হয়তো সে জানে আমি তা জানি না। জানে বলেই যখনই দেখা হয় গভীর মমতায় দৃষ্টি ছুঁড়ে দু’হাতে হাত চেপে ধরে প্রায় বিগলিত কণ্ঠে বলে, কায়েস, তরা ছয়টা ভাই, পথে ঘাটে দেখা হইলে আমারে কত সম্মান করস, আর ওই মিয়াবাড়ির মশি – আদাপ সালাম দেওয়া তো দূরের কথা, গায়ে গায়ে গুতা লাগলেও মুখে টু শব্দটা পর্যন্ত করে না। এই মালঞ্চ গাঁয়ে অর চাইতে কত বড় বড় বয়সের, কত বড় বড় চাকরির মানুষ আমারে সালাম দেয়, সম্মান করে । অয় করে না। আমি কই, অর অত অহংকার কিসের? অয় কি নিজেরে তগো চাইয়া বড় মনে করে? তরা যেইহানে কয় হাত দূরে থেইকা আমারে ঠাউর করস ;অয় করে উল্টাডা। পারলে দেইখাও না দেখার ভাঁন করে। আসলে কি অয় বড়? কই, আমার দোষটা কিসের? ভালোমতন ভাইবা চিন্তা ক দেহি। মানুষরে সম্মান করলে নিজের সম্মান বাড়ে নাকি কমে, ক দেহি। কী? ভাইবা কী খুঁইজা পাইলি? খুৃঁইজা পাইলি কোন দোষ? পাইলে ক হুনি দুই চাইরডা।
না না, কোন দোষ নাই আপনার। আমি তার মুখমণ্ডলে গভীর দৃষ্টি ছুঁড়ে বলি।
তার সংক্ষিপ্ত গ্রীবা- ভারিক্কি খাটখামিজা শরীর, গোলগাল মুখমণ্ডল, থুতনিল্যাপ্টা দাড়ি, নাতিদীর্ঘ চোখা নাক, থ্রি-কোয়ার্টার টাক মাথা , উজ্জ্বল শ্যামলা রঙ, পুরু জোড়া ভ্রু, ভাসা ডাগর চোখ -কী প্রসন্নতায় পুরু ঠৌঁটে মৃদু হাসির ঝিলিক খেলে যায়। সে নিমিষে মুখমণ্ডলে বিষণ্ণতার ছায়া টেনে কৌতূহলোদ্দীপক কণ্ঠে বলে, মশি তালি আমারে সম্মান করে না ক্যান? নাকি আমি বুড়া হইছি বইলা হেলা করে? কী রহস্য আদতে ক দেহি।
কী জানি নানা, বলতে তো পারছি না। অন্যের মনের কথা, কিভাবে ধরব?
আমি কই -মানুষরে সম্মান করলে নিজের সন্মান বাড়ে বৈ কমে না, কী মনে করস?
কথা ঠিকই।
শোন, এইযে এত ভক্তি করস, তাতে কি তদের মান কিঞ্চিৎকরও খাটো হইছে? বলতে পারবি সেই কথা?
কি জানি , এমন কথার উত্তর কী করে জানব? আপনি মুরুব্বি মানুষ – সম্মান করা কর্তব্য, করি। তাতে আমরা খাটো হই কি না – ভাবনায় তো আসে না।
মাঝে তো গাঁয়ে ছিলি না; তর ছোট নানীর লগে কি পয়পরিচয় হইছে? কথাবাত্রা?
না, হয় নাই পরিচয়।
বাড়িতে একবার আসিস। তার হাতের এক খিলি পান খাইয়া যাইস। নুরানি জর্দায় ভালো খিলি বানায় সে।
সময় পেলে আসব।
যা এইবার। মনে রাখিস, অন্যরে সম্মান দিলে নিজের সম্মান কোনদিন কমে না। অন্যরে তাই সম্মান দিবি। আমার মতো অনাত্মীয়রেও। কোনদিন অহংকার মনে আনবি না। অহংকার পতনের মুল। এগুলান কথা তুই জানস। জানস বইলাই না আমারে এত –।
জি, স্লামালিকুম, যাই নানা, এখন।
ওয়ালাইকুম —-। মশি– – -বদমাই– টা– আমা-
সে মিয়াবাড়ির মশির নামে কী সব বিড়বিড় করতে করতে চলে যায়। আমি আনমনে পথ হাঁটি। হাঁটার ফাঁকে প্রতিবারেই ভাবি, হ্যাঁ এমন আলোচনার পর প্রতিবারেই নির্ঘাৎ ধরে নেয়া চলে, আমার জানার বিষয়টি অবশ্যই সে জানে না। অথচ আমি তা জানি। কী জানি?
