রঙ্গলাল চিত্রবিদ্যায় হঠাৎ নামজাদা হয়ে উঠলেন । অর্থাৎ, দেশের রসিক লোক তাঁর রচনার অদ্ভুতত্ব দিয়ে খুব অট্টহাস্য জমালে । তারা যেরকম কল্পনা করে তার সঙ্গে তাঁর কল্পনার মিল হয় না দেখে তাঁর গুণপনার সম্বন্ধে তাদের প্রচণ্ড অবজ্ঞা হল । আশ্চর্য এই যে , এই অবজ্ঞার জমিতেই বিরোধ-বিদ্রূপের আবহাওয়ায় তাঁর খ্যাতি বেড়ে উঠতে লাগল ; যারা তাঁর যতই নকল করে তারাই উঠে পড়ে লাগল প্রমাণ করতে যে , লোকটা আর্টিস্ট্ হিসাবে ফাঁকি — এমন-কি , তার টেক্নিকে সুস্পষ্ট গলদ । এই পরমনিন্দিত চিত্রকর একদিন আপিসের বড়োবাবুর অবর্তমানে এলেন তাঁর মামির বাড়িতে । দ্বারে ধাক্কা মেরে মেরে ঘরে যখন প্রবেশলাভ করলেন, দেখলেন , মেঝেতে পা ফেলবার জো নেই । ব্যাপারখানা ধরা পড়ল । রঙ্গলাল বললেন , “ এতদিন পরে দেখা গেল , গুণীর প্রাণের ভিতর থেকে সৃষ্টিমূতি তাজা বেরিয়েছে, এর মধ্যে দাগা-বুলোনোর তো কোনো লক্ষণ নেই , যে বিধাতা রূপ সৃষ্টি করেন তাঁর বয়সের সঙ্গে ওর বয়সের মিল আছে । সব ছবিগুলো বে ‘ র করে আমাকে দেখাও । ”
কোথা থেকে বের করবে। যে গুণী রঙে রঙে ছায়ায় আলোয় আকাশে আকাশে চিত্র আঁকেন তিনি তাঁর কুহেলিকা-মরীচিকাগুলি যেখানে অকাতরে সরিয়ে ফেলেন , এদের কীর্তিগুলোও সেইখানেই গেছে । রঙ্গলাল মাথার দিব্যি দিয়ে তাঁর মামিকে বললেন , “ এবার থেকে তোমরা যা-কিছু রচনা করবে আমি এসে সংগ্রহ করে নিয়ে যাব । ”
বড়োবাবু এখনো আসেন নি । সকাল থেকে শ্রাবণের ছায়ায় আকাশ ধ্যানমগ্ন , বৃষ্টি পড়ছে ; বেলা ঘড়ির কাঁটার কোন্ সংকেতের কাছে তার ঠিকানা নেই , তার খোঁজ করতেও মন যায় না । আজ চুনিবাবু নৌকা-ভাসানোর ছবি আঁকতে লেগেছেন । নদীর ঢেউগুলো মকরের পাল , হাঁ করে নৌকাটাকে গিলতে চলেছে এমনিতরো ভাব ; আকাশের মেঘগুলোও যেন উপর থেকে চাদর উড়িয়ে উৎসাহ দিচ্ছে বলে বোধ হচ্ছে — কিন্তু মকরগুলো সর্বসাধারণের মকর নয় , আর মেঘগুলোকে ‘ ধূমজ্যোতিঃসলিলমরুতাং সন্নিবেশঃ ‘ বললে অত্যুক্তি করা হবে । এ কথাও সত্যের অনুরোধে বলা উচিত যে , এইরকমের নৌকো যদি গড়া হয় তা হলে ইন্সুয়োরেন্স্ আপিস কিছুতেই তার দায়িত্ব নিতে রাজি হবে না । চলল রচনা , আকাশের চিত্রীও যা-খুশি তাই করছেন , আর ঘরের মধ্যে ওই মস্ত-চোখ-মেলা ছেলেটিও তথৈবচ ।
এদের খেয়াল ছিল না যে , দরজা খোলা । বড়োবাবু এলেন । গর্জন করে উঠলেন , “ কী হচ্ছে রে। ”
ছেলেটার বুক কেঁপে উঠল , মুখ হল ফ্যাকাশে । ছবি কোথায় লুকোবে তার জায়গা পায় না। বড়োবাবু স্পষ্ট বুঝতে পারলেন , পরীক্ষায় চুনিলালের ইতিহাসে তারিখ ভুল হচ্ছে তার কারণটা কোথায় । ইতিমধ্যে চুনিলাল ছবিটাকে তার জামার মধ্যে লুকোবার ব্যর্থ প্রয়াস করাতে অপরাধ আরও প্রকাশমান হয়ে উঠল । টেনে নিয়ে গোবিন্দ যা দেখলেন, তাতে তিনি আরও অবাক — এটা ব্যাপারখানা কী। এর চেয়ে যে ইতিহাসের তারিখ ভুলও ভালো । ছবিটা কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেললেন । চুনিলাল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ।
সত্যবতী একাদশীর দিন প্রায় ঠাকুরঘরেই কাটাতেন । সেইখান থেকে ছেলের কান্না শুনে ছুটে এলেন । ছবির ছিন্ন খণ্ডগুলো মেঝের উপর লুটোচ্ছে আর মেঝের উপর লুটোচ্ছে চুনিলাল । গোবিন্দ তখন ইতিহাসের তারিখ-ভুলের কারণগুলো সংগ্রহ করছিলেন অপসারণের অভিপ্রায়ে ।
সত্যবতী এতদিন কখনো গোবিন্দর কোনো ব্যবহারে কোনো কথা বলেন নি । এঁরই ‘ পরে তাঁর স্বামী নির্ভর স্থাপন করেছেন , এই স্মরণ করেই তিনি নিঃশব্দে সব সহ্য করেছেন । আজ তিনি অশ্রুতে আর্দ্র , ক্রোধে কম্পিত কণ্ঠে বললেন , “ কেন তুমি চুনির ছবি ছিঁড়ে ফেললে । ”
গোবিন্দ বললেন , “ পড়াশুনো করবে না ? আখেরে ওর হবে কী । ”
সত্যবতী বললেন, “ আখেরে ও যদি পথের ভিক্ষুক হয় সেও ভালো। কিন্তু, কোনোদিন তোমার মতো যেন না হয়। ভগবান ওকে যে সম্পদ দিয়েছেন তারই গৌরব যেন তোমার পয়সার গর্বের চেয়ে বেশি হয়, এই ওর প্রতি আমার , মায়ের আশীর্বাদ। ”
গোবিন্দ বললেন , “ আমার দায়িত্ব আমি ছাড়তে পারব না , এ চলবে না কিছুতেই । আমি কালই ওকে বোর্ডিঙ-স্কুলে পাঠিয়ে দেব — নইলে তুমি ওর সর্বনাশ করবে । ”
বড়োবাবু আপিসে গেলেন । ঘনবৃষ্টি নামল , রাস্তা জলে ভেসে যাচ্ছে ।
সত্যবতী চুনির হাত ধরে বললেন , “ চল্ , বাবা । ”
চুনি বললে , “ কোথায় যাবে , মা । ”
“ এখান থেকে বেরিয়ে যাই । ”
রঙ্গলালের দরজায় এক-হাঁটু জল । সত্যবতী চুনিলালকে নিয়ে তার ঘরে ঢুকলেন ; বললেন , “ বাবা , তুমি নাও এর ভার । বাঁচাও এ ‘ কে পয়সার সাধনা থেকে । ”
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।