করিম মিঞা একজন সাধারণ মানুষ। বাবার আদি ভিটে মাটিতেই নিজের আবাস গেরে আছেন। জায়গা-জমি যা ছিলো একে একে সব বিক্রি করে দিয়েছেন। বর্তমানে জায়গা-সম্পত্তি বলতে এ পৈতৃক ভিটেটাই আছে। করিম মিঞার বাবা সৈয়দ শওকত মিঞা সবসময় বলতেন, আশে-পাশের চার-দশ গ্রামের সবার সম্পদ বিক্রি করলেও তাঁর ভিটের সম্পদের মত কেউ প্রভাবশালী হতে পারবেনা।
করিম মিঞা শুনেছে তার পরদাদারা ‘সৈয়দ’ বংশের ছিলেন। বাজারের ব্যাগ পর্যন্ত কখনো হাতে নেননি। তিনিও তার বাবাকে দেখেছেন বাজারে গেলে সবসময় সবচেয়ে বড় ও দামি মাছটা কিনে নিয়ে আসতে। বর্তমানে সৈয়দ বংশের নাম চুলোয় যাক ;দু’বেলা দু’মুঠো ভাত জোগাড় করতেই এখন তাদের হিমশিম খেতে হয়। নিজেদের পরনের ভালো কোন জামা-কাপড় নেই, ভালো কোন খাবার নেই। ছেলে-পুলেও টাকার জন্য ঠিকমত ইস্কুলে যেতে পারেনা। বেচারা করিম মিঞা দিন দিন হতদরিদ্রের খাতায় নাম লিখাচ্ছেন।
করিম মিঞা অসুখে পড়েই এতসব গরমিল বাঁধিয়েছে। ঘরের চাল-ডাল, জমি-জমা এমনকি বউয়ের গহনা পর্যন্ত বিক্রি করতে হয়েছে। ভিটে-মাটিতে একসময় বড় ঘর বিক্রি করে দিয়ে ঝনের ঘর উঠালো। করিম মিঞার বউ ‘পরীমণ বানু’ একসময় আশে-পাশের পুকুর-পাড় কিংবা নর্দমার আশ-পাশ থেকে কচুপাতা এনে গরম পানিতে ফুটিয়ে দিতেন ছেলে-পুলেকে।
করিম মিঞাও শরীর একটু সুস্থ হলে বেরিয়ে পড়তেন কাজের খোঁজে। প্রায়দিনই খালি হাতে বাড়ি ফিরতেন। করিম মিঞার অসুস্থ শরীর দেখে অনেকে কাজও দিতে চাইতোনা। বাড়ি ফিরেই শুনতে হতো বউয়ের তিরস্কার আর দেখতে হতো ছোট-ছোট ছেলে-পুলের শুকনো মুখ। প্রায়দিনই অনেক রাত করে বাড়ি ফিরতেন করিম মিঞা; আর তার অপেক্ষা করে পথ চেঁয়ে বসে থাকতেন পরীমন বানু। অভাবের অন্তরালে যেন এক প্রকৃত ভালবাসার প্রতিচ্ছবি !
করিম মিঞা সেদিন আর বাড়ি ফিরলেন না। হতদরিদ্রতা তাকে এতটাই হতাশ করেছিলে যে সে বেঁচে থাকার আশা পর্যন্ত খুঁজে পাননি। করিম মিঞার বাড়ীর পাশেই ছিল বেশ পুরানো একটি বটগাছ।বটগাছটির ডালপালা এতই বিশাল ছিল যে সবগুলো ডালপালাই বটগাছের নিচের ডোবার মত পুকুরে গিয়ে পড়েছে। কথিত আছে, মোঘল আমলে মোঘল সম্রাট আশে-পাশের গ্রামের লোকদের ছাঁয়ার কথা চিন্তা করে বটগাছটি লাগিয়েছিলেন। তৎকালীন আমলে, বর্তমানের মত বিভিন্ন প্রয়োজনে দূর-দূরান্তে যেতে হত। তখনকার আমলে বটগাছগুলো বর্তমানের ছাত্রীছাউনির মত উপকার করতো।
ভোরের আলো ফুটলো। চারপাশে বুলবিলির কিচিরমিচির শব্দে সবার ঘুম ভাঙলো। মুসুল্লিরা মসজিদ যাওয়া পথে গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় একটা মৃতদেহ দেখতে পেল। অনেকে অবশ্য ভূত ভেবে ফজরের নামায আদায় করতে মসজিদেই যায়নি।
চারপাশে সূর্যের ঝলমলে আলোতে পুরো পৃথিবী আলোকিত হয়ে উঠলো। এবার, সবাই নিশ্চিন্ত হলো, ঝুলন্ত লাশটাই করিম মিঞার। পরীমন বানু দিকশূণ্য হয়ে বারংবার কান্না করতে করতে জ্ঞান হারাচ্ছিলো। ছেলে-পুলেগুলো বাবা হারানোর কষ্টটা তখনো পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি । তবুও, মায়ের কান্না দেখে বুঝেছে কিছু একটা খারাপ হতে চলেছে !
