রাজবধূ ২৩ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শিখা বিস্মিত হয়ে মাথা তুলে তার দিকে তাকালো। দেখলো তার দু’চোখ ঢাকা বড় সানগ্লাস দিয়ে। হাতে ব্রেসলেট। মাথার চুলগুলো কালো ক্যাপ দিয়ে ঢাকা। শিখা তার অবাক করা অচেনা দৃষ্টি তাক করলো মানুষটির দিকে।
ভড়কে গিয়েও চঞ্চল কন্ঠে শুধালো,
“কে আপনে? শিস বাজান ক্যান? পথে আর জায়গা নাই?”
মানুষটি শিখার জিজ্ঞাসার গ্রাহ্য করল না। ভ্রুক্ষেপহীনভাবে শিস বাজাতে বাজাতে যেদিক হতে আসলো,আবার সেদিকে পা ঘুরিয়ে চলে গেলো। শিখা সামনে কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে থামলো। ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো শূন্য মেঠোপথ। মানুষটি কোথাও নেই। একটা দোকান আছে মোড়ে। সম্ভবত সেই দোকানে ঢুকে পড়েছে।
শিখা পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলো। হাঁটতে লাগলো আর মনে মনে গজগজ করে বলতে লাগলো,
জীবনেও এই ব্যাডারে দেখছি বইলা মনে হয়না। কেমন মোটা একটা চাদর গায়ে দিয়া ভূত সাইজা রইছে। শীতের ঠ্যালায় কোনদিক থেইকা আমদানি হইছে পরিযায়ী পাখির মতন,আল্লায় জানে। এই বলে শিখা হাতের গোলাপটি কচলে নিলো বিরক্তিকর অনুভূতি নিয়ে। পথের একপাশে সবুজ ঘাসের উপর ফেলে দিলো। চলে গেলো বাড়ির দিকে।
তার মিনিট পাঁচেক পর সেই মানুষটি একই পথে হেঁটে এলো। পথের পাশে কিছু দেখতে পেয়েই পায়ের গতি মন্থর করলো। কারো নিদারুণ অবহেলায় ছিন্নভিন্ন হওয়া ফুলের পাপড়িগুলোর দিকে চেয়ে রইলো। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো নিমিষেই। লম্বা লম্বা কদম ফেলে চলে গেলো সামনের দিকে।
পরেরদিন শেষ দুপুরে নূরী ব্যস্ততা শেষ করে মাত্রই বিছানায় পিঠ ঠেকালো। যেকোন সময়ে মেয়ের জামাই এসে পড়তে পারে। তাই নূরী এর মধ্যেই ঘরদোর লেপে,গোছগাছ করে রাখলো। সামনের রুমে ও শিখার রুমে নতুন চাদর বিছিয়ে রাখলো। এমন ক্ষণেই উঠানে সিনজির শব্দ শোনা গেলো। পাশের ঘরের ছোট ছেলে মেয়েরা হইচই শুরু করে দিলো,
শিখাবুর জামাই আইছে, দুলাভাই আইছে বলে। রাজ তাদেরকে নির্দেশ দিলো,
“চিল্লালে হবে শালা শালিরা? এগুলো সব ঘরে নিয়ে রাখো।”
তারা ঝিলিক মারা চোখে সিএনজির ভিতরের সরঞ্জামাদিগুলো দুইহাত ভরে নিলো। একে একে সবকিছু শিখাদের ঘরের পিছনের রুমে নিয়ে রাখলো। রাজের প্রাইভেট গাড়ি আছে। কিন্তু শিখাদের বাড়ির দিকের পথ ভালো না। তাই গাড়ি নিয়ে আসা সম্ভব হয়না। নূরী মাথায় কাপড় দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সামনের রুমের দিকে গেলো। রাজ ঘরে পা রেখেই শাশুড়ীর পা ছুঁয়ে সালাম দিলো। নূরী রাজের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো মাতৃস্নেহে।
