কাণ্ড কারখানা —মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়

মস্ত এক কারখানা ছিল।
সেখানে একদিন এক কাণ্ড হল।একে বারে জাকে বলা যায় কাণ্ড কারখানা।কারখানার ম্যানেজার যে ঘরে বসে,তার দক্ষিনে একটুকরো ফাঁকা জমি আছে।জমিটি কোন কাজে লাগে না।কাজে লাগানো হয়নি।দরকার হয় না।তাছাড়া সাহেব একটু আলো বাতাসও পাবে।
দু,চারটে ফুলগাছ লাগাবার ইচ্ছা ছিল।লাগানোও হয়েছিল।কিন্তু সাহেবের এদিকের কোন শখ নেই।তাই ছোট ছোট কয়েকটি বিলেতি ফুলের চারা ছিল বাগানের সম্বল।একবার কারখানায় ভারি গোলমাল হল সেও-আরেক কাণ্ডকারখানা।স্ট্রাইক,লক-আউট এসব মিলে তিন মাসের উপর কারখানা বন্ধ রইল।তার পর একদিন হাঙ্গামা মিটে কারখানা চালু হল।সকালে তাকিয়ে দেখে কি-ছোট্ট বাগানটুকুর মাঝখানে একটা গোলাপের চারা মাথা তুলেছে।ভাল জাতের বড় জাতের গোলাপ গাছ চারা মাথা তুলেছে।ভালো জাতের বড় জাতের গোলাপ গাছ-দিন দিন বড় হয়ে ঝাঁকিয়ে উঠল গাছটা ডালে ডালে ফুল ফুটে জমকালো সৌন্দর্য সৃষ্টি হল।কাজ করতে করতে যখন সাহেব চোখ তোলে,গাছ টা চোখে পড়ে সাহেব মুগ্ধ হয়ে যায়।সাহেবের রীতিমত মায়া জন্মে গেল।শক্ত বেড়া উঠল।ভাল রকমের যত্ন নেওয়া শুরু হল।সপ্তাহিক ছুটির পর কারখানা খোলা হলে দেখা গেল,সর্বনাশ হয়েছে-সাহেবের অত আদরের গাছটাও উধাও হয়ে গেছে।গর্ত খুড়ে গোঁড়া আর মাটি সুদ্ধ তুলে নিয়ে গেছে।ছুটির দিন আরও দুই,তিন জন কারখানায় থাকে,কিন্তু দায়িত্ব দারোয়ান মথুরা প্রসাদের।বিশ্বাসী লোক কারখানায় বিশ বছরের উপরে কাজ করছে-দরোয়ানি করেছে দশ এগার বছরের বেশী।সহকারী ম্যানেজার ভূপতিবাবুকে সে জানায় যে,কাল বিকালেও গাছটা ছিল,আজ ভোঁরে উঠে নিজের হাতে জল দীতে গিয়ে দেখি গাছটা নেই।মথুরা প্রসাদ কাতর ভাবে বলে সাব হাম কো ঠিক ভাগা দেগা,।
ভূপতিবাবু বলে,আরে নেহি।একঠো গাছটা ওয়াস্তা ভাগা দেগা?গাছের শোকে ক্ষেপে গিয়ে সাহেব কি যে কাণ্ড জুড়ে দেবে,তা জানা থাকলে মথুরা প্রসাদকে ভূপতি এমন সহজ ভাবে ভরসা দিত কি না সন্দেহ।রেগে আগুন হয়ে চেঁচিয়ে দাপাদপি করে বেরিয়ে সকলকে বকে ঝকে জনসন আর কিছু বাকি রাখে না।কার খানায় তিনজন লোক থাকতে তার ফুলের চারা চুরি হয়ে যায়।তিন জন কে সঙ্গে সঙ্গে বরখাস্ত করতো, ভূপতি অতী কষ্টে অনেক বুঝিয়ে কোন রকমে তাকে ঠেকিয়ে রাখে।কারখানায় চুরি হলে ওদের দোষী করা যেত।গাছটা পড়ে আড়ালে,সারারাত জেগে আসল কারখানা পাহারা দিলেও চোরের পক্ষে অনায়াসে গাছটা তুলে নিয়ে জাওয়া সম্ভব।
এযুক্তি মেনে নিয়ে কিছুক্ষণ গোমড়া মুখে গুম হয়ে থাকে।তার পর বলে বাইরের চোর নয়।এ কারখানার লোকের কাজ।এর পিছনে আমাকে জব্দ করার ষড়যন্ত্র আছে।ভূপতি বলল,হাঙ্গামা মিটে গেছে,ওদের কটা দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে- এখন তো ওদের রাগের কোন কারণ নেই।সাহেবের কিন্তু বিশ্বাস জন্মিয়ে যায় যে,কাজটা কারখানার লোকের।রাগের জ্বালায় সাহের কিন্তু ছটফট করতে থাকে।তার পর ভেবে চিন্তে একটা নতুন হুকুম জারি করে,যে চোর ধরিয়ে দীতে পারবে সে পাবে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা আর তার হপ্তা বেড়ে যাবে পাঁচটাকা।সকল কে একথা বুঝিয়ে বলা হয় যে,গাছটা নিয়েছে সে নিশ্চয় কোথাও পুতে কিংবা ফেলে দিয়েছে-শুধু গাছটার সন্ধান যে দীতে পারবে তাকেও পুরুস্কার দেওয়া হবে।সেই কারখনায় কাজ করত এক গোলক।পর দিন কারখানা চালু হবার আগে সকলকে থ,বানিয়ে দিয়ে সাহেবের সাধের গোলাপ গাছটাও হাতে করে গোলক হাজির হয়।
কি ব্যাপার?