বাঁশ কেঁটে চাটাই তৈরি করা হলো। করিম মিঞার লাশ গাছ থেকে নামানো হল। সবাই ভাবছে ভূত-পেত্নীর কাজ। করিম মিঞার গলায় যেহেতু বটগাছের ঝুলন্ত জটার প্যাঁচ ছিল তাই সবার এমনটাই ধারণা। পরীমন বানুর মুখে সবাই শুনেছে, করিম মিঞা আবার বেশ কয়েকদিন খুব রাত করে বাড়ি ফিরতো। সবাই যার যার মত সাহায্য করে করিম মিঞার শেষকাজ নির্বিঘ্নে শেষ করলো। এরপরদিন সকালে ঘটলো অন্য ঘটনা। গাছে তিনটে লাশ ঝুলে আছে। পরীমণ বানু আর তাঁর দু’ছেলেপুলে। বিকৃতরূপ হয়ে আছে সবার। জিহ্বা অনেকটু পর্যন্ত বের হয়ে আছে । গ্রামবাসী এবারও সকলের সাধ্যমত করিম মিঞার পরিবারের শেষকাজ করলো। এখন
এই জায়গাটা এতটাই ভূতুরে হয়েছে যে, দিনের বেলাও মানুষজন এ পথ মাড়াতে ভয় পায়। আর সন্ধ্যার পরতো এখান দিয়ে লোকজন একেবারেই আসা-যাওয় করেনা। কারন, এখন প্রায় প্রতিদিনই এখানে এসে কোন না কোন লোক ভয়ের শিকার হয়। বটগাছের নিচের ডোবার মতন নর্দমাটায় এক সময় গ্রামবাসী মিলে মাছ চাষ করতো কিন্তু, এখন আর কেউ মাছ চাষ করে না।
ইতোমধ্যে এই নর্দমাটাকে নিয়েও রীতিমত অনেক ঘটনা ঘটেছে। কোন ঘটনারই কোন সমাধান এই এলাকার গ্রামের মানুষ দিতে পারেনি। সবার কাছে এই নর্দমা ও বটগাছটি রহস্যময় হয়েই রয়ে গেছে।
(বর্তমান সময় থেকে পাঁচ বছর পর)
গ্রামেরই আরেক তরুণ আশরাফুল। গ্রামের চেয়ারম্যানের ভাগ্নে। শহর থেকে এসেছে গ্রামে ছুটি কাঁটাতে। বিশাল বটগাছ দেকে তো আশরাফুল ভিমড়ি খেয়ে পড়লো। আশরাফুলের সময়বয়সী এক তরুণকে বটগাছের জটা ধরে ঝুলতে দেখে, আশরাফুলও ঈর্ষান্বিত হলো। কিছুক্ষণ ঝুলতে ঝুলতে ছেলেটার সাথে পরিচয় হয়ে গেল। ছেলেটার নাম জাহিদ। চেয়ারম্যান বাড়ির পাশেই সে থাকে। ডোবার দিকে চোখ পড়তেই আশরাফুল দৌড়ে গিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়লো। এত্ত পানি! জাহিদ বারংবার মানা করা সত্ত্বেও উঠে এলোনা। জাহিদ জেদ করে আশরাফুলকে রেখেই বাড়ি ফিরে গেল।
বাসায় এসে জাহিদ যথারীতি পড়তে বসে গেল। এদিকে এশার আযান হয়ে গেল। এখনও আশরাফুল বাসায় ফিরেনি। আশরাফুলের মা খুবই চিন্তায় পড়ে গেল। চেয়ারম্যানের চামচরা দলবল নিয়ে খুঁজতে বেরিয়ে পড়লো।
জাহিদের বাড়িতে এসে আশরাফুলের খোঁজ করতেই জাহিদ বলে দিলো, এখনও বাড়ি ফেরেনি ও। আশরাফুলের মা কাঁদতে কাঁদতে বলছিলো, সেতো এতক্ষণ পর্যন্ত বাহিরে থাকে না। সেই বিকাল বেলায় বেরিয়েছে; এখন তো রাত দশটা।জাহিদ সবাইকে বললো তাকে শেষ কোথায় দেখেছে!
