প্রাচীনকালে এক রাজা ছিল। তার দৃষ্টিতে সে বেশ ন্যায় নীতিবান এবং নিয়মনীতির ক্ষেত্রে বেশ কড়া ছিল। সুশৃঙ্খল জীবনযাপন করত সে। রাজার আশেপাশের কেউ যদি ছোটোখাটো ভুল ত্রুটিও করত ক্ষমা করত না। যথাযোগ্য শাস্তির ব্যবস্থা করত। এমনকি প্রয়োজন মনে করলে কারাগারে বন্দি করে রাখত। শাসনকাজে কঠোর এই রাজার ক’জন মন্ত্রী ছিল বেশ জ্ঞানী এবং কূটনৈতিক বুদ্ধিসম্পন্ন। এদের একজন ছিল যেমন জ্ঞানী এবং তেমনি দয়ালু প্রকৃতির। সৃষ্টির খেদমত আর স্রষ্টার শুকরিয়া আদায় করতে তার জুড়ি ছিল না। কিন্তু যত ভালো মন্ত্রীই হোক না কেন মানুষ তো! ভুলচুক হয়েই থাকে। তাই নিজের কাজের ক্ষেত্রে যে অবহেলা একেবারে ছিল না তা বলা যাবে না। যদিও কোনোরকম অসৎ উদ্দেশ্য ছিল না তার তবুও অনেক সময় রাজার আদেশের খেলাপ কাজও করে বসত।
এরকম একবার রাজার আদেশের খেলাপ কাজ করার কারণে রাজা ভীষণ ক্ষেপে যায়। বিগত দিনে মন্ত্রী যত ভালো কাজ করেছিল একটিমাত্র ভুলের কারণে রাজা সেসবের কথা বেমালুম ভুলে যায়। রাজা আদেশ দেয় মন্ত্রীর মাল-সামানা যেন বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং তাকেও যেন কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়। রাজার আদেশ মানে তো অলঙ্ঘণীয় ব্যাপার। মন্ত্রীর সহকর্মীরা এই অবস্থা দেখে ভাবল কোনোদিন তো তার মাঝে খারাপ কিছু দেখি নি। অথচ ছোট্ট একটি ভুলের জন্য তাকে এত বড় মাশুল দিতে হচ্ছে ব্যাপারটা তো ঠিক হচ্ছে না। সেজন্য অন্যান্য মন্ত্রী মিলে মধ্যস্থতার চেষ্টা করল। তারা বাদশাকে বলল- অতীতের ভালো গুণগুলোর কথা স্মরণ করে যেন আজকের ভুলটা মাফ করে দেয়। কিন্তু রাজা তার সিদ্ধান্তে অনড়। কোনোভাবেই ক্ষমা করলো না রাজা। তাই বহুদিন মন্ত্রীকে কারাগারে কাটাতে হলো। ইতোমধ্যে আস্তে আস্তে সবাই তার কথা ভুলেও গেল। কিন্তু হঠাৎ এমন একটা ঘটনা ঘটল যে তার জীবনের মোড়ই পাল্টে গেল।
ঘটনাটা হলো- পাশ্ববর্তী দেশের বাদশা কারাবন্দি মন্ত্রীর জন্য একটা চিঠি লিখল। ওই চিঠি কারাগারে পাঠানো হলো এবং মন্ত্রীর হাতে গেল। চিঠিতে প্রতিবেশী দেশের রাজা লিখেছিল: “তোমার দেশের রাজা তোমার মূল্য বুঝলো না। সে লবণ খেয়ে লবণদানিটা ভেঙে ফেলে। তোমার মতো সৎ আদর্শবান ও জ্ঞানী-গুণী একজন মন্ত্রীর মর্যাদা যে কী সেটা তার জানা নেই। তোমার মতো একজন নিরপরাধ মানুষ কারাগারে কাটাবে এটা আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি কিছু একটা না করে পারছি না। সে কারণেই আমি তোমার জন্য একটা প্রস্তাব দিতে চাই। প্রস্তাবটা হলো তুমি রাজি থাকলে মানে সম্মত হলে আমি তোমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করব এবং আমার দেশে নিয়ে আসব তোমাকে। আমার দেশে তুমি খুব ভালোভাবে জীবন যাপন করতে পারবে, এখানে কোনো অসুবিধা হবে না তোমার।”
উজির ভালো করে চিঠিটা পড়ল এবং যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়ে ওই চিঠির জবাবও লিখল। তারপর চিঠিটা একজন পত্রবাহককে দিল যাতে প্রতিবেশি দেশের বাদশার হাতে পৌঁছে দেয়।
এদিকে কারারক্ষীদের একজন এই চিঠি আদান-প্রদানের বিষয়টা গভীরভাবে লক্ষ্য করল। কিন্তু সে জানতো না চিঠিতে কী লেখালেখি হচ্ছে। সে চিন্তা করল নিশ্চয়ই প্রতিবেশী দেশের পক্ষে এই মন্ত্রী গোয়েন্দাগিরি করছে। কারারক্ষী তাই দেরি না করে বাদশার কানে খবরটা পৌঁছায়ে দিতে গিয়ে বললো: হে ন্যায়-নীতিবান রাজা! তোমার সাবেক মন্ত্রী তো কারাগারে বসেও জঘন্য কাজ করে যাচ্ছে।
রাজা জানতে চাইল: কী জঘন্য কাজ করছে সে?