কী জানি আমি তার সম্পর্কে, যা সে জানলে কিংবা বুঝলে ভুল ধারণায় আমার অকৃত্রিম সম্মান দেখানোটাকেও নিখাঁদ অভিনয় বলে ধরে নিয়ে নিশ্চুপ মৌনমুখ অতিক্রম করে যেত? জানে না বলেই প্রতিবারে সে সামনে গাছিয়ে এভাবে একান্তে সম্মানের আকুতি করে, প্রাপ্ত সম্মানের প্রশংসা করে- এই বিশ্বাস মনেপ্রাণে ধারণ করি।
তার সংক্রান্ত সেই নিগুঢ় রহস্যটির কথা আমি জানি। তবে খুব যে ভালো জানি তা-ও নয়। আসলে সত্যিকারে জানার জন্য জানার চেয়ে বোঝার গুরুত্বটাই বেশি। আর আমি তা ঠিক সময়ে যথার্থই বুঝে নিয়েছিলাম। সেই সন্ধ্যাটিতে আমি যে শহরে নয়, বরং নিজ বাড়িতেই ছিলাম, সেই খবরটা আজ পর্যন্তও তার জানা নেই বলেই হয়তো বা সে জানে আমি তা জানি না। অথচ আমি তা খুব ভালো করেই জানি। উপলব্ধি বা বোধ থেকে জানি। কী সেই উপলব্ধি তথা বোধ? এতক্ষণের তাবৎ ঘোরপ্যাচ- গড়িমসি ছেড়ে এবারে মোদ্যকথায় নামি।
সেদিন সন্ধ্যার ঘনান্ধকারের সাথে আমাদের কিছু ঐচ্ছিক ক্রিয়াকলাপ যুক্ত হয়ে ভীষণ ছায়াচ্ছন্ন, দুর্ভেদ্য করে রেখেছিল আমাদের তামাম বাড়িটিকে। গোটা আঙিনা কালো, প্রতিটি ঘর ভুতুড়ে অবয়বে নৈঃশব্দ্যে ডুবন্ত । আসলে ইচ্ছে করেই কোন ঘরে বাতি জ্বালানো হয়নি, যাতে সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে বাড়ি আমাদের শুন্য, জনমানবহীন। কিন্তু তার প্রারম্ভিক মনোভাব মতে পরিকল্পনা ব্যর্থ আমাদের। কারণ, বাড়িতে পা রেখে তেমন বিশ্বাস আদৌ জাগেনি তার মনে। তাই অন্ধকার আঙিনায় বসে ঘোৎ ঘোৎ করতে থাকে সে। ঘরের কোনায় মাকে উদ্দেশ্য করে বাবা খুব চাপাস্বরে বলেন, শোনো, কবিয়াল কদম আলী যতই কাকুতি মিনতি করুক, চুপ করে থাকবে, যাতে সে বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় আমরা কেউ বাড়িতে নেই। বসে থাকতে থাকতে অধীর হয়ে একসময় বিদায় হবে। আর কায়েস যেন কিছুতে ঘর থেকে বের না হয়। কিছুতে যেন তার বাড়ির চৌসীমানার পথ ধরে কোথাও হাঁটাহাঁটি করতে না যায়। ওকে কড়া ভাষায় বলে রাখো।
আসলে কী সমস্যা তার? কেন ওভাবে ডাকাডাকি করে? কোন বিপদআপদ কি হইছে? মা খুব সতর্ক ক্ষীণ স্বরে বলেন।
সে কথা বলা যাবে না। ভ্যাজাইল্যা লোক। এমন লোকের কথায় দেন দরবারে যাওয়া চলে না, তা উপরে খায়খাতির যতই থাক। কায়েসকে নজরে রাখো, যাই। এটুকু বলে বাবা ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
অ কায়েসের মাও, কি গো মামনি! বাড়িত নাই নাকি তোমরা হগলতেই? আঁন্ধারের মইধ্যে বইয়া রইলাম এত সময় ধইরা। কোন সাড়াশব্দ নাই। বাপজান কি হাচাই বাড়িত নাই নাকি? কায়েস, অর ভাইয়েরা হগলতে? আল্লাহ মালিক। কই আছে নানা ভাইয়েরা হগলতে? বিষ্যুদবার আইজ, কায়েস বাড়ি আসে নাই?