বাড়ীর সবাই টর্চ লাইট,কুপি,হ্যারিকেন,লাঠি-সোটা হাতে নিয়ে আশরাফুলকে খোঁজার জন্য ঐ বটগাছতলায় চলে আসল । বটগাছের নিচে আসতেই প্রত্যেকের আলো নিভে যায়। তাই আশরাফুলকে পুরো রাতজুড়ে খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি। এরপর, সবাই আশরাফুল, আশরাফুল
বলে ডাকতে থাকে কিন্তু কোন সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। পরিশেষে আশে পাশে সব জায়গায় খোঁজাখুজি করে আশরাফুলকে কোথাও না পেয়ে নিরাশ হয়ে সবাই বাড়ীতে
ফিরে আসে। মসজিদের মাইক দিয়ে চারপাশে মাইকিং করে দেয়া হয় আশরাফুল নামের দশ-পনেরো বছরের লম্বা ৫’৯” , ছিপছিপে ফর্সা চেহেরার একটি ছেলে হারানো গিয়েছে। কোন সহৃদয়বান লোক যদি পেয়ে থাকেনন তাহলে তাকে চেয়ারম্যান বাড়ীতে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরোধ করা হল।
চেয়ারম্যান বাড়িতে শোকাহত পরিবেশ। দেখতে দেখতে সারারাত গেল। সকাল হলো। পুরো বাড়ীজুড়ে আবার কান্নার রোল পড়ে গেল। চেয়ারম্যানের শহুরে ভাগ্নে আশরাফুলকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার দল বেঁধে সবাই ঐ বটগাছতলায় গেল। এবার পুকুরের ঐ বটগাছের
গোঁড়ায় গিয়ে সবাই আতঁকে উঠল। একি দেখছে তারা!
পুরনো বটগাছটার ঝুলে পড়া শিকড়গুলোর নিচে আশরাফুলের মাথা পড়ে আছে। বটগাছের শিকড়টা ছিল ডোবার পানির মধ্যে। সেই মোতাবেক তার মাথাটা পানির মধ্যেই ডুবানো ছিল। সকলে ভাবছে পানিতেই ছেলেটা হয়তোবা বসে আছে। আশরাফুলের মা দৌড়ে গিয়ে আশরাফুলের মাথার চুল টেনে পানি থেকে টেনে নিয়ে আসতে গেলেন। আশরাফুলের দেহবিহীন মাথাটা উঠে আসলো। তৎক্ষণাৎ, আশরাফুলের মা বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেলেন। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আশরাফুলের পুরো দেহ কোথায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিলো না। মাথা বেয়ে তাঁজা রক্ত ঝরছে। মনে হচ্ছে, মাত্র কেঁটে গেছে কপালের কোণাটা। মুহুর্তেই,
রক্তে লাল হয়ে গেল পুরো ডোবার পানি। তারপর গ্রামের কয়েকজন মিলে আশরাফুলের মাথাটা গণচক্ষু থেকে আড়াঁল করে রাখলো।
মাথাটা অসাবধানবশৎ রাখতে গিয়ে দেখলো, চোখগুলো উপড়ানো। নাকে মুখে
ভয়ংকর আচড়ঁ ও কামড়ের দাগ। এ দৃশ্য দেখে উপস্থিত সবার মধ্যে ভয় চলে আসলো। এবার সবাই ভাবতে লাগল চেয়ারম্যানের ভাগ্নের দেহ তাহলে কোথায় থাকতে পারে। যেহেতু এখানেই তার মাথা