কারারক্ষী বলল: সে প্রতিবেশী দেশের পক্ষে গোয়েন্দাগিরি করছে। আমি দেখেছি সে একটা চিঠি লিখে পত্রবাহকের হাতে দিয়েছে প্রতিবেশী দেশের রাজাকে দেয়ার জন্য।
রাজা এ কথা শুনে ভীষণ রেগে গেল। আদেশ দিল এ অভিযোগ সত্য কি মিথ্যা তা যেন যাচাই করে তাকে জানানো হয়। সঙ্গে সঙ্গে একদল চলে গেল পত্রবাহকের কাছে। তাকে গ্রেফতার করে নিয়ে এল রাজার কাছে। রাজা পত্রবাহকের কাছ থেকে মন্ত্রীর লেখা চিঠিটা নিয়ে পড়ল। মন্ত্রী চিঠিতে পাশ্ববর্তী দেশের রাজার উদ্দেশ্যে লিখেছে: “তোমার সহানুভূতি ও অনুগ্রহের জন্য অনেকক অনেক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি তোমার আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারছি না। কেননা আমি এই দেশের, এই খান্দানের নিয়ামত খেয়ে বড় হয়েছি। সামান্য কষ্টের কারণে আমি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।”
এই চিঠি পড়ে রাজা বুঝতে পারল যে, তার কারাবন্দি জ্ঞানীগুণী মন্ত্রী তো নিজের দেশের সাথে কোনোরকম বিশ্বাসঘাতকতা করেই নি বরং প্রতিবেশী রাষ্ট্রের রাজার আমন্ত্রণের জবাবে খুব সম্মানের সাথেই অসম্মতি জানিয়েছে। এমনভাবে জবাব দিয়েছে মনে হবে তাকে যেন এই মর্মে উপদেশ দিয়েছে যে এরকম আমন্ত্রণ আর কাউকে যেন না জানানো হয়। কারণ কোনো সম্ভ্রান্ত এবং স্বাধীনচেতা মানুষই নিজের বন্দি জীবন থেকে মুক্তি পাবার লোভে এবং ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের লোভে নিজের দেশ, মাটি ও মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে না।
রাজা এইসব কথা পড়ে নিজেকে খুব গর্বিত ও সম্মানিত বোধ করল এই ভেবে যে এরকম আত্মোপলব্ধি আর সত্যের অনুভূতি ও বোধ সম্পন্ন মন্ত্রীটি তারই, অন্য কারো নয়। সঙ্গে সঙ্গে আদেশ দিল মন্ত্রীকে যেন প্রচুর পরিমাণ নিয়ামত দেয়া হয় আর কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তি দেয়ার পর মন্ত্রীর কাছে রাজা তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইল। সৎকর্মপরায়ন মন্ত্রীকে আবারো তার আগের পদ ও দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হলো। তার বাজেয়াপ্ত করা মালামালও ফেরত দেয়া হলো। এভাবেই মন্ত্রী পুনরায় জনগণের সেবায় লেগে গেল।*
গল্পটি পাঠিয়েছেন–
সাতক্ষীরা থেকে মহিবুল্লাহ মালেক ভাই