আমরা আগের মতোই নিশ্চুপ। অন্ধকার আঙিনায় সে ঘনঘন হাই তোলা ও কষ্টাভিব্যক্তি সূচক শব্দপাতের সাথে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ছাড়তে থাকে । কোনও অব্যক্ত যন্ত্রণায় উ আ এর সাথে যেন হাত পা ছোড়ে বারবার।
বাবা আসলে তাকে এড়াতেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছেন। এশার আযান বাজতেই মা নিশ্চুপ জঁপকালেমায় বসে যান। বিছানায় ঘাপটি মেরে থেকে আমি আঙিনায় কদম আলীর ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ও ব্যথাতুর শব্দপাত শুনি । একসময় তার উঠে দাঁড়াবার আবহ টের পাই। বাবাজি কি আমার লগে পরতারণা করল- ফাঁকি দিল আমারে, কী রহস্য খাটল আইজ কপালে-উনা বাড়ি রাইখা সব গেছে কই, ও-উ-উ-হু প্রভৃতি বিড়বিড়ানো শব্দ বাক্যের সাথে সে দেউরি পেরোয়।
ঘরের ভেজানো দরজা নিঃশব্দে ঠেলে ত্বরিত বেরিয়ে পড়ি আমি। দ্রুত হেঁটে দেখি, এরই মধ্যে দেউরি পেরিয়ে বার আঙিনার প্রায় মাঝামাঝি পৌঁছে গেছে কদম আলী । তার খর্বদেহটি শীঘ্রই খড়ের গাদা পেরিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে যায়। তার পিছু নিতে দ্রুত অথচ খুব সন্তর্পণে পা চালাই আমি। মনে প্রশ্নঝড় – কী ঘটনার অবতারণা ঘটবে তার বাড়ির চৌসীমানায় সন্ধ্যায় আজ? কেন বাবা তার এতটা কাকুতি মিনতিতেও তার ডাকে সাড়া না দিয়ে বাড়ি থেকে নিভৃতে সরে পড়লেন? আমারই বা কেন তার বাড়ির চৌসীমানা ধরে কোনদিকে হাঁটতে যাওয়া পর্যন্ত নিষিদ্ধ? কিসের কারণে এতটা কড়াকড়ি? কৌতুহলের উদ্রেকটা মুলত এখানেই। তারই নিবৃত্তি প্রেষণায় এই নীরব অনুসরণ।
আঙিনা ছেড়ে সরু পথ ধরতেই নিকশ অন্ধকার চোখের তারায় যেন আঁন্ধুটি টেনে দেয়। টানা ক’দিন শহরে কাটাবার পর আজই গাঁয়ে এসেছি বলেই বোধকরি দৃষ্টিধামে এই অসামঞ্জস্য। এরই মধ্যে চির অভ্যস্ত পায়ে বেশ কিছুদূর এগিয়ে গেছে কদম আলী। দেবদারু গাছগুলোর ঝোপ অতিক্রম করতেই দৈব আবির্ভূতের মতো একটা শক্ত হাত জোর সম্মুখ ধাক্কায় আমার গতি থামিয়ে দেয়। আমি ভয়ে লাফিয়ে উঠি। ফিসফিসানো কণ্ঠ বাজে হাতওয়ালার, ভয় নাই, চুপচাপ দাঁড়া । আমি ইফতেখারুল।
হ্যাঁ, বুঝেছি। আমিও ফিসফিসাই।
গলার স্বর তুলবি না। জিগাই, কই যাস এই আঁন্ধারে কদম আলীর পিছন পিছন?
কোথাও না। নিরুত্তাপ বলি আমি।
মানে? দিব্যি দেখতেছি কদম আলীর পিছ ধরছিস। বলতেছিস, কোথাও না। ব্যাপার কী? মাতবর সাজতে সাধ হইছে নাকি এই বয়সে?
