ক্ষুধিত পাষাণ–৪য় পর্ব–রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কটাক্ষের আঘাত । কী অসীম ঐশ্বর্য , কী অনন্ত কারাগার । দুই দিকে দুই দাসী বলয়ের হীরকে বিজুলি খেলাইয়া চামর দুলাইতেছে । শাহেনশা বাদশা শুভ্র চরণের তলে মণিমুক্তাখচিত পাদুকার কাছে লুটাইতেছে ; বাহিরের দ্বারের কাছে যমদূতের মতো হাবশি দেবদূতের মতো সাজ করিয়া , খোলা তলোয়ার হাতে দাঁড়াইয়া । তাহার পরে সেই রক্তকলুষিত ঈর্ষাফেনিল ষড়যন্ত্রসংকুল ভীষণোজ্জ্বল ঐশ্বর্যপ্রবাহে ভাসমান হইয়া , তুমি মরুভূমির পুষ্পমঞ্জরী কোন্‌ নিষ্ঠুর মৃত্যুর মধ্যে অবতীর্ণ অথবা কোন্‌ নিষ্ঠুরতর মহিমাতটে উৎক্ষিপ্ত হইয়াছিলে।

এমন সময় হঠাৎ সেই পাগলা মেহের আলি চীৎকার করিয়া উঠিল , “ তফাত যাও , তফাৎ যাও । সব ঝুট হ্যায় , সব ঝুট হ্যায় । ” চাহিয়া দেখিলাম , সকাল হইয়াছে ; চাপরাশি ডাকের চিঠিপত্র লইয়া আমার হাতে দিল এবং পাচক আসিয়া সেলাম করিয়া জিজ্ঞাসা করিল , আজ কিরূপ খানা প্রস্তুত করিতে হইবে ।

আমি কহিলাম , না , আর এ বাড়িতে থাকা হয় না । সেইদিনই আমার জিনিসপত্র তুলিয়া আপিস-ঘরে গিয়া উঠিলাম । আপিসের বৃদ্ধ কেরানি করিম খাঁ আমাকে দেখিয়া ঈষৎ হাসিল । আমি তাহার হাসিতে বিরক্ত হইয়া কোনো উত্তর না করিয়া কাজ করিতে লাগিলাম ।

যত বিকাল হইয়া আসিতে লাগিল ততই অন্যমনস্ক হইতে লাগিলাম — মনে হইতে লাগিল , এখনই কোথায় যাইবার আছে — তুলার হিসাব পরীক্ষার কাজটা নিতান্ত অনাবশ্যক মনে হইল , নিজামের নিজামতও আমার কাছে বেশি কিছু বোধ হইল না — যাহা-কিছু বর্তমান , যাহা-কিছু আমার চারি দিকে চলিতেছে ফিরিতেছে খাটিতেছে খাইতেছে সমস্তই আমার কাছে অত্যন্ত দীন অর্থহীন অকিঞ্চিৎকর বলিয়া বোধ হইল ।

আমি কলম ছুঁড়িয়া ফেলিয়া , বৃহৎ খাতা বন্ধ করিয়া তৎক্ষণাৎ টম্‌টম্‌ চড়িয়া ছুটিলাম । দেখিলাম টম্‌টম্‌ ঠিক গোধূলিমুহূর্তে আপনিই সেই পাষাণ-প্রাসাদের দ্বারের কাছে গিয়া থামিল । দ্রুতপদে সিঁড়িগুলি উত্তীর্ণ হইয়া ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিলাম ।

আজ সমস্ত নিস্তব্ধ । অন্ধকার ঘরগুলি যেন রাগ করিয়া মুখ ভার করিয়া আছে । অনুতাপে আমার হৃদয় উদ্‌‍বেলিত হইয়া উঠিতে লাগিল , কিন্তু কাহাকে জানাইব , কাহার নিকট মার্জনা চাহিব খুঁজিয়া পাইলাম না । আমি শূন্য মনে অন্ধকার ঘরে ঘরে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম । ইচ্ছা করিতে লাগিল একখানা যন্ত্র হাতে লইয়া কাহাকেও উদ্দেশ করিয়া গান গাহি ; বলি , ‘ হে বহ্নি , যে পতঙ্গ তোমাকে ফেলিয়া পলাইবার চেষ্টা করিয়াছিল , সে আবার মরিবার জন্য আসিয়াছে। এবার তাহাকে মার্জনা করো , তাহার দুই পক্ষ দগ্ধ করিয়া দাও , ভষ্মসাৎ করিয়া ফেলো । ‘

