তারপর একদিন সে তার দোকানে বসে একটা লোহা পিটছে আর ভবছে, কখন খদ্দের আসবে, এমন সময় একজন বুড়ো-হেন লোক ধীরে ধীরে এসে তার কাছে দাঁড়াল। কামার আগে ভাবল, ‘এই রে, খদ্দের!’ তারপর চেয়ে দেখল, ‘ওমা! এ যে শয়তান!’
শয়তান বলল, মনে আছে ত? সাত বছর শেষ হয়েছে, এখন আমার সঙ্গে চলো।’
কামার বলল, ‘তুমি ছাড়বেই না যখন, তখন ত চলতেই হবে। কিন্তু আমার হাতের এই কাজটি শেষ করে যেতে পারলে আমার ছেলেগুলোর পক্ষে বড় ভাল হত-এর দরুন কিছু পয়সা পাওয়া যাবে। তুমি দাদা আমার এই উপকারটুকু করো না-আমি সকলের কাছে বিদায় হয়ে নিই, ততক্ষণ বসে এই হাতুড়িটা দিয়ে এই লোহাখানিকে পেটো।’
শয়তান কাজে এমন দুষ্টু হলেও কথাবার্তায় ভারি ভদ্রলোক, সে কামারের কথা শুনে তখনই তার হাত থেকে হাতুড়িটি নিয়ে লোহাটাকে পেটাতে লাগল। সে জানত না যে সেটা সেই দেবতার বর দেওয়া সর্বনেশে হাতুড়ি, তা দিয়ে একবার পিটতে আরম্ভ করলে আর কামারের হুকুম ছাড়া থামবার উপায় নেই। কামার তার হাতে সেই হাতুড়ি দিয়েই অমনি যে ঘর থেকে বেরুল, আর একমাসের ভিতরে সেই মুখেই হল না।
একমাস পরে কামার দোকানে ফিরে এসে দিখল যে, শয়তান তখনো ঠনাঠন ঠনাঠন করে বেদম হাতুড়ি পিটছে, আর তার দশা যে হয়েছে! খালি শয়তান বলে সে এতক্ষণ বেঁচে আছে,আর কেউ হলে মরেই যেত। কামারকে দেখে সে অনেক মিনতি করে বলল, ‘ভাই, ঢের ত হয়েছে। আমাকে মেরে ফেলে তোমার লাভ কি? তার চেয়ে তোমাকে আরো তিন থলি মোহর দিচ্ছি, আরো সাত বছরের ছুটি দিচ্ছি, আমাকে ছেড়ে দাও।’
কামার ভাবল, মন্দ কি। আর তিন থলি মোহর দিয়ে সাত বছর সুখে কাটানো যাক। কাজেই সে শয়তানকে বলল, ‘আচ্ছা তবে তাই হোক।’
তখন শয়তান কামারকে আবার তিন থলি মোহর দিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান খেকে চলে গেল, কামারও সেই টাকা দিয়ে আবার ধুমধাম জুড়ে দিল। তারপর সে টাকা শেষ হতেও আর বেশি দেরি হল না, তখন আর হাতুড়ি পেটা ভিন্ন উপায় নেই। এমনি করে আবার সাত বছর কেটে গেল।
এবার শয়তান কামারকে নিতে এসে দেখে, তার বাড়িতে ভারি গোলমাল। কি কথা নিয়ে কামার তার গিন্নির উপর বিষম চটেছে, আর তাকে ধরে ভয়ানক মারছে। কামার গিন্নিও যেমন-তেমন মেয়ে নয়, পাড়ার সকলে তার জ্বালায় অস্থির থাকে। কামারকে সে ঝাঁটা দিয়ে কম নাকাল করছে না, কিন্তু কামারের হাতে কিনা হাতুড়ি, কাজেই জিত হচ্ছে তারই। শয়তান এসে এ সব দেখে কামারকে ভয়ানক দুই থাপ্পড় লাগিয়ে বলল, ‘বেটা পাজি, স্ত্রীকে ধরে মারিস? চল্, আমার সঙ্গে চল্।’