আরে ধুর! হাঁটতে বার হইছি।
চুপ আহাম্মুক, মিথ্যা বলতেছস। ভাবছস আমি ধরতে পারব না। শোন, এত্তো গোয়েন্দাগিরির দরকার নাই। জলদি বাড়ি ফির।
আহা, কিসের গোয়েন্দাগিরি করব?
আবার মিথ্যা কথা! শোন, সব বয়সে সবসময় সব জায়গায় যাইতে নাই। নানান সমস্যা হইতে পারে ।
আহা, কিসের সমস্যা?
তর এত কিছু বুঝার দরকার নাই। সোজা বাড়ি যা।
অন্য কোন তাৎপর্যবহ কারণ থাকলেও থাকতে পারে, যা আমার তখন বোধগম্য নয়; তবে দৃশ্যমান অর্থে শুধু যেন বয়স অপরিপক্বতার অপরাধেই চাচাত ভাই ইফতেখারুল এর প্রবল বাধায় বাড়ির চৌহদ্দি থেকেই সে রাতে আমাকে ঘরে প্রত্যাবর্তন করতে হয়। এক রাতের ব্যবধানে সেই বয়সটা আমার না পেরোলেও পর দিন ঠিকই কানে ও বোধে ওঠে সে রাতে কী ঘটেছিল কদম আলীর বাড়িতে।
বাবা ও তার বন্ধুরা দূরে সরে থাকলেও থেমে থাকেনি কদম আলী। মাতবর ধরে এনেছিল সে ভিন গাঁ থেকে। তাদেরই মধ্যস্থতায় সাত সন্তানের জনক সপত্নিক কদম আলী নিকাযোগে বরণ করে নেয় ষোড়শী অনূঢ়া কৈতরীকে। কিন্তু কেন এই অসামঞ্জস্য? ষাট ষোড়শে কেন এই প্রহসন? এবার না হয় থাক। তারচে’ খানিকটা অগ্রবর্তী পর্বে ঢুঁ দেয়াই এ প্রেক্ষিতে আবশ্যক গন্য হয়ে দাঁড়ায়।
এ পর্ব কথা বছর দশেক পরের। পনেরো থেকে আমি এখন পঁচিশে। কৈতরী ষোলো থেকে ছাব্বিশে। শহর থেকে মাঝেসাঝে বাড়ি আসি মাস দুই চার পর পর। পুলিশ হাবিলদারের চাকরি আমার ; ছুটিছাটা প্রায় না মেলার পর্যায়ে। বছর দশেকে যতবার বাড়ি এসেছি, বন্ধুদের বরাতে কৈতরী সংক্রান্ত নানা কথাই কানে উঠেছে। কবিয়ালের সাথে তার সম্পর্কচ্ছেদ ঘটেছে অনেক আগেই। স্বভাবে কৈতরী পূর্ববৎ বারোয়ারীই আছে। যৌবনে এখন তার নিত্য নতুন খেয়াল। কোত্থেকে কী দাওয়াই সে নাকি নিয়েছে যে জীবনের সে রঙ খেয়াল তার কখনো নিঃশেষিত হবে না। কৈতরী – চির রঙে রঙিন কৈতরী, ক্লেশহীন, ক্ষয়হীন, চির যৌবনা কৈতরী- উচু গা, দুধেল ফর্সা রঙ, তীক্ষ্ণ নাসিকা, কোঁকড়া চুল, সুঢৌল বক্ষ, উগ্র পরিচ্ছদ, উচ্ছৃঙ্খল-বাক কৈতরী।
সরেজমিন পর্যবেক্ষণে ঝোপঝাড়ে গোল হয়ে বসা বখাটে দলের কাউকেই পাওয়া যায়নি, যায় না – যাদের নিত্যদিনের নিমগ্ন আলোকপাত, ভোগের স্বপ্ন-বিভোর রঙ্গরস কৈতরীবিহীন গেছে বা যায় । এই যে এত কথার শ্রুতি, এত গুঞ্জরণ, ঝোপঝাড়ময় এত না পাওয়া কিংবা প্রাপ্তি আকাঙ্ক্ষার হাহাকার – কিয়ৎ কৌতুহল জাগালেও কৈতরীকে আমি কোথাও নজরবাগে প্রত্যক্ষ করি না। জনশ্রুতি মতে সে নিশাচর, দিবা অবরুদ্ধ। অবশ্য বাইরে বেরোলে কদম আলীর সাথে বেশিরভাগ সময়ই দেখা সাক্ষাৎ হয়। তার আগের সে প্রাণচাঞ্চল্য আর নেই। তবে বিষণ্ন কিংবা অপ্রসন্ন দেখালেও সে আগের মতোই সম্মান অসম্মানের প্রসঙ্গ ঠিকই তোলে। আমার হাবিলদার( তার ভাষায় হাওয়ালদার) হবার সুবাদে মিষ্টিমুখ প্রত্যাশা করে। শুধু কৈতরী প্রসঙ্গে টু শব্দটি সে মুখে আনে না।
একবার দিন দুয়ের ছুটি মাথায় বাড়ি এসেছি। মাঝরাত। দরজায় টোকার শব্দে ঘুম ভেঙেছে নাকি ঘুম ভাঙার পর টোকার শব্দ শুনেছি, আজ আর সে কথা মনে নেই। সন্তর্পণে কান পেতে আবারও টোকার শব্দ শুনে আলস্য কণ্ঠে বলি, কে?