হঠাৎ উপর হইতে আমার কপালে দুই ফোঁটা অশ্রুজল পড়িল । সেদিন আরালী পর্বতের চূড়ায় ঘনঘোর মেঘ করিয়া আসিয়াছিল । অন্ধকার অরণ্য এবং শুস্তার মসীবর্ণ জল একটি ভীষণ প্রতীক্ষায় স্থির হইয়া ছিল । জলস্থল আকাশ সহসা শিহরিয়া উঠিল ; এবং অকস্মাৎ একটা বিদ্যুদ্দন্তবিকশিত ঝড় শৃঙ্খলছিন্ন উন্মাদের মতো পথহীন সুদূর বনের ভিতর দিয়া আর্ত চীৎকার করিতে করিতে ছুটিয়া আসিল । প্রাসাদের বড়ো বড়ো শূন্য ঘরগুলো সমস্ত দ্বার আছড়াইয়া তীব্র বেদনায় হুহু করিয়া কাঁদিতে লাগিল ।

আজ ভৃত্যগণ সকলেই আপিস-ঘরে ছিল , এখানে আলো জ্বালাইবার কেহ ছিল না । সেই মেঘাচ্ছন্ন অমাবস্যার রাত্রে গৃহের ভিতরকার নিকষকৃষ্ণ অন্ধকারের মধ্যে আমি স্পষ্ট অনুভব করিতে লাগিলাম — একজন রমণী পালঙ্কের তলদেশে গালিচার উপরে উপুড় হইয়া পড়িয়া দুই দৃঢ়বদ্ধ মুষ্টিতে আপনার আলুলায়িত কেশজাল টানিয়া ছিঁড়িতেছে , তাহার গৌরবর্ণ ললাট দিয়া রক্ত ফাটিয়া পড়িতেছে, কখনো সে শুষ্ক তীব্র অট্টহাস্যে হা হা করিয়া হাসিয়া উঠিতেছে , কখনো ফুলিয়া ফুলিয়া ফাটিয়া ফাটিয়া কাঁদিতেছে , দুই হস্তে বক্ষের কাঁচুলি ছিঁড়িয়া ফেলিয়া অনাবৃত বক্ষে আঘাত করিতেছে , মুক্ত বাতায়ন দিয়া বাতাস গর্জন করিয়া আসিতেছে এবং মুষলধারে বৃষ্টি আসিয়া তাহার সর্বাঙ্গ অভিষিক্ত করিয়া দিতেছে।

সমস্ত রাত্রি ঝড়ও থামে না, ক্রন্দনও থামে না। আমি নিষ্ফল পরিতাপে ঘরে ঘরে অন্ধকারে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। কেহ কোথাও নাই ; কাহাকে সান্ত্বনা করিব । এই প্রচণ্ড অভিমান কাহার । এই অশান্ত আক্ষেপ কোথা হইতে উত্থিত হইতেছে।

পাগল চীৎকার করিয়া উঠিল, “ তফাত যাও , তফাত যাও! সব ঝুট হ্যায় , সব ঝুট হ্যায়।”

দেখিলাম ভোর হইয়াছে এবং মেহের আলি এই ঘোর দুর্যোগের দিনেও যথানিয়মে প্রাসাদ প্রদক্ষিণ করিয়া তাহার অভ্যস্ত চীৎকার করিতেছে। হঠাৎ আমার মনে হইল , হয়তো ঐ মেহের আলিও আমার মতো এক সময় এই প্রাসাদে বাস করিয়াছিল , এখন পাগল হইয়া বাহির হইয়াও এই পাষাণ-রাক্ষসের মোহে আকৃষ্ট হইয়া প্রত্যহ প্রত্যুষে প্রদক্ষিণ করিতে আসে।

আমি তৎক্ষণাৎ সেই বৃষ্টিতে পাগলার নিকট ছুটিয়া গিয়া তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম , “ মেহের আলি , ক্যা ঝুট হ্যায় রে ?”