রাজ চেয়ারে বসলো মার্জিতভাবে। নূরী জিজ্ঞেস করলো,
“ঢাকা থেইকা কবে আসছো? এতকিছু আনা লাগে? মানুষ কই আমার? ”
“আমি পরশু রাতে আসছি। বাড়ির সবাইকে দিবেন। আলো আপার শ্বশুর বাড়ি পাঠাবেন।”
হেসে বলল রাজ।
নূরী তাদের বাড়ির সবার কুশলাদি জেনে নিলো রাজ থেকে। বলল,
“ভাত খাইবা না রাজ? হাতমুখ ধুইয়া নাও।”
“আম্মা আমি বাড়ি থেকে খেয়ে বের হলাম। কিছুই খাবো না এখন। যেহেতু রাতে থাকবো না, তাই এখন চলে এলাম আপনাদের দেখে যাওয়ার জন্য।”
“শিখা স্কুলে। আইসা পড়বো। তুমি এইখানে জিরাও।”
“আম্মা, আমি শিখার রুমে রেস্ট নিই? শিখা আসলে বলবেন না আমার কথা।”
“আইচ্ছা যাও। ঠিক আছে বাবা।”
রাজ শিখার রুমে গিয়ে দরজা হালকা ভিড়িয়ে দিলো ভিতর থেকে। পায়ের থেকে কালো সু জোড়া খুলে খাটের নিচে রাখলো। মোজা খুলে একপাশে রাখলো। টেবিলের উপর থেকে দেখেশুনে শিখার একটা খাতা নিলো। কলম দিয়ে দু’চার লাইন কিছু কথা লিখে নিলো। আবার বন্ধ করে খাতা আগের জায়গায় রেখে দিলো। বিছানার একপাশে গিয়ে এমনভাবে চেপে শুয়ে পড়লো, যেন শিখা রুমের ভিতরে প্রবেশ করা ছাড়া তাকে না দেখতে পায়। শীত বলে গায়ের গরম জ্যাকেটটি না খুলেই শুয়ে পড়লো।
নূরী পা চালিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। অন্যদিকের এক দরিদ্র জা কে ডেকে নিলো তাকে কাজে হেল্প করার জন্য। সে মসলা বাটতে বসে গেলো রান্নাঘরে শিলনোড়া নিয়ে। নূরী ভাপা পিঠা বানানোর জন্য আধাসের আতপ চাল ভিজিয়ে রাখলো। চাউল দিয়ে মুরগী একটা ধরে ফেলল। নারকেল ভাঙ্গতে বসে গেলো দা নিয়ে রান্নাঘরের ভিতরেই। খেজুরের গুড়,নারকেল আগেই কিনে রেখেছে ঘরে।
শিখা স্কুল থেকে এলো। নিত্যদিনের মতই সামনের দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো। তার রুমের দরজা অল্প চাপানো দেখে সে কিছু মনে করল না। কারণ খালি রুমে দুই তিনটা মুরগী এসে উঠে যায় বিছানার উপরে। নোংরা করে ফেলে। তাই রোজ এমনই থাকে তার রুমের দরজা। শিখা দরজা মেলে নিলো। সোজা কয়েক পা এগিয়ে টেবিলে তার বই খাতাগুলো রাখলো হাত থেকে।
বিছানায় দৃষ্টি যেতেই সে,
আম্মাগো! ভূত! বলে ভয়ার্ত স্বরে চিৎকার দিতে যাচ্ছিলো,অমনি রাজ লাফিয়ে উঠে তার মুখ চেপে ধরে ফেলল। আরেক হাত দিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলো। শিখাকে পিছনে টেনে এনে বসালো বিছানার একপাশে। শিখা চোখ বন্ধ করে ফেলল ভয়ে। মুখ থেকে রাজের হাত ছাড়াতে পারছে না।
রাজ শিখাকে শান্ত সুরে বলল,
“শিখা করছ কি? আমি রাজ। লোকে শুনলে কি বলবে? চোখ খোলো। অদ্ভুত মেয়েতো তুমি। জামাইরে দেখে কেউ এমন ভয় পায়?”
