ত্রিশষ্কুর নকল স্বর্গ–বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্র

লোকে কোথায় বলে আমার অবস্থা ত্রিশষ্কুর মত।মানে-না এ-দিক,না ও-দিক।মধ্যিখানে ভ্যাবাগঙ্গারাম হয়ে বসে থাকে।যেমন আজকাল বড়লোকের অবস্থা হয়েছে-তারা না বড়োলোক না একে বারে শ্রমিক।সমাজে মধ্যিখানে বসে তারা দুইদিকের ধাক্কাখাচ্ছে।ত্রিশষ্কুর অবস্থাও একদিক তাই হয়েছিল।ত্রিশষ্কুর ছিলেন একজন সেকালের মস্ত বড় রাজা।দু,তিন বছর পড়ে তিনি একটা না একটা যজ্ঞ করতেন।আর সেই উপলক্ষে ব্রাক্ষণ ও প্রজাদের যেমনি খাওয়াতেন-দাওয়াতেন,তেমনি দক্ষিনাও দিতেন।লোকে একে বারে রাজার নাম নিয়ে ধন্য ধন্য করে বেড়াত।ব্রাক্ষণ বাড়ি ফেরার সময় পুটলি-পটলা বেধে খুশি মনে রাজাকে আশির্বাদ করতেন-মহারাজ,আপনি গত জন্মের পুন্যফলে সশরীরে স্বর্গবাস হবে।বলে যাচ্ছি।একথা শুনে মহারাজ ত্রিশষ্কু তো আহ্লাদে ডগমগ-সশরীরে স্বর্গবাস বড় চারট্টিখানি কথা নয়,একে বারে দেবরাজ ইন্দ্রের সিংহাসনের পাশে গিয়ে বসবেন,চিরকাল মহা আনন্দে অমৃত ভোগ খেয়ে,প্রত্যক সন্ধ্যেবেলা নাচ-গানের জলসা শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে থাকবেন,মুনি ঋষিরাও হাত জোর করে সামনে তাকিয়ে থাকবেন,এটা সহজ কথা নয়।
ব্রাক্ষণদের কথার একটা দাম আছে নিশ্চয়-সশরীরে তিনি তাহলে যাবেন-পৃথিবীতে মরবার সময় আর অসুখে-বিসুখে ভুগতে হবে না,দাঁত চিরকুট অঙ্গাণ হয়ে পড়ে থাকতে হবে না,একেবারে গটমট করতে করতে শ্বর্গে চলে যাবেন।এই ভাবতে ভাবতে রাজা ত্রিশষ্কু একদিন তার প্রধানমন্ত্রীকে ডেকে বলে উঠলেন-আচ্ছা মন্ত্রি ব্রাক্ষনরা প্রায়ই বলে,যে আমি নাকি এ জন্মে যে সব পূর্ণ কাজ করেছি তার ফলে আমি নাকি শ্বর্গে যাব এটাকি ঠিক?
রাজার কথা শুনে মন্ত্রি হেসে বললে না মাহারাজ,মর্ত্তের দেহ নিয়ে শ্বর্গে জাওয়া যায় না।শুনেছি যোগী পূরুষেরা নাকি ইচ্ছে করলে মর্ত্তের দেহ থেকে বেরিয়ে অন্য আর একটা দেহ নিয়ে শ্বর্গে ঘুরেব আসেন কিন্তু আপনার পক্ষে সেটা সম্ভব হবে না।তবে দেহ ত্যাগের পর হয়তো শ্বর্গে আপনি যেতে পারেন।
ত্রিশষ্কু মন্ত্রীর কথা শুনে মহা চটে গেলেন-বললেন,তুমি কি তাহলে বলতে চাও ব্রাক্ষণরা যা বলেছি সব মিথ্যা কথা তাদের আর্শিবাদে কোন জোর নেই?
