনে হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে আকাশী বেগম বললেন, “আর চিন্তা নাই। আমি আইসা গেছি। এখন তোমার কোন ভয় নাই, বুবু”।
অন্যদিন নিশাকে কোন কাজ করতে না দিলেও আজ ওকে নিয়ে একসাথে ঘরের এটা-ওটা কাজ শুরু করলেন আকাশী বেগম।
দুপুর
এখন বেশ শান্ত হয়ে এসেছে নিশা।
গত রাতের স্বপ্নকে স্বপ্ন হিসেবেই বুঝতে শুরু করেছে মন।
এক সপ্তাহ পর
গত সাতটি দিন বেশ শান্তিতেই কেটেছে নিশা এবং হাসানের। কোন অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়নি। আটদিন আগের স্বপ্নের কথা অনেকাংশেই ভুলে গেছে নিশা।
আবার স্বাভাবিক ছন্দ এসেছে ওদের জীবনে।
সেই রাতে
গভীর রাত।
চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। রিডিং কাম অফিসরুমে বসে একটা হরর গল্প লিখছে হাসান। প্রায় শেষ পর্যায়ে লেখাটা। একটা গ্রামে কি করে হানা দেয় এক ঝাঁক ভৌতিক বাঁদুড়, সারা গ্রামকে পরিণত করে জীবন্মৃতের আস্তানায়_ এসবই নিখুঁতভাবে ফুটে উঠছে হাসানের কলমের ছোঁয়ায়। রীতিমত আতঙ্কজনক একটি গল্প হবে এটি। পড়তে পড়তে শিউরে উঠবে পাঠক বারবার।
হঠাৎ লোডশেডিং।
উফ্! এদিকে এই একটা সমস্যা ইদানিং প্রকট হয়ে উঠেছে। দিনের মধ্যে ৭/৮ ঘন্টাই চলে লোডশেডিং।
কলম বন্ধ করে টেবিল ছেড়ে উঠলো হাসান। বেডরুম থেকে মোম নিয়ে আসবে।
বাইরে দ্বিতীয়ার ক্ষয়া চাঁদ। ঘরের মধ্যে একটা আলো-অাঁধারির সৃষ্টি হয়েছে। সবকিছু স্পষ্টভাবে না হলেও দেখা যায় আবছাভাবে।
রিডিং রুমের পরে ড্রয়িং রুম, তারপর বেডরুম।
চলতে চলতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল হাসান। একটা অস্পষ্ট খুট্ শব্দ শুনেছে বলে মনে হলো। আবার হলো শব্দটা। মনে হলো জুতা পায়ে হাঁটছে কেউ।
ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস পড়তেই চমকে উঠল হাসান। সাথে সাথেই নিজেকে কষে একটা গালি দিল ও। এতো ভয় পাবার কি আছে? এ নিশ্চয়ই নিশা।
ঠিক তা-ই। নিশা এসে দাঁড়িয়েছে পাশে। অবশ্য চেহারা দেখা যাচ্ছে না। শুধু আবছা একটা অবয়ব। তবে যেহেতু এ ফ্ল্যাটে ওরা দু’টি প্রাণী ছাড়া আর কেউ নেই, সুতরাং এ নিশাই।
সত্যিই কি তাই?
“এতো ভয় পাবার কি ছিল?” ভাবছে হাসান। আবার নিজেই দিল জবাবটা, “আসলে গল্পের মাঝে এতো ডুবে গিয়েছিলাম, বাস্তব জিনিষও অবাস্তব ভূতুরে ঠেকছিল”।
“কি হলো? মোম জ্বালবে না?” হাসি হাসি গলায় বললো নিশা।
“এই তো জ্বালি। ওহ্ হো, মোম তো বেডরুমে” বলেই পা বাড়াল হাসান। এখনও নিজেকে গালাগালি দিয়ে চলেছে। আসলে একটা মেয়ে, তাও আবার নিজের স্ত্রীর রসিকতায় এভাবে ভয় পাওয়ায় নিজের উপরই ক্ষেপে রয়েছে। শুধু শুধু হাসির পাত্র হওয়া!
হাতড়ে হাতড়ে ড্রেসিং টেবিল থেকে একটা মোম তুলে নিল হাসান। তারপর লাইটার দিয়ে জ্বালতে আর কতক্ষণ।
কিন্তু মোমের এই স্বল্প আলোতেই যা দেখলো আতঙ্কে নিমেষে জমে গেল। অবশ্য শিউরে ওঠার মতই দৃশ্য।
বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে আছে নিশা। রক্তশূণ্য ফ্যাকাশে শরীর। প্রচণ্ড আতঙ্কে ঠিকরে বেরিয়ে আসছে চোখ। চেহারায় এক অমানুষিক বেদনার ছাপ। আর ভাঙ্গা ঘাড়ের একপাশে লেগে রয়েছে খানিকটা রক্ত।
বিস্ময় আর আতঙ্কে হতবাক-বিমূঢ় হাসান। পরিষ্কার বুঝতে পারছে না কিছই। বাস্তব-অবাস্তব সব গুলিয়ে ফেলছে। স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াবশেই দরজার কাছে নজর গেল ওর।
একি! দরজায় দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে নিশা!
আবার বিছানায় দৃষ্টি গেল হাসানের। না, ঐ তো নিশা_ রক্তহীন, লাশ হয়ে পড়ে আছে বিছানায়!
তাহলে?
কে ও দরজায় দাঁড়িয়ে?
হঠাৎ কাঁপতে শুরু করলো মোমের শিখা। তারপর দপ করে নিভে গেল। সারা ঘর ডুবে গেল কালিগোলা অন্ধকারে। শুধু দরজার কাছে দু’টি জ্বলন্ত চোখ তাকিয়ে আছে নিঃসীম অন্ধকারের মাঝে।
এগিয়ে আসছে চোখজোড়া।
আর পিছিয়ে যাচ্ছে হাসান।
আতঙ্কে বাকশক্তিও রুদ্ধ হয়ে গেছে।
এগিয়ে আসছে চোখদু’টি।
পেছোচ্ছে হাসান।
একবার চেষ্টা করলো মোমটা জ্বালতে। কিন্তু লাইটার আর জ্বলছে না কিছুতেই।
আরও এগিয়ে এসেছে জ্বলন্ত চোখের মালিক।
পিঠে দেয়ালের স্পর্শ পেল হাসান। আর পেছানোর উপায় নেই।
একদম হাসানের মুখের কাছে এসে থামলো চোখের মালিক।
তারপরই অন্তিম আর্তনাদে পুরো কেঁপে উঠল।
আর্তনাদের সাথে সাথেই শোনা গেল মেয়েলি কণ্ঠের তীব্র খল্খল্ হাসি।
ঠিক আট দিন আগে ঠিক যেমনটি দেখেছিল নিশা_ স্বপ্নে।