শয়তান ভেবেছিল, এতে কামারের স্ত্রী খুব খুশি হয়ে তার সাহায্য করবে। কিন্তু কামারের স্ত্রী তার কিছু না করে, ‘বটে রে হতভাগা, তোর এতবড় স্পর্ধা! আমার স্বামীর গায়ে হাত তুলছিস!’ বলে, সেই ঝাঁটা দিয়ে শয়তানের নাকে মুখে এমনি সপাংসপ মারতে লাগল সে বেচাবার দমই ফেলা দায়। সে তাতে বেজায় থতমত খেয়ে একটা চেয়ারের উপর বসে পড়ল-সেই চেয়ার, যাতে একবার বসলে আর বিনা হুকুমে ওঠবার জো নেই।
কামার দেখল যে, শয়তান এবারে বেশ ভালমতেই ধরা পড়েছে, হাজার টানাটানিতেও উঠতে পারছে না। তখন সে তার চিমটেখানি আগুনে তাতিয়ে নিয়ে আচ্ছা করে তার নাকটা টিরে ধরল। তারপর তারা স্বামী- স্ত্রী দুজনে মিলে ‘হেঁইয়ো’ বলে সেই চিমটে ধরে টানতেই নাকটা রবারের মত লম্বা হতে লাগল। এক হাত, দু হাত, চার হাত, আট হাত-নাক যতই লম্বা হচ্ছে, শয়তান বেটা ততই ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছে। নাকটা যখন কুড়ি হাত লম্বা হল, তখন শয়তান আর থাকতে না পেরে নাকি সুরে বলল, ‘দোহাই দাদা! আর টেনো না, মরে যাব।’
কামার বলল, ‘আরো তিন থলি টাকা, আর সাত বছরের ছুটি-দেবে কিনা বলো।’ শয়তান ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘এক্ষুনি এক্ষুনি, এই নাও।’ বলতে বলতেই তিন থলি ঝকঝকে মোহর এসে কামারের কাছে হাজির হল। কামার সেগুলো সিন্দুকে তুলে শয়তানকে বলল, ‘আচ্ছা, তবে যাও।’ শয়তান ছাড়া পেয়েই সেখান থেকে এমনি ছুট দিল যে, ছুট যাকে বলে।
তখন কামার আর তার স্ত্রী মেঝেয় গড়াগড়ি দিয়ে যে হাসিটা হাসল! আর সাত বছরের জন্য তাদের কোনো ভাবনা রইল না। সাত বছর যখন শেষ হল, তখন কামারের টাকাও ফুরিযে গেল, তাকে আবার তার ব্যবসা ধরতে হল, ততদিনে শয়তানও আবার তাকে নেবার জন্য এসে উপস্থিত হল।
সাত বছর পরে শয়তান আবার কামারকে নেবার জন্য উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু গতবারে সে নাকে যে চিমটি খেয়ে গিয়েছিল, তার কথা ভেবে আর সে সোজাসুজি কামারের সামনে এসে দাঁড়াতে ভরসা পাচ্ছে না, তাই এবারে সে এক ফন্দি এঁটে এসেছে।
শয়তান জানে যে, কেউ যদি তাকে নিজে থেকে আদর করে নিয়ে যায়, তা হলে আর সে কিছুতেই তার হাত ছাড়তে পারে না। তখন শয়তান করল কি, একটি ঝকঝকে মোহর হয়ে ঠিক কামারের দোকানের সামনে রাস্তায় গিয়ে পড়ে রইল। সে ভাবল যে, কামার খেতে পায় না, মোহরটি দেখলে সে পরম আদরে এসে তুলে নিয়ে যাবে। তারপর আর সে শয়তানকে ফাঁকি দিয়ে যাবে কোথায়?
যে কথা সেই কাজ। কামার সেই মোহরটিকে দেখতে পাওয়া মাত্রই ছুটে গিয়ে সেটিকে তুলে এনে তার থলেয় পুরল। তখন থলের ভিতর থেকে শয়তান হেসে তাকে বলল, ‘কি বাপু, এখন কোথায় যাবে? নিজে ধরে আমাকে ঘরে এনেছ, তার মজাটা এখনই দেখতে পাবে!’
কামার বলল, ‘কি রে বেটা? তুই নাকি! তোর বুঝি আর মরবার জায়গা জোটে নি, তাই আমার থলের ভিতরে এসেছিস? দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি!’