আমি মোস্তাক, ওঠ। স্কুল কলেজ সহপাঠী মোস্তাক চাপাস্বরে বলে।
মোস্তাক, কিরে? কী হয়েছে? আমি উদ্বেগে বলি।
আহা, দরজা খোল, কথা আছে।
কী ব্যাপার এত রাতে? সারাদিন না কত কথা বললাম!
এখন ভিন্ন কথা।
কী কথা?
আয় আগে, জরুরি কাজ আছে। আজ অবশ্যই ধরা চাই। না ধরাটাই অন্যায় হবে। চল জলদি।
আমি পুলিশের লোক। ধরা এবং অন্যায়- দুটি শব্দই মস্তিষ্কে সারাক্ষণ খেলে থাকে । উঁচু নাক, দীর্ঘদেহী, ধবধবে ফর্সা-টিঙটিঙে মোস্তাক নিজ জেলা কেন্দ্রিক এক এনজিওতে চাকরি করলেও একটা সময় পুলিশে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। আর বেশি উচ্চবাচ্য না করে গায়ে শার্ট চড়িয়ে বেরিয়ে পড়ি ঘর থেকে। খুব দ্রুত হাঁটতে শুরু করে মোস্তাক। ঢুলু চোখে ওকে অনুসরণ করতে থাকি আমি। গ্রামের ঘরবাড়ির চৌহদ্দি, উঁচু কাচা সড়ক ও হাটখোলা পেরিয়ে দু’ জন পৌঁছে গেলাম বিস্তৃত ফসলের মাঠে। অদূরে স্বল্প পানির বিল। এপাশে অগ্রহায়ণের ফসল সদ্যই উঠে গেছে। হালকা কুয়াশা শীতের আগমন বার্তাকে স্পষ্ট করে তুললেও অস্পষ্ট করে তুলেছে দূরের গাঁয়ের মাথায় সদ্য উঁকি দেয়া অসমবৃত্ত চাঁদকে। একটা উঁচুমত আলের ওপর আচমকা দাঁড়িয়ে গেল মোস্তাক। অস্ফুট বলল, দাঁড়া এখানে। বললাম, আচ্ছা কী ধরতে নিয়ে এলি এই উনো মাঠে?