রাজ হাত সরিয়ে নিলো। শিখা পিটপিট করে রাজের দিকে তাকালো অনুক্ষণ। তার মন এবার বিশ্বাস করল এ তার স্বামী রাজ। মুখ নামিয়ে নিলো লজ্জায়। রাজ থেকে আলগা হয়ে বসলো চেয়ারে গিয়ে।
“তোমাকে সারপ্রাইজড দিতে চেয়েছিলাম। ভয় পাবে বুঝতেই পারিনি। সরি। ”
হঠাৎ ঝড়ো হাওয়ার ন্যায় শিখা নিজের রুমে রাজকে দেখে ও তার স্পর্শ পেয়ে রীতিমতো কাঁপছে। রাজ দুটো বালিশের উপরে কনুই ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে আছে। শিখার দিকে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। অতঃপর কন্ঠে মধু ঢেলে বলল,
” শতবার মরিতে চাই তোমার ওই ভ্রমর কালো আঁখিদুটির ভীরুতায়।”
শিখা নিরুত্তর রয়। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়। এলোমেলো পায়ে রুম থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে দরজার কিনারায় যায়। হাতে টান পড়লো। শিখা ঘাড় হেলিয়ে চাইল না। ওভাবেই স্থির রইলো। শুনতে পেলো রাজের পুরু অথচ মোলায়েম কন্ঠস্বর।
“আমার থেকে দূরে থাকতে চাও বাটারফ্লাই? তাহলে দু’বছরকে দিগুণ করে ফেলি? বাড়ুক দূরত্ব। না হোক ভালোবাসাবাসি। হুঁ?”
শিখার মুখে কোন রা নেই। রাজের মুঠোবন্দী তার এক হাতের পাতা। শিখার শরীরের মৃদু কম্পন টের পাচ্ছে সে। রাজ শিখাকে নিজের সামনে এনে বসালো। বলল,
“এবার ত স্বাভাবিক হও। আমি আসাতে তুমি খুশি হওনি প্রজাপতি?”
শিখা ছোট্ট করে হুঁ বলল।
“হুঁ” তে কি বোঝালে?”
“কিছু না। হাতমুখ ধুইমু। ক্ষুধা লাগছে। ভাত খামু।”
“ওহ! যাও। খেয়ে তাড়াতাড়ি আমার কাছে আসো। কথা আছে জরুরী। শাশুড়ী মা মুরগী রান্না করছে আমার জন্য। সুঘ্রাণ ভেসে আসছে।”
ঈষৎ হেসে বলল রাজ।
শিখা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। বুকে হাত দিয়ে দুম করে দম ছাড়লো স্বস্তির। হাতমুখ ধুয়ে রান্নাঘরে গেলো। মিটসেফ থেকে প্লেটে ভাত তরকারি বেড়ে নিতে নিতে অনুযোগের সুরে বলল,
“আম্মা,তুমি কি? নিজের প্যাটের মাইয়ার চাইতে পরের ছেলের প্রতি টান বেশি? তুমি আমারে কইবানা উনি আইছে?”
“জামাই যেইখানে মুখখুইলা কইলো তোরে কইতে না। সেইখানে আমি ক্যামনে কই?”
পাশে পিঁড়িতে বসে নারকেল কুরিয়ে নিচ্ছে শিখার এক চাচী। সে বলে উঠলো,
“এত কথা কইস না মাইয়া। কোন পূর্ণির জন্যি এমন ভালো স্বামী কপালে জুটছে, হেই শুকরিয়া আদায় কর। ”
শিখা পিঁড়ি টেনে নিয়ে একপাশে বসে ভাত খেয়ে নিলো। হাত ধুয়ে মাকে জিজ্ঞেস করলো,
“আম্মা, তোমারে কোন কাম আগায়া দেওন লাগবো?”
“লাগব না। আমারে তোর চাচী কাম আগায়া দিতাছে। তুই জামাইয়ের কাছে যা। গল্প কর। তারা যে আমার দুই বছরের শর্ত মাইনা নিছে এইটাইতো বহুত। বিয়া কইরা কোন পোলা এমন বউ ছাড়া থাকে। জামাই কোন চা পছন্দ করে জিগায়া বইলা যা আমারে।”
“আইচ্ছা জিগায়া লই।”
রাজ শিখার পৌরনীতি বইটা নেড়েচেড়ে দেখছে। শিখা রুমের দরজায় পা রাখলো। রাজ বই বন্ধ করে রেখে দিলো। শিখা বলল,
“কোন চা পছন্দ করেন? আম্মা কইলো জিগাইতে?”
“তুমি চায়ের নামগুলো বলো? তবেই না বলতে পারবো।”
ঠোঁটের কোণে দুষ্ট হাসি ঝুলিয়ে বলল রাজ।
“আদা চা,লেবু চা,লং চা,মসলা চা,রং চা।”
“আর?”