এ কথায় শয়তান এমনি রেগে গেল যে, পারলে সে তখনই কামারকে মেরে শেষ করে। কিন্তু থলের বাইরে এলে তবে ত শেষ করবে! সে যে সেই বিষম থলে-তার ভিতর ঢুকলে আর বেরোবার হুকুম নেই! শয়তান বেচারার খালি ছটফটই সার হল, সে আর থলের ভিতর থেকে বেরুতে পারল না। ততক্ষণে কামার সেই থলেটি তার নেহাইয়ের উপর রেখে গিন্নীকে ডেকে দুজনে দুই প্রকাণ্ড হাতুড়ি নিয়ে, দমাদ্দম দমাদ্দম এনি পিটুনি জুড়ল যে পিটুনি যাকে বলে! পিটুনি খেয়ে শয়তান খানিক খুব চেঁচাল। তরপর যখন আর চেঁচানি আসে না, তখন গোঙাতে গোঙাতে বলল, ‘ছেড়ে দাও দাদা, তোমার পায়ে পড়ি। এবার তোমাকে বিশাল বিশাল ছয় থলে ভরা মোহর দেব, আর-কখনো তোমার কাছে আসব না।’
এ কথায় কামারের গিন্নি বলল, ‘ওগো, সে হলে নেহাত মন্দ হবে না। দাও হতভাগাকে ছেড়ে।’ তখন কামার বলল, ‘কই তোর মোহরের থলে?’ বলতে বলতেই এমনি বড় বড় মোহরের থলে এসে হাজির হল যে তারা দুজনে মিলেও তার একটাকে তুলতে পারল না। তখন কামার একগাল হেসে, তার থলের মুখ খুলে দিয়ে বলল, ‘যা বেটা! ফের তোর পোড়া মুখ এখানে দেখাতে আসবি ত টের পাবি।’ ততক্ষণে শয়তান থলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এমনি ব্যস্ত হয়ে ছুট দিল যে, কামারের সব-কথা শুনতেও পেলনা।’
সেই ছটা থলের ভিতর এতই মোহর ছিল যে, কামার হাজার ধুমধাম করেও তা শেষ করতে পারল না। চার থলে ভাল করে ফুরুতেই সে বুড়ো হয়ে শেষে একদিন মরে গেল। মরে গিয়ে ভূত হয়ে সে ভাবল যে, এখন ত হয় স্বর্গে না হয় নরকে দুটোর একটায় যেতে হবে। আগে স্বর্গের দিকে গিয়েই দেখি-না, যদি কোনোমতে সেখানে ঢুকতে পারি।
স্বর্গের ফটকের সামনে গিয়ে তার সেই দেবতাটির সঙ্গে দেখা হল, যিনি তাকে সেই বর দিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে কামার ভারি খুশি হয়ে ভাবল, ‘এই ঠাকুরটি না আমাকে সেই চমৎকার বরগুলো দিয়েছিলেন? ইনি অবশ্য আমাকে ঢুকতেও দেবেন।’
কিন্তু দেবতা তাকে দেখেই যার পর নাই রেগো বললেন, ‘এখানে এসেছিস কি করতে? পালা হতাভাগা, শিগগির পালা!’
কাজেই তখন বেচারা আর কি করে? সে সেখান থেকে ফিরে নরকের দিকে চলল। সেখানকার ফটকের সামনে উপস্থিত হলে শয়তানের দারোয়ানেরা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম?’
কামার তার নাম বলতেই পাঁচ-ছয়টা দারোয়ান ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে শয়তানকে বলল, ‘মহারাজ! সেই কামার এসেছে!’ তা শুনে শয়তান বিষম চমকে গিয়ে একটা লাফ যে দিল! তারপর পাগলের মত ফটকের কাছে ছুটে এসে দারোয়ানদের বলল, ‘শিগগির দরজা বন্ধ কর্! আঁট্ হুড়কো! লাগা তালা! খবরদার! ও বেটাকে ঢুকতে দিবি না! ও এলে আর কি আমাদের রক্ষা থাকবে!’
শয়তানের গলা শুনে কামার গরাদের ভিতর দিয়ে উঁকি মেরে হাসতে হাসতে বলল, ‘কি দাদা! কি খবর?’ সে কথা শেষ না হতেই শয়তান এক লাফে এসে অমনি তার নাক মলে দিল যে কি বলব! কামার তখনই সেখান থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে পালাল, কিন্তু তার আগেই তার নাকে আগুন ধরে গিয়েছিল। সে আগুন আজও নেবেনি। কামার তার জ্বালায় অস্থির হয়ে জলায় জলায় নাক ডুবিয়ে বেড়ায়। সে আগুন দেখতে পেলে লোকে বলে, ‘ঐ আলেয়া।’
গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।