পাওয়া গেছে। দেহও এখানেই পাওয়া যাবে। ছোট্ট ডোবাতে খুঁজে দেখার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু সবার মাঝে কেমন একটা ভয় কাজ করছে তাই কেউ ডোবায় নামতে রাজি
হলোনা। পরে জাল ফেলে খোজাঁর সিদ্ধান্ত হলো। বিভিন্ন পাড় থেকে একের পর এক জাল ফেলতে লাগলো ডোবার পানিতে।
প্রায় তিন-চার ঘন্টা চেষ্টার পরে এক সময় কিছু হাড় উঠে আসে জালে। কিন্তু, আশরাফুলের দেহ কোথাও খুঁজে পাওয়া
গেল না। অনেক চেষ্টা করেও আশরাফুলের দেহ খুঁজে না পেয়ে সেই মাথাকেই কাফন
মুড়িয়ে কবর দেয়া হল।
আশরাফুলের মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক পরের ঘটনা। রাত তখন প্রায় দেড়টা বাজে। আশরাফুলের মা-বাবা শহরে চলে গেছে। পুরো গ্রামে নিরব আতঙ্ক বিরাজ করছে। চেয়ারম্যান সাহেব ঘুমিয়ে আছেন। এমন সময় দরজায় কে যেন নক করল।
চেয়ারম্যান সাহেবের বউও নিভৃতে ঘুমাচ্ছেন। হঠাৎ চেয়ারম্যানের বউয়ের ঘুম ভাঙ্গলো। এতো রাতে কে আসবে। তাই মনে ভয় এসে গেল। স্বামীকে ডাকবে কিনা
ভাবছিলেন। এমন সময় আবার কাঠের দরজায় নক হলো। এবার চেয়ারম্যানের বউ ভাঙা কণ্ঠে বললো,
“বাইরে কে?”
বাহির থেকে বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ হচ্ছে। চেয়ারম্যানের বউ আবার উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন,
“ওখানে কে দাঁড়িয়ে”
কিছুক্ষণ গম গম শব্দের পর আওয়াজ এল নানু, আমি আশরাফুল। গোপালপুর বাজারে যেয়ে পথ হারিয়ে ফেলছিলাম। দরজাটা খোল আমার খুব ভয় লাগছে। আমি ঘুমাবো। এ কথা শুনে চেয়ারম্যানের বউ আৎকে উঠলো। অশ্রুমেশা কণ্ঠে বললো,
” নানু! দাঁড়াও আমি দরজা খুলতাছি ! ”
চেয়ারম্যানের তাঁর বউয়ের কথা শুনে ঘুম থেকে উঠে গেলন। কি হয়েছে তোমার? তুমি কার সাথে এমন করে কথা বলছ?
“তোমার নাতি আইছে, তাড়াতাড়ি উইঠ্যা দরজা খুইলা দেও”
“কি কও, তুমি। কোন নাতি ? ”
“নিরালার পোলা আশরাফুল আইছে”
“কি যে কও না। সে আবার কোথা থেকে আসবে। সেতো মরে গেছে।”
“আমি স্পষ্ট হুনছি আশরাফুলের গলা। সে ঐ গোপালপুর মেলার হাটে গেছিলো। ফিরা আইছে ”
“তুমি পাগল হয়ে গেছো নাকি? মরা মানুষ আবার ডাক দিতে পারে নাকি? কয়েকদিন আগেই তো দেখলা তাকে কবর দিছিলো”
“না, আমি পাগল হয়নি। আমি স্পষ্ট হুনছি নাতি আমারে নানু বইলা ডাক দিছে। তুমি তাড়াতাড়ি দরজা খুল। নাতি আমার ভয় পাইতাছে”
“রানু বানু, তুমি ভুল শুনছো। ঘুমায়া পড়!”