গোলক হেসে বলে ম্যাজিক ব্যাপার।গোলকের কাজে আসবার পথের ধারে একটা পতিত পড়ে কিছু ঝোপ ঝাড় গাছপালা আছে।কাল কাজে আসবার সময় তার মধ্যে নাকি একটা গোলাপ গাছ নজরে পড়েছিল গোলকের এতটা খেয়াল করিনি।কার গোলাপ গাছ নিঃসন্দেহ না হয়ে গেলে কাল কথাটা ফাঁস করেনি।কাল ফেরার সময় কাছে গিয়ে গাছটা চিনতে পেরেছিল।চোর?নাঃকে নিয়েছিল ধরা যাবে না।কারণ বাড়ির আনাচে কানাচে পোতা থাকলে ধরা যেত সে বাড়ির কেউ কাণ্ডটা করেছে।পতিত জমির আশে পাশে কোন বাড়ি নেই।বুড়ো মোচন মুখে আওয়াজ করে বলে,তুই বেটা গোমুখ্য গোলক।সাহেব একথা বিশ্বাস করে ভেবেছিল!তোকেই চোর বলে পাকড়াবেনা।গোলক কিন্তু নিরর্ভয়ে বুক ফুলিয়ে বলে,ওঃ চোর বলে পাকড়ালেই হবে।প্রমান করতে হবে না আমি নিয়ে ছিলাম।গাছ চুরির রাতে দশ মাইল দূরে দিদির বাড়িতে ছিলাম,দশ বিশ টা সাক্ষি আছে।তার নির্বুদ্ধিতায় সকলে সত্যই আশ্চর্য হয়ে যায়।পুরুস্কারের লোভে বুদ্ধি লোভ পেয়েছে গোলকের।চোরাই মাল যার কাছে মেলে তাকেই যে এটা প্রমান করতে হয় চোরের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে কি না।পরেও হয়নি-এই সোজা কথাটি খেয়াল নেই গোলকের।কারখানায় কাজ শুরু হয়ে যাওয়ায় এ বিশয়ে আর কথা হয় না।জনসন আগে।ভূপতির কাছে আগে বিষয় টা শোণে।তার পর গোলক কে ডেকে আনার হুকুম দিয়ে,পুলিশে ফোন করে দেয়।ভূপতি চুপ করে থাকে।গোলক কোন বাজ্জাতি করেছে।পতিত জমিতে গাছটা পোতা ছিল,এ বানানো গল্প কেউ বিশ্বাস করে!গোলক এলে সে বলে,সত্যি কথা বল গোলক,পুলিশকে ফোন করা হয়েছে।
গাছ যে রাতে চুরি হয়,আমি সে রাতে অনক দূরে বোনের বাড়িতে ছিলাম-সাক্ষী আছে
গাছটা তোমার দিল কে নাম বলো?
আজ্ঞে ফাকা জমিতে পেয়েছি,গর্ত খোঁড়া আছে,দেখতে পারি।ভূপতি এক ধমক দিয়ে বলে,গর্ত অমনি খোঁড়া যায়,বাজে ইয়ারর্কি করো না।
গোলক খানিকক্ষুন চুপ করে থাকে।তার পর ধিরে ধিরে আজ্ঞে ওটা সাহেবের গাছ নয়।
সাহেবের গাছ নয়?
আজ্ঞে না জমিতে পাওয়ার কথাটা বানিয়ে বলেছি।ওটা আমার গাছ।গোলকের ভূপতি বড় লোকের বাগানে মালির কাজ করে।তার কাছ থেকে গোলাপের দুটি চারা এনে ছিল-একই গাছকে কলম বাড়িয়ে যায়গা নেই,দুটো গাছকে ঠাইদিতে পারি নি।একটা বাড়িতে পুতে আর একটা কারখানায় এনে দিয়েছিল কাছেগিয়ে দেখলে সাহেব টের পাবেন।
সাহেব গোলাপ গাছটা নিয়েছে তা এখনও কেউ জানে না।গোলকের গাছটাও সেখানে নেই। আবার চুরি যাওয়ার ভয়ে জনসন গাছটা টবে বসিয়ে ফ্লাটে নিয়ে গেছে।বলা বাহুল্য গোলকের ভাগ্যে পুরুস্কার জোটে নি।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!