মন্ত্রী থমথম খাবার লোক নয়,তিনি গভীর ভাবে অথচ বিনীতভাবে বললেন তাঁকে-ব্রাক্ষনরা আপনাকে খোশামুদি করে ও-কথাগুলো বলে গেছেন-ওসব কথা ধরবেন না।
ত্রিশষ্কু আরও চটে মন্ত্রিকে বলে উঠলেন-তুমি একটা নির্বোধ-কোন জ্ঞান নেই তোমার।তোমার সামনে দিয়ে আমি সশরীরে স্বর্গে যাবই-দেখো
সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রী বলে উঠলেন-মহারাজ আপনি যদি সত্যি সশরীরে শ্বর্গে যান,আর তা দেখবার ভাগ্য যদি আমার হয়,তাহলে আমিও জানবো যে বহু জন্মের পুন্যফলে এমন ঘটনা চাক্কুস দেখলাম।তবে শ্বর্গে যাবার পূর্বে ও খানকার পথঘাট কিছু জেনে রাখা ভাল বোধহয় ভাল-কারণ,তাহলে আর কোথাও বাঁধা পাবে না।রাজা চিন্তাকরে বলেন-হ্যাঁ,ও কথাটা তুমিই ভালই বলেছ,পথঘাট সম্ভন্ধে আগে থেকে জেনে রাখা ভাল।কিন্তু তুমি কোন হদিস জান না।এখন এমন কাউকে জান,যিনি এ বিষয়ে কিছু বলে দিতে পারবেন?
মন্ত্রী বললেন-জানি বৈ কি,তাঁকে আপনি ভাল রকমে জানেন-আপনার কুলপুরোহিত মহষী বশিষ্ট দেবের তোঁ সব কিছু ঠিক বলেছে।রাজা তখনি দুতের মারফাত পুরোহিত কে ডেকে পাঠালেন।মহষি এসে পৌঁছালেন সন্ধ্যে বেলায়।রাজা সিংহাসন থেকে নেমে,তাঁকে খুন খাতির যত্ন করে একটা আসনে বসিয়ে বললেন,গুরুদব,একটা বিশেষ প্রয়োজন আপনাকে আমি ডেকে পাঠিয়েছি।আমি সশরীরে শ্বর্গে যেতে চাই,এটা কি হতে পারে? বশিষ্ঠদেব বললেন হ্যাঁ-নিশ্চয় হতে পারে,-যদি তুমি রাক্ষস যজ্ঞ কর।তাহলে তার দ্বারা এটা সম্ভব হতে পারে,কিন্তু তার ফল খুব ভাল হয়না।
রাজা জিজ্ঞেস করলেন কেন?
বশিষ্ঠদেব বললেন-তার কারণ,অনেকটা বিনা নিমন্ত্রে অনধিকার প্রবেশের মত।তোমার মনকে পূর্ণভাবে সেখানকার পরিবেশ মত গড়ে নেবার পূর্বেই যদি যাও,তাহলে স্বর্গরাজ্যে তুমি পৌছবে ঠিকই কিন্তু তুমি সমাদর পাবে না।
ত্রিশষ্কু বলে উঠলেন-সমাদর পায় কি না সে পড়ে দেখাযাবে।আগে টো গিয়েই পৌছুই।আপনি রাক্ষন-যজ্ঞের জন্য কি করতে হবে,আনতে হবে,তার ফর্দ্দ দিন,আর নিজে এসে সেই যজ্ঞের পুরোহিত হয়ে জান,এই আমার অনুরোধ।বশিষ্ঠদেব মাথা নেড়ে বললেন-বৎস ত্রিশষ্কু,এসব যজ্ঞ আমরা করি না।তুমি আমাকে দ্বিতীয় বার যজ্ঞ করার কথা বল না।এই কথা বলে ঋষিবর চলে গেলেন।
ত্রিশষ্কু বশিষ্ঠদেবের উপর চটে গেলেন খুব।মনে মনে তার ধারণা হল যে,তিনি ইচ্ছা করে আমার সশরীরে যেতে দেবেন না বলেই আমার জন্য যজ্ঞ করল না।কিন্তু সশরীরে স্বর্গে আমাকে যেতেই হবে।বেশী দিন থাকতে পারি আর না পারি,অন্ততঃএক পাক ঘুরে দেখে আসব।কিন্তু ঋষিদের সাহাজ্য না ছাড়া স্বর্গে যাওয়ার কোন উপায় নেই।সুতরাং এক রিষির সন্ধান করতে হবে।কিন্তু তেমন রিষি আছে কই।সেই কথা ভাবতে ভাবতে তার মনে পড়ে গেল রিষি বিশ্বামিত্রের কথা।