“আমি ভুল শুনি নাই। আমি দরজা খুলে দেখমু”
“তুমি এত রাতে দরজা খুলবা না বলে দিলাম”
“আমি দরজা খুলবই।আমার নাতি তোমার তো আর না…”
স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শুরু হয়ে গেল তুমুল বাক-বিতন্ডা। রানু বানু তার স্বামীকে কিছুতেই বিশ্বাস করাতে পারছিলের না যে তার নাতি তাকে ডাক দিয়েছে। তাই জোরাজোরির এক
পর্যায়ে স্বামীর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে রানু বানু
দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলে দিতেই দেখলো চারপাশে কর্পূরের ঘ্রাণ। গরুগুলো অনবরত ডেকে চলছে। রানু বানু ধার্মিক মানুষ। তবুও, কিছুটা ভয় পেলেন। একটু দূরে দৃষ্টি দিতেই দেখলেন বাড়ির গোয়ালঘরের পেছনে বাঁশঝাড়ের আগায় কাফনের কাপড় পড়া অবস্থায় শূন্যে ভাসছে এক লোক।চোখগুলো লাল হতে হতে কালো হয়ে গেছে। এ দৃশ্য দেখে রানু বেগম আর্ত-চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। চেয়ারম্যান সাহেব পিছনে পিছনে আসলেন কিন্তু তিনি এসব কিছুই দেখলেন না।বাড়ির কামলা, কাজের লোক আর আশে-পাশের লোকজন চিৎকার শুনে চলে আসলো।
মসজিদের ইমামের বিবিকে ডেকে আনা হলো। পানি পড়া দেয়া হল। ঝারফুকও করা হল। ভোর সকালে রানু বানুর জ্ঞান ফিরলো। মাঝে মাঝে তিনি আশরাফুল, আশরাফুল বলে প্রলাম বকছিলেন।
পূর্ব আকাশে সূর্য যখন তার পুরো আলোর ডালা মেলে ধরেছে; রানু বানুও ধীরে ধীরে দুনিয়ার মায়াত্যাগ করলেন। চেয়ারম্যান সাহেব পরিবেশ ঠান্ডা রাখতে রাতের কথা কাউকে বললেন না। কিন্তু আজও সেই আশরাফুলের রহস্য উদঘাটন করতে পারেনি গ্রামবাসী। তার পর থেকে একের পর এক ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে রহস্যময় এই বটগাছের বেদীতে।
রানু বেগমের মৃত্যুতে পুরো গ্রামের মধ্যে অশান্তি চলে আসে। তিনি খুব ভালো ও ধার্মিক ছিলেন। তাঁর মত ধার্মিক নারী পুরো গ্রামজুড়ে আর দু’টো ছিলেননা। বটগাছে ঘটে গেল একের পর একেক ঘটনা।
রানু বেগমের মৃত্যুর এক সপ্তাহ পর ঘটলো অন্য এক ঘটনা। কোথা থেকে এক অচেনা মহিলা এসে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করলো। সকাল বেলা লোকজন মসজিদে যাওয়ার পথে দেখে ঐ মহিলার জিহ্বা বের করা উলঙ্গ দেহ রশিতে ঝুলে আছে। খোঁজ লাগানো হলো কোন গ্রামের মহিলা কিন্তু ; কোন খোঁজ পাওয়া গেলনা। তরুণ যুবকের কেউ কেউ আবার লোলুপ দৃষ্টিতে দেখছিলো কিন্তু কেউ ভয়ে মহিলার লাশ ছুতে যায়নি। এমনকি কারো সাহস হচ্ছে না তার লাশ নামাতে। গ্রামবাসী এলাকার চেয়ারম্যান, মেম্বারকে খবর দেয়। চেয়ারম্যান আসলেও মেম্বার আসেনা। তিনি এসে পুলিশকে খবর দেন। পরে ভর দুপুরে পুলিশ এসে লাশ নামিয়ে নিয়ে যায়। সেই থেকে গ্রামের মাঝে