“আর আমি জানিনা।”
শিখার অধরকোণে গাঢ় লজ্জা ভর করলো। মনে মনে বলল,
ইসসইরে..মনে হয় আমি বুঝিনা। দুধ চায়ের নাম শুনতে চান আমার মুখ থেকে।গুন্ডা পুরুষ!
“তুমি যেহেতু আর কোন চায়ের নাম জান না,তাহলে সেই চা আমি খেতেও চাই না। যতগুলো নাম বলেছ,সবগুলো দিয়ে বেশি করে মশলা চা খাবো। শীতের পরিবেশে এটাই যায়।”
শিখা মাকে গিয়ে জানিয়ে আসলো চায়ের কথা। ফিরে এসে রুমের দরজায় দাঁড়ালে রাজ ডাক দিলো।
“ভিতরে আসো প্রজাপতি। ভয়ের কোনকিছুই করব না। তোমাকে ঘনিষ্ঠভাবে ছোঁবওনা। প্রমিজ। তাতে সমস্যা আমারই বেশি।”
শিখা ভিতরে গিয়ে চেয়ারে বসে। রাজ দরজা চাপিয়ে দিলো হাত দিয়ে ঠেলে। ভারিক্কি গলায় বলল,
“টেস্টের রেজাল্ট দিয়েছে?”
“হুম। অল সাবজেক্টে পাস আসছে।”
“ভেরিগুড়। কেবল পাস আসলেই হবে না। পসিবল অনুযায়ী বেটার রেজাল্ট করতে হবে। আমি চাই তোমার সব রকমের কোয়ালিফিকেশন আমাকে ছাড়িয়ে যাক ইন ফিউচারে।”
শিখা অনুগত ছাত্রীর মত অবনত মস্তকে বসে আছে। রাজ আবার বলল,
“আচ্ছা শিখা, আদুরির বিয়ের কথাবার্তা চলছে। আমি চাই বিয়ের তারিখটা তোমার ফাইনাল পরিক্ষার পরে ফেলতে। যেন তুমি যেতে পারো। কি বল?”
“আমি যামু। বিয়ার খাওন খাইতে আমার ভালোলাগে। আনন্দ-ফুর্তি করতেও মজা লাগে। কিন্তু আপনাগো ঘরে নাকি আম্মার কথাই চলে। তাইলে আপনার কথা রাখবো?”
চোখ নামিয়ে মায়া মায়া কন্ঠে জানালো শিখা।
শিখার স্বতঃস্ফূর্ত সরল স্বীকারোক্তিতে রাজ সন্তুষ্ট হয়। বলল,
“তুমি চঞ্চলা! কিন্তু ভীরু ও লাজুক। মুগ্ধতা খুঁজে পাই তোমার সবকিছুতে।”
শিখা মনে মনে রাজের কথায় তাল মিলিয়ে বলল,
“আপনিও চঞ্চল! কিন্তু সাহসী ও নিলর্জ্জ! তবুও ভালোলাগে আপনার সবকিছু। ”
রাজ বলল,
“তা অবশ্য সত্যি। তাই বলে আমার কথার গুরুত্ব পাবে না সেটাও না। বাবাকে দিয়ে সেটা আমি ম্যানেজ করে নিবো। আমার একমাত্র আদরের ছোটবোনের বিয়েতে আমার একমাত্র আদরের পিচ্চি বউ থাকবে না,তা হয় না।”
শিখা মিটিমিটি হাসছে।
“আচ্ছা চিঠিতে যে ধাঁধাটা বলেছি। উত্তর কি হবে?”
শিখার মনে পড়তে দেরী হলো না। রাজের চিঠির প্রতিটি লাইন তার মুখস্থ পাঠ্য বইয়ের পড়ার মতো। সে বলল,
“আপনার সেই ধাঁধার জবাব হলো ‘স্বপ্ন’।”
“ওহ গ্রেট! ওয়ান্ডারফুল! কারেক্ট হয়েছে মাই বাটারফ্লাই!”