সে আমার কথায় কোনো উত্তর না করিয়া আমাকে ঠেলিয়া ফেলিয়া অজগরের কবলের চতুর্দিকে ঘুর্ণমান মোহাবিষ্ট পক্ষীর ন্যায় চীৎকার করিতে করিতে বাড়ির চারি দিকে ঘুরিতে লাগিল । কেবল প্রাণপণে নিজেকে সর্তক করিবার জন্য বারংবার বলিতে লাগিল, “ তফাত যাও , তফাৎ যাও , সব ঝুঁট হ্যায় , সব ঝুঁট হ্যায়।”

আমি সেই জলঝড়ের মধ্যে পাগলের মতো আপিসে গিয়া করিম খাঁকে ডাকিয়া বলিলাম, “ ইহার অর্থ কী আমায় খুলিয়া বলো।”

বৃদ্ধ যাহা কহিল, তাহার মর্মার্থ এই : একসময় ঐ প্রাসাদে অনেক অতৃপ্ত বাসনা , অনেক উন্মত্ত সম্ভোগের শিখা আলোড়িত হইত — সেই-সকল চিত্তদাহে , সেই-সকল নিষ্ফল কামনার অভিশাপে এই প্রাসাদের প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ড ক্ষুধার্ত তৃষার্ত হইয়া আছে; সজীব মানুষ পাইলে তাহাকে লালায়িত পিশাচীর মতো খাইয়া ফেলিতে চায় । যাহারা ত্রিরাত্রি ঐ প্রাসাদে বাস করিয়াছে , তাহাদের মধ্যে কেবল মেহের আলি পাগল হইয়া বাহির হইয়া আসিয়াছে , এ পর্যন্ত আর কেহ তাহার গ্রাস এড়াইতে পারে নাই ।

আমি জিজ্ঞাসা করিলাম , “ আমার উদ্ধারের কি কোনো পথ নাই।”

বৃদ্ধ কহিল , “ একটিমাত্র উপায় আছে তাহা অত্যন্ত দুরূহ । তাহা তোমাকে বলিতেছি — কিন্তু তৎপূর্বে ঐ গুলবাগের একটি ইরানী ক্রীতদাসীর পুরাতন ইতিহাস বলা আবশ্যক । তেমন আশ্চর্য এবং তেমন হৃদয়বিদারক ঘটনা সংসারে আর কখনো ঘটে নাই।”

এমন সময় কুলিরা আসিয়া খবর দিল , গাড়ি আসিতেছে । এত শীঘ্র ? তাড়াতাড়ি বিছানাপত্র বাঁধিতে বাঁধিতে গাড়ি আসিয়া পড়িল । সে গাড়ির ফার্স্ট্‌ ক্লাসে একজন সুপ্তোত্থিত ইংরাজ জানলা হইতে মুখ বাড়াইয়া স্টেশনের নাম পড়িবার চেষ্টা করিতেছিল , আমাদের সহযাত্রী বন্ধুটিকে দেখিয়াই ‘ হ্যালো ‘ বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিল এবং নিজের গাড়িতে তুলিয়া লইল । আমরা সেকেণ্ড ক্লাসে উঠিলাম। বাবুটি কে খবর পাইলাম না , গল্পেরও শেষ শোনা হইল না।

আমি বলিলাম লোকটা আমাদিগকে বোকার মতো দেখিয়া কৌতুক করিয়া ঠকাইয়া গেল ; গল্পটা আগাগোড়া বানানো।

এই তর্কের উপলক্ষে আমার থিয়সফিস্ট আত্মীয়টির সহিত আমার জন্মের মতো বিচ্ছেদ ঘটিয়া গেছে।

গল্পের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!