আতঙ্ক আরো বেড়ে যায়। কেউ কেউ গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে যাওয়ার চিন্তা করতে থাকে।
গ্রামবাসীদের এ আতঙ্কগ্রস্ত মন দেখে গ্রামের চেয়ারম্যান, মেম্বর, শিক্ষক মিলে গোপন মিটিং বসানো হয়। সিদ্ধান্ত হয়, গ্রামবাসীরা সবাই মিলে এই ডোবা ভরাট ও পুরোনো জটাধারী বটগাছ কেটে ফেলার। কিন্তু যেদিন রাতে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সেদিন রাতেই সবাইকে একই স্বপ্ন দেখানো হয়,
কেউ যদি এই বটগাছ কাটতে চায় তাহলে তার পুরো চৌদ্দ-গুষ্ঠি নির্বংশ করে দেয়া যাবে। তাই আর কেউ সাহস করে বটগাছটাও কাটতে যায় না। করিম মিঞার ভিটে এখন পরিত্যক্ত। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়ও ভুলেও কেউচোখ কিংবা আঙুল তুলে ওদিকে তাঁকায় না।
কিছুদিন পর এই নিয়ম করে মৃতের ঘটনা বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামবাসীও স্বস্তি পায়। গ্রামবাসীদের মধ্যে আতংকটা কিন্তু রয়ে যায়। গ্রামের কল্যাণের স্বার্থে প্রতি শুক্রবার গ্রামের মসজিদে কোরাণ-খানি ও মিলাদ-মাহফিলের ব্যাবস্থা করা হয়।
বটগাছের পাশের রাস্তাটা খুব অন্ধকার দেখা যায়। রাত-বিরাতে কেউ বাজারে যেতে পারেনা, আসতে পারেনা। সেদিন সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়া হল, বটগাছের নিচে পঁচিশ ওয়াটের একটা এনার্জি বাল্ব ঝোলানো হবে। বাল্ব ঠিকই ঝোলানো হল কিন্তু দেখা দিল নতুন বিপত্তি। বাল্ব কিছুতেই জ্বলছেনা। নতুন বাল্ব তাই ফেরত দিতে আবার বাজারে পাঠানো হল। দোকানদার জ্বালিয়ে দেখিয়ে দিলেন, বাল্ব ঠিকই আছে। বাল্ব এবারও জ্বললো না। তাই, গ্রামবাসী আর বটগাছে বাল্ব ঝোলাতে সাঁয় দিলোনা।
বটগাছটার কথা একসময় সবাই ভুলে যাচ্ছিল। বটগাছের বেদী গোবর, লাকড়ি কিংবা তোশক শোঁকানোর জায়গা হিসেবে ব্যাবহৃত হত। সব ঘটনা একসময় সবাই ভুলে যায়।
জাহিদ একসময় লেখাপড়া করতে শহরে চলে আসে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে। মাঝে মাঝে সাপ্তাহিক বন্ধে বেড়াতে আসে। এমনই এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে বাড়িতে চলে আসার চিন্তা করে। রাতের ট্রেন ধরে শহরে আসতে আসতে সন্ধ্যে হয়ে যায়। এরপর, রিক্সা নিয়ে গ্রামের বাজারে চলে আসে। রিক্সা কিংবা গাড়ি-ঘোড়া এ রাস্তা দিয়ে আসেনা। একমাত্র হেঁটেই যেতে হবে বাড়িতে। বাজার থেকে বাড়ির ছোটদের জন্য কিছু ভাঁজা-পোঁড়া নিয়ে রাত সাড়ে বারোটার দিকে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। বেশী রাত হওয়ায় রাস্তায় কোন জন-মানব ছিলোনা। প্রথমত গ্রাম, দ্বিতীয় রাত বারোটা। গ্রামে রাত আটটা বাঁজলেই যে যার মত খেয়ে-দেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, সে ক্ষেত্রে এখন রাত বারোটা!