আরে আয়, ওই যে কাশঝোপটা যে, ওর কাছাকাছি। চুপচাপ আয়, এত কথা বলিস না।
এই ফসলের মাঠ আমার কাছে বড় পবিত্র, বড় মধুরতম। প্রতি অগ্রহায়ণের রোদ ঝলমলে সকালে, লালচে রোদের গোধূলিতে আমি এর উঁচু আমন ধানের মায়ায় কী নিবিড় করে যে দীর্ঘক্ষণ দৃষ্টি ধরে পৃথিবীর নিষ্কলুষ রূপে একাকার হয়েছি! বর্ষার ভাসমান ক্ষেতসমূহে ঢি’ মেরে বিস্ময়ে দেখেছি কত না হাজার জলজ পাখির ঝাঁক। কখনো শীতের ভর দুপুরে নিমগ্ন হয়েছি বিস্তৃত হলুদ সর্ষে ফুলে, কখনো কলাই কুসুম ফুলে। আজ সেই পবিত্র শস্য ভূমিতে যে পরিপ্রেক্ষিত ঘিরে অদূরের ওই ঝোপের বিপরীতে দু’ বন্ধুতে মিলে স্থির দাঁড়িয়েছি, তা অতীতের ওই নিষ্কলুষ পটভূমিকার নিরিখে কতখানি সামঞ্জস্যের সে প্রশ্নঝড় বুকে তোলপাড় করতে শুরু করেছে মৃদু মৃূৃদু।
চাঁদ এখন গাঁয়ের মাথার হাত দুই ওপরে উঠে এসেছে। ওদিকের কুয়াশা কেটে তার গায়ের কলংকগুলো এখন সুস্পষ্ট। তীর্যক ছিটকে দেয়া আলোয় ওদিকের এতক্ষণের অস্পষ্ট দৃশ্যটি এখন স্পটতার কাছাকাছি হয়ে অস্পষ্ট হয়ে উঠেছে আবারও একদলা ভারী মেঘের আচ্ছাদনে। অস্ফুট বললাম, এ কী সব ব্যাপার? ভালো লাগছে না, চল ফিরে চল। একি ধরার কিছু হলো? ছিঃ!
তখনই ফিঁকে অন্ধকারে ধ্বস্তাধস্তি আক্রান্ত কৈতরীর চাপা কণ্ঠটি হাওয়ায় সঞ্চালিত হয়ে এলো এদিকে, ওইখানে দুইজন কারা?
কেউ না মাগী, চোপ! চোপ খানকি, আবার ওইদিকে চায়! মাগী তর- –
আমি জানি তারা কারা, একজনা ঠিক আছে। কিন্তু আরেকজনরে ক্যান আনছে? আমি জানি ক্যান আনছে?
চুপ মাগী খানকি, চুপ! তুই আমগোর ইয়া জানস। আর এক কথা না, চোপ!
তারে কী কইয়া ধইরা আনছে ওই বদে? হিঃ হিঃ হিঃ!
হারামজাদি , খানকি, আবার কতা কয়! চুপ খানকি!
কৈতরীর দণ্ডায়মান শরীরটি পাঁচ সাত সদস্যের একদল নরখাদকের সম্মিলিত পেশিশক্তির ঠাসানিতে নিমিষে ভূমিষ্যাৎ হলে আমি পা তুলে বলি, চল, ছিঃ! ছিঃ!
তুই যা!
মানে? আর তুই?
যা খুশি করব!
কী বললি? ছিঃ! আমাকে কী অন্যায় প্রতিরোধের কথা বলে এনে এখন কী ভাবছিস নিজেই? কী হয়েছে তোর আসলে?
তুই থাকতে না চাইলে চলে যা! যা জলদি!
যাচ্ছি তো, কিন্তু তুই? মাথা ঠিক আছে তোর? কী বলতে চাচ্ছিস বলতো!
তুই যা, তোর তো কিছু নেই। থাকলে রাস্তা থেকে ফিরে আসিস।
ও – এই কথা এতক্ষণে! ছিঃ! কিছু থাকলেই কি যেখানে সেখানে তার প্রয়োগ ঘটাতে হবে? পেটে ক্ষুধা থাকবে বলেই কি মলমূত্রে মুখ ঠেকাতে হবে?
আরে যা যা! সবসময় নীতিকথা ভালো লাগে না।
আমি যাচ্ছি, বেইমানি, না?