অদ্ভুত শক্তিমান রিষি;ক্ষত্রিয় থেকে জোরে রিষি হয়ে গেছেন,তার উপর বশিষ্ঠদেব কে দু চক্ষে দেখতে পারে না-অকেই আনা যাক!যেমনি ভাব তেমনি কাজ-বিশ্বামিত্রকে খাতির করে নিয়ে এল তিনি।বিশ্বমিত্রিক জিজ্ঞাসা করলেন-কি জন্য আমার নিয়ে এসেছ বৎস?ত্রিষ্কু বললেন-ঋষির,আমি সশরীরে শ্বর্গে যাবার জন্য বড় ব্যস্ত হয়ে পড়েছি।কিন্তু কিছুতেই যাবার সুবিধা পাচ্ছিনা।তন্ত্র-মন্ত্রে রাক্ষস-যজ্ঞ না করলে সেখানে তো জাওয়া যাবে না।কিন্তু আমার পুরোহিত বশিষ্ঠদেব দেব কে যজ্ঞ করতে বলায় তিনি বলে দিলেন,তুমি এখনও উপযুক্ত হও নি।সুতরাং তোমার জন্য আমি যজ্ঞ করতে পারব না।বিশ্বমাত্রিক সব শুনে বললেন-বশিষ্ঠদেবকে আমি চিনি না? বিটলে বজ্জাত,কুখ তিপে থাকে,পাছে তুমি সশরীরে স্বর্গে যাও সেটা ও সইতে পারল না আর কি!ওকে আগে তাড়াও-তার পর আমি তোমার প্রধান ঋত্বিক হয়ে যজ্ঞ করব।সঙ্গে সঙ্গে বশিষ্ঠ কুল পুরোহিত পদ থেকে সরে গেলেন আর সেই যায়গায় প্রজাদের সামনে বিশ্বমাত্রিকে পৌরহিত্য করার জন্য রাজা তাকে বরণ করে নিলেন।
পনেরো দিন রাক্ষস-যজ্ঞ শুরু হয়ে গেল।তিন মাস ধরে যজ্ঞ চলল-হৈ হৈ কাণ্ড!শেষ আহুতি দেবার পর দেখা গেল,রাজা ত্রিশষ্কু সড় সড় করে আকাশে দিকে উঠছেন।কপিকল নেই,দড়ি নেই,চড় চড় করে যেন তাঁকে আকাশের দিকে টেনে তুলছে- আর বিশ্বমাত্রিক চিৎকার করে মন্ত্র পড়ে চলেছেন।সবাই তো হা হয়ে গেল ব্যাপার দেখে।সকলের মুখে মহারাজের জয়ধ্বনি শোনাযেতে লাগল-তার পর তিনি শূন্যে মিলিয়ে গেলেন।হঠাৎ অদৃশ্য শূন্য লোক থেকে একটা চিৎকার ভেসে এল,মহারাজ ত্রিশষ্কু চেঁচাছেন-মনিবর,মনিবর আমি গেছি,আমি গেছি।
-কি ব্যাপার?
মহারাজ বলতে লাগলেন আর ব্যাপার উপর থেকে দেবরাজ ইন্দ্রা আমায় ঠেলে দিয়ে নিচের দিকে পাঠিয়ে দিচ্ছেন।বিশ্বমাত্রিক বললেন-আচ্ছা আমি ইন্দ্রের কারদানি বার করছি!বলে আবার একটা মন্ত্র বলতে শুরু করলেন,ত্রিশষ্কু আবার চড় চড় করে উপরে উঠতে লাগলেন।দেবরাজ তখন চন্দ্র,বরুণ যম সবাই কে নিয়ে মারলেন এক ধাক্কা। ত্রিশষ্কু মাটিতেই আছাড় খেয়ে পড়েন বুঝি বা!কিন্তু বিশবমাত্রিক সোজা লোক নন,হুং হাং করে কি একটা মন্ত্র বলতেই সড়াৎ করে তিনি আবার স্বর্গের দরজায় পৌছে গেলেন কিন্তু দেবরাজ বাজ নিয়ে তারা করলেন তাঁকে।তখন হাত পা ছেড়ে মাটিতে হুবড়ি খেয়ে পড়েন আর কি! দু,দিন ধরে টাগ-অফ-ওয়ার চলল।তখন ত্রিশষ্কু প্রানের দায়ে বলে উঠলেন-কভি নেহি,মানে ডাঁড়াও!যে শূন্য লোকে তুমি র‍্যেছ ঐখানে আমি নতুন স্বর্গ,নতুন নক্ষত্র-লোক সৃষ্টি করছি,বলে সত্যি সত্যি স্বর্গ ও মর্তের মাঝা মাঝি যায়গায় অনস্ত শূন্যলোকে একটি নকল স্বর্গ ছেড়ে দিলেন।শোনা যায় সেখানেই নাকি মহারাজ ত্রিশষ্কু আজও ঝুলে রয়েছেন।কেমন আছেন সে খবর টা কিন্তু কোথাও লেখা নেই!-

দুঃখিত!