দরজা থেকে শিখার ডাক পড়লো।
“শিখা বু নাস্তা লও। ধরো। চাচী পাঠাইছে।”
বলটু খাড়া, বলে শিখা উঠে গিয়ে দরজা মেলে ধরলো। বলটুর হাত থেকে নাস্তা ট্রে নিয়ে নিলো। বল্টু চলে গেলো। শিখা খাটের সামনে একটি চেয়ার রেখে তার উপর নাস্তার ট্রে খানি রাখলো। রাজকে বলল,
” নাস্তা নেন। ভাপা পিঠা এখন আম্মা বানাইছে। আমার খুব পছন্দ এই পিঠা। আর ডিমের কেক আর পান্তুয়া কাইল বানাইছে। চা পরে আনতাছি।”
রাজ আয়েশ করে ধোঁয়া উঠা ভাপা পিঠা খেলো। শিখাকেও মুখে তুলে খাইয়ে দিলো। শিখা ইতস্ততবোধ করলেও খেতে হলো রাজের হাতে। রাজ বলল,
“কেউ কাউকে মুখে তুলে কিছু খাইয়ে দিলে তাকেও একইভাবে খাইয়ে দিতে হয়।”
শিখা নিরুপায় হয়েও রাজকে একটু খাইয়ে দিলো। শিখা গিয়ে চা এনে দিলো রাজকে। নিজেও খেলো। রাজ শিখাকে অনুরোধের ভঙ্গিতে বলল,
“শিখা রাতে আমরা দুজন তোমার রুমেই ডিনার করবো। আমাকে একটু তোমার হাতে খাইয়ে দিও। কেমন?”
“আইচ্ছা। অন্যের হাতে খাইতে কি শান্তি? আমি কারো হাতে খাইতে পারি না। নিজের হাতই বেস্ট আমার কাছে।”
“তোমার হাত বেস্ট বলেই ত আমি তোমার হাতে খেতে চাই।”
আনন্দের ক্ষণগুলো বিদুৎবেগে ছুটে যায়। গল্প কথায় কখন যে রাত হয়ে গেলো বুঝতে পারল না রাজ। নূরী রাতের খাবার সব সাজিয়ে দিলো ট্রেতে। শিখা ট্রেখানা নিজের রুমে টেবিলে নিয়ে রাখলো। গ্লাসে পানি ঢেলে নিলো।
“চেয়ারে আইসা বসেন। হাত ধুইয়া নেন।”
“তোমার হাতে খাবো। হাত ধোয়া লাগবে না। তুমি কখন খাবে?”
“আমার পেট ভরা। পরে খামুনি। আপনে খান।”
রাজ উঠে দাঁড়িয়ে একটু গা ঝেড়ে নিলো। চেয়ারে গিয়ে বসলো। শিখা তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দিচ্ছে। ঘরের পালা মুরগী ভুনা, রুই মাছ ভাজা, টমেটো দিয়ে মশারির ডাল রান্না, হাতে মাখা মাছের ভর্তা। খাওয়া শেষে রাজ শিখার পাঁচ আঙ্গুলের খাবারগুলোও চুষে চেটেপুটে খেয়ে নিলো। শিখার নাকের ডগা রক্তিম হয়ে উঠলো তীব্র সংকোচে।
যাওয়ার সময় রাজ শিখাকে বেশ পরিমাণ টাকা হাতে দিলো খরচের জন্য। শিখাকে নিজের সামনে দুবাহু ধরে সোজা দাঁড় করালো। নিদিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে শিখার কপালের মাঝ বরাবর একটা গাঢ় চুম্বন করলো। শিখা কিছুই বলছে না। স্থির হয়ে আছে। রাজ শিখার চিবুক ধরিয়ে ধরা গলায় বলল,
“চলে যাচ্ছি প্রজাপতি। নিজের খেয়াল রেখো। ”
শিখা নেত্রপল্লব উল্টিয়ে রাজের মুখপানে নির্নিমেষ চাইলো। দেখলো রাজের চোখদুটো ছলছল। শিখা অবাক হলো। কিন্তু প্রশ্ন করার সুযোগ পেল না। রাজ রুম হতে প্রস্থান নিলো।
সামনের রুমে গিয়ে চোখ নামিয়ে নূরীকে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেলো। শিখা ও নূরী টর্চলাইট জ্বালিয়ে রাজকে এগিয়ে দিলো বাড়ির ভিতরের পুরো পথখানি। রাজ বাজারের দিকে হেঁটে চলে গেলো। গিয়ে সিএনজি বা রিকশা নিবে। শিখার দিকে আবার মাথা ঘুরিয়ে চাইলো। রাজ তাদের দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলে মা মেয়ে বাড়ি ফিরে এলো।
শিখা মাকে বলল,
“আম্মা, উনার চোখ ভেজা ছিলো আমার থেকে বিদায় নেওয়ার সময়। এমন হয় মেয়েগো। আমিতো স্বাভাবিক। কিন্তু উনার কি হইলো?”