কিছু নাই যে তোর, যা, দিনে সবাইকে বাৎলে দেব দেখিস! থাকলে ফিরে আসিস।
চাঁদ অনেকটা ওপরে উঠে গেলেও মেঘ খণ্ডটি সহগামী ক্রম বিস্তৃত হওয়ায় নিচে প্রগাঢ় আবছায়া নেমেছে। বিস্তীর্ণ ঢেলার মাঠ ধরে হাঁটছি আর ভাবছি, সত্যি কি আমি কাপুরুষ? কেউ ভাববে, বলবে আমি কাপুরুষ, আর তাবৎ বাস্তবতা লণ্ডভণ্ড করে আমি কাপুরুষ হয়ে যাব ? কিসে পুরুষের পৌরুষত্ব? মোস্তাকের আকস্মিক সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে, নাকি আমার স্থির চিত্তের এই ফিরে চলায়? ভাবছি, বদমাশটা ফিরে এসে যদি আমার কুটিরেই আশ্রয় গ্রহণ করে তো একই মন্দ কথায় নিত্য জ্বালাবে, পোড়াবে, মিথ্যার বিস্তৃতি দেবে। যদি এ মুহূর্তে আমার পা টা কেটে যেত কিংবা আহত হত, একটা অজুহাত অন্তত দাঁড় করানো যেত! কী করব কাপুরুষতার অপবাদ এড়াতে এখন? ঘরে ফিরে আহতের ভাঁন করব, নাকি কোনভাবে সত্যিই নিজেকে আহত করব? ছিঃ! আবেগের ঘোরে কী ভাবছি এসব?মোস্তাক যা বলেছে তা উদ্দেশ্যমুলক; আমাকে ওর পথে নামাবার অপকৌশল মাত্র। জবাবে স্পষ্ট করে বলে দিলেই তো হলো: আমি তো সেই আমিই। কোনও ওজরে নেই ওসবে, ব্যস!
ভাবনা-ঘোরে ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির নিচের দিকটায় আচমকা তীক্ষ্ণ আঘাত টের পাই। কী হলো পায়ে? দ্রুত উবু হয়ে যাই। চাঁদ থেকে এখন মেঘগুলো সরে গেছে। স্পষ্ট আলোয় দেখতে পাই আঙ্গুলের নিচের দিকে রক্ত ঝরছে। বাঃ, সত্যি সত্যি পা কেটে গেল! ভালো লাগা না লাগার কী একটা মিশ্র অনুভূতিতে বুকের ভেতরে ধক করে উঠল। কিসে কাটল পা? শামুক ঝিনুক, নাকি অন্য কিছুতে? কী দুর্বোধ্য কারণে চোখ দিয়ে বেহুদা অশ্রু গড়াবার এক আবেগ উথলে উঠলে বুকে শক্ত ভাব এনে তা সংবরণ করি।
দ্রুত হেঁটে ঘরে ফিরি। পায়ে স্যাভলন দিয়ে কাপড়ে প্যাচাই। ভাবছিলাম, মোস্তাককে দেখাতে ঘরেই থাকব কি না। মুহূর্তে সে প্রয়োজনকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলি। তাছাড়া, আমার বাড়িতে অবস্থানকালে ওর আর এমুখো হবার সম্ভাবনাটুকুও উবে গেছে। দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে বার আঙিনা বরাবর নদীর উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরি।
নদীর দক্ষিণ তীরে খাড়া মাথার ওপরে এখন চাঁদ। তীর্যক আলো ঢেলে দিয়েছে তামাম বালুচরে, বিস্তৃত পানি পৃষ্ঠে। একদল পশুর গোসল দৃশ্য দেখছি। গোসলে শুচি হচ্ছে তারা। মাথার ওপর আজন্ম কলংক ছাপ নিয়ে হাসছে যে জ্যোতির্লৌকিক দেহটি, তারই স্বচ্ছ আলোয় দেখছি পায়ে সদ্য বসা কলংক ছাপটি। একটু না বুঝে শুনে গিয়েছিলাম, তারই প্রায়শ্চিত্ত অথবা হতে পারে কাপুরুষতার অপবাদ থেকে রক্ষার কোনও কাকতালীয় পাদটীকা।
ভাবছি, আকস্মিক পায়ে বসা এ কলংক ছাপ হয়তো আমার কাপুরুষ অপবাদকে প্রশমিত করবে। কিন্তু অনিচ্ছায়, অজ্ঞতায় হলেও আমি যে ওই কলংকিত প্রেক্ষাপটে নিজেকে ক্ষণিক হাজির করেছিলাম, ইদানিংকার কদম আলী কি কোনও বিশেষ সূত্রে জানতে পেরে নিভৃত ভুল বিবেচনায় তাকে আমার কলংক বলে গন্য করে, প্রকাশ না করলেও, যথার্থ সম্মান করলেও ভেতরে বরাবর যেমনটি আমি করি তার বিষয়টিকে?
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।