এক দেশে এক কামার ছিল, তার মত অভাগা আর কোনো দেশে কখনো জন্মায় নি। তাকে এক জিনিস গড়তে দিলে তার জায়গায় আর-এক জিনিস গড়ে রাখত। একটা কিছু সারাতে দিলে তাকে ভেঙে আরো খোঁড়া করে দিত। আর লোককে ফাঁকি যে দিত, সে কি বলব! কাজেই কেউ তাকে কোনো কাজ করতে দিতে চাইত না, তার দুবেলা দুটি ভাতও জুটত না। লাভের মধ্যে সে তার গিন্নীর তাড়া খেয়ে সারা হত।
একদিন সে দোকানে বসে গালে হাত দিয়ে ভবছে। ভয়ানক শীত, গায়ে জড়াবার কিছু নেই। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে, ঘরে খাবার নেই। এমন সময় কোত্থেকে এক লম্বা সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো লাঠি ভর করে কাঁপতে কাঁপতে এসে তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘জয় হোক বাবা, দুঃখী বুড়োকে কিছু খেতে দাও।’
কামার বলল, ‘বাবা, খাবার যদি থাকত, তবে নিজেই দুটি খেয়ে বাঁচতুম। দুদিন পেটে কিছু পড়ি নি। ছেলেপুলে নিয়ে উপোস করছি-তোমাকে কোত্থেকে দেব? তুমি না হয় ঘরে এসে একটু গরম হয়ে যাও, আমি হাপর ঠেলে আগুনটা উসকিয়ে দিচ্ছি।’
বুড়ো তখন কাঁপতে কাঁপতে ঘরে এসে বলল, ‘আহা, বাঁচালে বাবা। শীতে জমে গিয়েছিলুম। তুমি দেখছি তবে আমার চেয়েও দুঃখী। আমার নিজে খেতে পেলেই চলে, তোমার আবার স্ত্রী আর ছেলেপুলেও আছে।’
এই বলে বুড়ো আগুনের কাছে এসে বসল, ‘কামার খুব করে হাপর ঠেলে আগুন উসকিয়ে তাকে গরম করে দিল। যাবার সময় বুড়ো তাকে বলল, ‘তমি আমাকে খেতে দিতে পার নি, তবু তোমার যতদূর সাধ্য তুমি করেছ। এখন তোমার যেমন ইচ্ছা তিনটি বর চাও, আমি নিশ্চয় দেব।’
এ কথায় কামার অনেকক্ষণ বুড়োর মুখের দিকে চেয়ে মাথা চুলকোতে লাগল, কিন্তু কি বর চাইতে হবে, বুঝতে পারল না। বুড়ো বলল, ‘শিগগির বলো। আমার বড্ড তাড়াতাড়ি-ঢের কাজ আছে।’
তখন কামার থতমত খেয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তবে এই বর দিন যে, আমার এই হাতুড়িটি যে একবার হাতে করবে, সে আর আমার হুকুম ছাড়া সেটি রেখে দিতে পাবে না। আর যদি তা দিয়ে ঠুকতে আরম্ভ করে, তবে আমি থামতে না বললে আর থামতে পারবে না।’
বুড়ো বলল, ‘আচ্ছা, তাই হবে। আর কি বর চাই?’
কামার বলল, ‘আমার এই কেদারাখানিতে যে বসবে, সে আমর হুকুম ছাড়া তা থেকে উঠছে পারবে না।’
বুড়ো বলল, ‘আচ্ছা, তাও হবে। আর কি?’
কামার বলল, ‘আমার এই থলিটির ভিতরে আমি কোনো টাকা রাখলে আমি ছাড়া আর কেউ তাকে তা থেকে বার করতে পারবে না।’
সেই বুড়ো ছিলেন এক দেবতা। তিনি এই শেষ বরটিও সেই কামারকে দিয়ে ভয়ানক রেগে বললেন, ‘অভাগা, তুই ইচ্ছা করলে এই তিন বরে পরিবার সুদ্ধ স্বর্গে চলে যেতে পারতিস, তার মধ্যে তোর এই দুর্মতি!’