“বেকুব মাইয়া। হয়তো নরম দিল ছেলেটার। বউরে ছাইড়া যাইতাছে তাই।”
“নাহ আম্মা! ওই চাহনি আর অশ্রুর পিছনে যেন কিছু একটা ছিলো।”
“পড়াশোনা কইরা পন্ডিত হইতাছস। কিছুই না। তোর লাইগাই। পরেরবার আইলে তুই জিগাইস। আমার কথা মিলেনি দেহিস।”
শিখার কথাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বলল নূরী।
সেই নিশিতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাজের স্পর্শগুলো অনুভব করতে করতে শিখা সুখস্বপ্নের কল্পরাজ্যে হারিয়ে যায়।
তারপর এক সকালে সুযোগ করে নূরী বাজারে যায়। বড় দুটো সুঁই ও মোটা সুতা কিনে আনে। ঘরের দরজা বন্ধ করে দেয়। দুটো চটের বড় বস্তা বের করে নেয়। একটির নিচের অংশ সমান করে বটি দিয়ে কেটে নেয়। বাকি বস্তার মুখের সঙ্গে আটকিয়ে ভিতরে ফাঁকা রেখে চারপাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মজবুত করে ডাবল সেলাই দিয়ে নেয়। রেখে দেয় লুকিয়ে। শিখার কোচিং শেষ হয়ে গেলে তার সামনে এসব করা যাবে না। তাই প্রস্তুতিতে দেরী করল না সে। উপরে হাসিখুশি চললেও ভিতরে চলছে তার দুঃখের নদী। কেউ না জানুক সেতো জানে তার প্রাণের স্বামী মকবুল তার সম্ভ্রম রক্ষা করতে গিয়েই প্রাণ হারালো। আজ যখন সেই সুযোগ তার হাতে এসেছে। সে কাউকে ছাড়বে না। স্বামী হত্যার বদলা নিবে।
এদিকে খায়রুল তালুকদার আবার বাদশাদের বাড়িতে যায়। দেখে জুলফা নেই। ঘর তালা বন্দী। প্রবল আক্রোশে সে ফিরে আসে। তার সন্দেহ ঘনীভূত হলো। বাদশা কি তাকে সন্দেহ করেছে কোন কারণে? সেই কি জুলফাকে অন্যত্র সরিয়ে দিলো? নাহ তাহলে ত বাদশাকেই দুনিয়া থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে। সাথে আরেকজনও। নূরী। এই দুজন মানুষ যতক্ষণ পৃথিবীতে বেঁচে আছে ততক্ষণ তালুকদারের প্রাণ সংশয়! সামান্য দুইজন অতি সস্তা মানুষের জন্য ছোট তালুকদারের প্রাণে ভীতির সঞ্চার হয় সময় অসময়ে। এ হতে পারে না। কিছুতেই না।
এক বিকালে নূরীর ঘরে চেনা দুজন পুরুষ আসলো। একজন গ্রামের চৌকিদার আরেকজন মেম্বার ফজল মিয়া।
“কেমন আছো আলোর মা?”
সৌহার্দপূর্ণ কন্ঠে জানতে চাইলো মেম্বার।
“হ ভালো আছি। আপনারা হঠাৎ আমার ঘরে কি মনে কইরা? ”
চৌকিদার পান খাওয়া ঠোঁটে বলল,
“আমরা দুইটা উত্তম ও গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব নিয়া আসছি তোমার কাছে। রাখা না রাখা তোমার বিষয়। জোরের কিছুই নাই। রাখলে তোমার জন্য ভালো। গ্রামে তোমার ইজ্জত বাইড়া যাইবো।”
নূরীর কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। সে বিস্ময়ভরা চোখে তাদের দুজনের দিকে চেয়ে রইলো।
রাজবধূ ২৫ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।