বিশালাকার বটগাছের পাঁশ কাটিয়ে বাড়ি যেতে হবে। জাহিদদের বাড়ীতে যাওয়ার এই একমাত্র একটি রাস্তা। এর কোন বিকল্প রাস্তা নেই। এই বটগাছ ক্রসিং করেই তাদের বাড়ীতে আসতে হয়। এছাড়া কোন উপায় নেই। বটগাছের কাছাকাছি আসতেই ধীরে ধীরে তার পূর্বের ঘটনাগুলোর কথা মনে পড়তে থাকে। আর অমনি তার মধ্যে ভয় কাজ করে। জাহিদ যতই সামনে আসতে থাকে ততই দ্রুত হৃদপিন্ড কাঁপতে থাকে। হৃদপিন্ডটা এত জোড়ে তরপাতে থাকে যে মনে হয় বুকের খাঁচা ভেঙে বেরিয়ে আসবে। জাহিদ বটগাছের কাছাকাছি এসেই দেখতে পেল ছয়জন লোক বসে আছে। জাহিদ মনে একটু সাহস পায়। কাছে গিয়ে ডাক দিতেই লোকটা মুখ ঘুরিয়ে তাঁকায়। জাহিদ দেখতে পায় আশরাফুলের মাথা তাঁর দিকে শুষ্ক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। গাছের দিকে তাঁকাতেই হঠাৎ করে ঝুঁপ ঝুঁপ শব্দ করে জাহিদের গাঁয়ের উপর তরল আঠালো জাতীয় কিছু পড়লো।জাহিদের মনে হচ্ছে তার একেকটা পাঁয়ের ওজন চল্লিশ মণ। দৌড়াতে পারছেনা। অতিরিক্ত ভয় পাওয়ায় তার গলার স্বর থেকেও কোন শব্দ বের হচ্ছেনা।
জাহিদ বটগাছের বেদীর উপর দেখলো একজন অর্ধবয়স্ক মহিলা, আগুন জ্বালিয়ে পানি ফুঁটোচ্ছে। অন্য একজন চোখ বড় বড় করে বলছে, এই মিনসে এদিকে আয়। আজ তোকেই খেয়ে নিব।অনেকদিন ধরে কিছু খাইনা। লোকটা নিজের চোখগুলো তুলে কচ কচ শব্দ করে কাঁমড়ে খেতে লাগলো। আয় কাছে আয় !
এ দৃশ্য দেখে জাহিদ সজোড়ে দৌঁড় দিতে দিতে চিৎকার করে ছুঁট লাগালো। এক
দৌঁড়ে বাড়ির উঠোনে এসে পড়ে গেল। ঘর থেকে জাহিদের বাবা-মা বেড়িয়ে ;দেখেন তাঁর ছেলের এ অবস্থা। বাড়ীর আশে পাশের লোকজনও তার চিৎকার-চেচাঁমেচি শুনে চলে আসলো। জাহিদের বাবা জাহিদকে এত রাত্রে বাড়িতে আসার জন্য বকাঝঁকা করলেন। শহর থেকে আসার পথে কাছের কোন হোটেলে কিংবা বাজারে এসে বাবাকে ফোন না দিয়ে আসার জন্য জাহিদকে সবাই একশ-দশটা কথা শোনাতে বসে গেল। এরপর, পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে সবার কাছে জাহিদ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনার বর্ণনা করলো। সবাই ঘটনার কথা বিশ্বাস করলেও কেউ সাহস করে সত্যতা যাচাই করার জন্য আর ঐ বটগাছের নিচে যায়নি।
পরদিন প্রথম প্রহরেই প্রতিবেশীরা জাহিদকে সঙ্গে নিয়ে সেই ঘটনা দেখার জন্য দলবেঁধে সেই বটগাছের নিচে গেল কিন্তু এ ধরনের কোন আলামতই দেখতে পেল না। এভাবে,
আবার একের পর এক ঘটনা বটগাছের নিচে ঘটেই যাচ্ছে। কিন্তু এর রহস্য এতদিনেও কেউ উদঘাটন করতে পারেনি…..
(সমাপ্ত)
গল্পটি পাঠিয়েছেন–মোঃ জাহিদুল ইসলাম
খুলসী, চট্রগ্রাম ।