এই বলে দেবতা চলে গেলেন, কামার আবার বসে বসে ভাবতে লাগল্ হঠাৎ তার মনে যে, তাই ত, এই তিন বরের জোরে ত আমি বেশ দু পয়সা রোজগার করে নিতে পারি।
তখন সে দেশময় এই কথা রটিয়ে দিল যে, ‘আমার দোকানে এলে আমি বিনে পয়সায় কাজ করে দেব।’ দেশের যত কিপটে পয়সাওয়ালা লোক, সে কথা শুনে তার দোকানে এসে উপস্থিত হতে লাগল। এক-একজন আসে, আর কামার তাকে দু হাতে লম্বা লম্বা সেলাম করে তার সেই কেদারাখানায় নিয়ে বসতে দেয়। বিনি পয়সায় কাজ করিয়ে চলে যাবার সময় আর সে বেচারা তা থেকে উঠতে পারে না, কামারও বেশ ভালমতে তার কাছ মেকে কিছু টাকা আদায় না করে তাকে উঠতে দেয় না। এমনি করে দিন কতক সে খুব টাকা পেতে লাগল। কাউকে এনে চেয়ারে বসায়, কারু হাতে তার হাতুড়িখানা তুলে দেয়, তারপর টাকা না দিলে আর তাকে ছাড়ে না।
যা হোক, ক্রমে সকলেই তার দুষ্টুমি টের পেয়ে গেল। তখন আর কেউ তার কাছে আসে না, কাজেই আবার তার দুর্দশার একশেষ হতে লাগল। এই সময় কামার একদিন বনের ভিতর বেড়াতে গিয়ে একটি সাদাসিধে গোছের বুড়োকে দেখতে পেল। বুড়োকে দেখে সে আগে ভাবল, বুঝি কোনো উকিল হবে। কিন্তু তখনই আবার কোনো উকিলের সেই বনের ভিতর আসা তার ভারি অসম্ভব মনে হল। তারপর সে আবার ভাল করে চেয়ে দেখল যে, সেই লোকটার পা দুখানিতে ঠিক ছাগলের পায়ের মত খুর আছে। তখন আর তার বুঝতে বাকি রইল না যে, সেই বুড়ো আর কেউ নয়, স্বয়ং শয়তান। শয়তানের পা ঠিক ছাগলের মত থাকে, এ কথা সেই কামার ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছিল।
আর কেউ হলে তখনই সেখান থেকে ছুটে পালাত। কিন্তু সেই কামার তেমন কিছু না করে জোড়হাতে শয়তানকে নমস্কার করে বলল, ‘প্রণাম হই।’
শয়তান অমনি হাসতে হাসতে তার নাম ধরে বলল, ‘কি হে, কেমন আছ?’
কামার বলল, ‘আজ্ঞে। কেমন আর থাকব? দুবেলা দুটি ভাতও খেতে পাই নে।’
শয়তান বলল, ‘বটে! তুমি এতই কস্ট পাচ্ছ? তুমি কেন আমার চাকরি করো না, আমি তোমাকে ঢের টাকা দেব।’
ঢের টাকার নাম শুনে কামার তখনই শয়তানের কথায় রাজি হল, যদিও সে জানত যে তা কাজে একবার ঢুকলে আর কেউ ছেড়ে আসতে পারে না। শয়তান তখন তাকে তিন থলি মোহর দিয়ে খুব আরামে খাও-দাও। সাত বছর পরে আমি তোমার কাছে আসব, তখন তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’ এই বলে শয়তান চলে গেল। কামারও হাসতে হাসতে টাকার থলি নিয়ে ঘরে ফিরল।
সেই তিন থলি মোহর নিয়ে কামার যার পর নাই খুশি হয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি এল। ভাবল, এখন সাত বছর এই মোহর দিয়ে খুব ধুমধাম করে নেবে। সাত বছর পরে শয়তানের তাকে নিতে আসবার কথা, তখন তার সঙ্গে যেতেই হবে।
তারপর লোকে দেখল যে কামার কেমন করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেছে। এখন আর সে হাপরও ঠেলে না, লোহাও পেটে না। এখন তার গাড়ি ঘোড়া চাকর বাকরের অন্ত নেই। দিন যাচ্ছে আর তার বাবুগিরি ক্রমেই বেড়ে উঠছে। সে বাবুগিরিতে সাত বছর শেষ হবার ঢের আগেই শয়তানের দেওয়া সব টাকা ফুরিয়ে গেল, আর ঘরে একটি পয়সা নেই, নইলে খাবে কি?
গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।